BanshkhaliTimes

মুক্তচিন্তার যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্রতী মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

BanshkhaliTimes

মুক্তচিন্তার যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্রতী মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

শামসুদ্দীন শিশির 

বিদ্যা চর্চার পারিবারিক পরিমন্ডলে আলোর প্রদীপ জ্বেলে এ ধরায় এসেছেন তিনি। পিতা স্বল্প প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছেন আকাশ ছোঁয়ার। তাঁর হৃদয়ের আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সন্তানদের মাঝে। তাই বিদ্যাশিক্ষা বা দীক্ষা দিতে কাপর্ণ্য করেননি পন্ডিত মোহাম্মদ মতি উল্লাহ মুন্সী। পূর্বপুরুষরাও জ্ঞান চর্চায় ব্যাপৃত ছিলেন বিধায় তৎকালীন পটিয়া উপজেলার (বর্তমানে চন্দনাইশ) আড়ালিয়া গ্রামের উল্লেখিত বাড়িটি পন্ডিত বাড়ি বলেই লোক মুখে প্রচলিত ছিল। যদিও বাড়ির লোকজন কখনোই নিজেদের পন্ডিত বলে প্রচার করেননি। কারণ বিনয় তাদের ভূষণ৷ এমন এক বিদ্বান পরিবারে মা রহিমা বিবির কোল আলো করে ২২ আগস্ট ১৮৭৫ জন্ম নিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ মনিরুজ্জামান। বিদ্যা শিক্ষায় পারদর্শী মনিরুজ্জামান কোলকাতা মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করে মাওলানা উপাধী লাভ করলেন। তার সর্বশেষ আত্মজৈবনিক লেখায় এছলামাবাদী শব্দটা লিখে গেছেন। তাই তিনি আমাদের কাছে মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী বা ইসলামাবাদী। বাবার কাছেই শিক্ষার হাতে খড়ি। নিজ এলাকায় শিক্ষাচর্চার প্রারম্ভিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও দূরের পথ ও সন্তানের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে নিজেই সন্তানদের আরবী-ফার্সি শিক্ষার ছবক দিয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ম শৃঙ্খলা রপ্ত করার জন্য পাশের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং মেধা দুই-ই সমান ছিল বলে দূরের শিক্ষালয় হুগলি পাঠিয়ে দেন। তারপর কোলকাতা মাদ্রাসা। বিষয়বস্তুর শিক্ষার পাশাপাশি প্রাজ্ঞ পন্ডিতদের কাছ থেকে সামাজিক, মানবিক দীক্ষার ফসলও ঘরে তুলেছিলেন। তাই তাঁর সারাজীবনের সংগ্রাম, শিক্ষকতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সমাজ উন্নয়ন, সংবাদপত্র সেবাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত অন্ধকারে ডুবে থাকা সমাজের মানুষকে আলোর পথযাত্রী করার কোনো উপায় নেই। ব্যক্তিগত আর্থিক দৈন্য গোছানো এবং শিক্ষকতা পেশায় দক্ষতা অর্জন ও বিষয়বস্তুর নানান দিক যৌক্তিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য রংপুর, কোলকাতা, সীতাকুন্ডসহ নানান প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রয়োজনীতার কথা সাধারণ্যে ও সরকারের কাছে সহজে উপস্থাপনের পথ হিসেবে সংবাদ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে সাংবাদিকতা শুরু করেন। বেশি দিন স্থায়ী থাকেননি সাংবাদিকতায়। জনসেবা করার জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি থাকা সমীচিন মনে করে কখনো কংগ্রেস আবার কখনো নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ দলেও যোগদান করেছেন। এজন্য বেশ কয়েক বার কারা ভোগও করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটান ১৮৯৫ সালে। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে খুব সামান্য সময়ের ব্যবধানে পিতাকে হারান। পটিয়ার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৯৭ সালে আদিবর রহমান চৌধুরীর একমাত্র কন্যা আছিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। ঘর আলো করে প্রথম সন্তান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন ১৯০০ সালে রংপুরে। ১৯০৬ সালে প্রথম স্ত্রী এবং ১৯০৮ সালে তিনি মমতাময়ী মাকে হারান। তারপর তিনি আফলাতুন্নেছা নামে এক বিদুষী মহিলাকে বিবাহ করেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে প্রথম পুত্র মোহাম্মদ শামসুজ্জামানের মৃত্যু তাঁকে বেশ বিচলিত করে। সন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থেই তিনি চন্দনাইশ থানার বরকলে বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা আজও আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে নিরবে নিভৃতে।


শামসুজ্জমান খান তাঁর রচিত মাওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী গ্রন্থের ৪৪ পৃষ্ঠায় তাঁর শিক্ষা, সংগঠন ও সাংবাদিকতার প্রতি বিশেষ অনুরাগের কথা তুলে ধরেছেন। সংগঠনের মধ্যে সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্র ও বিক্ষিপ্ত শক্তিকে সঞ্চিত করে মাওলানা তাঁকে সামাজিক অগ্রগতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারে, প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ আয়োজন করেছিলেন একটি জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মোছলেম শিক্ষা সম্মেলন, আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালী প্রভৃতি। তাঁর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল ধর্ম শিক্ষার ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও যুক্তিবাদের প্রসারের সাথে সাথে তাদের পরিশ্রমী, সংযমী ও স্বাধীনতাকামী করে গড়ে তোলা এবং এভাবে সমাজ ও দেশের বৃহত্তর কর্তব্যের দ্বারে, তাদের পৌঁছে দেয়া। অন্যদিকে তিনি তাঁর ক্ষুদ্র কিন্তু অসামান্য পুস্তিকা “নিম্নশিক্ষা ও শিক্ষাকর” (১৯৪০) এ বলেছেন- “পৃথিবীর যত সভ্য দেশ আছে প্রায় সর্বত্রই প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের জার্মানী ইত্যাদি স্থানে নিম্নশিক্ষা বাধ্যতামূলক; সেখানে শতকরা ১০০জন লোক লিখিতে পড়িতে জানে। ইউরোপের অন্যান্য ক্ষুদ্র, বৃহৎ রাজ্যের শতকরা ৫ জনের অধিক নিরক্ষর লোক নাই। রুশ সাম্রাজ্যেও বর্তমানে শতকরা ৯০ জন পর্যন্ত লোক নূন্যাধিক লেখা পড়া শিখিয়াছে। হতভাগ্য ভারতের অবস্থা স্বতন্ত্র।… পরলোকগত দেশপ্রেমিক মি. মেখলে নিম্নশিক্ষা বাধ্যতামূলক করিবার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় ও মোম্বাই প্রদেশে আজীবন চেষ্টা করিয়াও সফলতা লাভ করিয়া যাইতে পারেন নাই। বাংলায় একদল জাতীয়তাবাদী ও কৃষকপ্রজা বৎসল লোক বহুদিন হইতে নিম্ন শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিবার জন্য আন্দোলন চালাইয়া আসিতেছেন।” মাওলানার এই আন্দোলন ছিল মৌলিক ও নিম্নতর স্তর থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ভিত্তিস্বরূপ।
প্রকৃতপক্ষে সংগঠন, শিক্ষা ও সংবাদপত্র একটি সমাজকে গড়ে তোলে। এছলামাবাদীর জীবন এই লক্ষ্যে স্থিত হয়েই সফলতা পেয়েছিল। মনিরুজ্জামানের কর্ম জীবনের সূচনা কবেই এ ধরণের চিন্তাধারা তাঁর মধ্যে গড়ে উঠতে থাকে। তিনি লিখেছেন, “১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় নিখিল ভারতীয় মোছলেম শিক্ষা সমিতিতে যোগদানের সুযোগ পাইয়াছিলাম। তখন হইতে আমার অন্তর বাঙলাদেশের শিক্ষা বিস্তার ও ইসলাম প্রচারের উপায় সম্বন্ধে নানা বিষয়ও চিন্তাধারা উদ্ধেলিত হইতেছিল। আমার মনে হয়, ১৮৯৮ অব্দে কুমেদপুর হইতে কলিকাতার ইসলাম প্রচারক মাসিক পত্রিকার ইসলাম মিশন সম্বন্ধে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখি। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে আঞ্জুমানে উলেমার তত্ত্বাবধানে যখন ‘আল এছলাম’ মাসিক পত্র প্রকাশিত হয় সেই পত্রের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে আমার ইসলাম প্রচারকে প্রকাশিত প্রবন্ধাবলী পুনমুদ্রিত হইয়া ছিল।”
নারী সমাজ যাতে সম্মান ও মর্যাদার সাথে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্য নারী শিক্ষার প্রসারে গুরত্বারোপ করেছেন মাওলানা ইসলামাবাদী। উৎপদানশীল কর্মকান্ডে নতুন প্রজন্মকে নিয়োজিত করতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিক্ষার সম্প্রসারণে তিনি কদম মোবারক এম. ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মহীরূহসম শিক্ষাব্রতী মনিরুজ্জামানকে নিয়ে এতো স্বল্প পরিসরে কিছু লেখা দুর্সাধ্য। তাঁর জ্ঞান, কর্ম ও প্রজ্ঞার বিস্তৃতি আকাশসম। তাঁকে নিয়ে একটা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবী। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নামে গবেষণা বৃত্তি চালু করা অতীব জরুরী। দেয়াং পাহাড়ে তাঁর নামে ইসলামাবাদীর স্বপ্নের ‘জাতীয় আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার জোর প্রস্তাব রাখছি। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ রচনা ও তার কর্মকীর্তি তুলে ধরে সেমিনার আয়োজন প্রজন্মকে ঋদ্ধ করবে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা তার কর্মের-ই প্রতিচ্ছবি। কর্মই ধর্ম। এই মন্ত্রই তাঁকে মুক্তচিন্তার যুগ শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্রতীতে পরিণত করেছিল। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটাতে তিনি ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিলেন।

লেখক: শিক্ষক প্রশিক্ষক, শিক্ষা চিন্তক

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version