Banshkhali Sea Beach

Banshkhali Sea Beach – বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত

[পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বাঁশখালী উপজেলা। ধারাবাহিক এ সিরিজে বাঁশখালীর সমুদ্র সৈকত নিয়ে ( Banshkhali Sea Beach ) লিখছি। চরিত্রগুলো কাল্পনিক, ঘটনা এবং বর্ণনাগুলো বাস্তব]

এক.

Table of Contents

আমাদের টার্গেট সমুদ্র-সৈকত, বাঁশখালীর সমুদ্র সৈকত ( Banshkhali Sea Beach )।

এখনো জন-পরিচিত কোন নাম দেয়া হয় নি। “বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত” নামটাই যথার্থ মনে হয়।

বাংলাদেশ-বার্মার সীমান্তবর্তী মদক অঞ্চলের পাহাড় থেকে উৎপন্ন সাঙ্গু নদী বান্দরবানের থানচি, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর ও সাতকানিয়া হয়ে বাশঁখালী থানার উত্তরাংশকে আনোয়ারা থানা থেকে পৃথক করে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গেছে।

এই সাঙ্গুর দক্ষিণ কূল থেকে শুরু করে পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের এই সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলকে আমরা আমাদের প্রস্তাবনায় “বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত” ( Banshkhali Sea Beach ) বলে থাকি।

আবহাওয়া অনেক সুন্দর ছিল। ভোর ৭টায় বেরিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো পয়েন্ট আছে সৈকতের। রাস্তাও ভিন্ন ভিন্ন।

সাঙ্গু নদীর বাশঁখালীস্থ তীর ঘেঁষে যে রাস্তাটি ঠিক সরলরেখার মত বঙ্গোপসাগরকে ছেদ করেছে, সেটাই আমাদের রুট।

তিন থেকে চার কিলোমিটারের এই রাস্তায় হাটতে হবে প্রায় দেড় ঘন্টা।

আমাদের ডানপাশে সাঙ্গু, তারপরে আনোয়ারা থানা। আর বামে জনবসতি। এই ভ্রমণকে নিছক ভ্রমণ বললে ভুল হবে।

“চক্ষু মেলিয়া ঘরের পাশের ঘাসের ডগার উপর একটি শিশির বিন্দু দেখা” বলা যায়।

অবাক কান্ড, মহেষখালী পয়েন্ট থেকে কক্সবাজারের মূল এলাকা (যেখানে মূলত পর্যটকেরা ভীড় জমায়) পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে সমুদ্র সৈকত, সেই একই লাইনে আমাদের এই সৈকতের অবস্থান হওয়ার পরও আমরা তা জানতামই না!

ভাইদের মধ্যে আমি একটু বাচাল টাইপের। আমি দু’জনের মাঝখানে হাটছিলাম। ডানে ছোট ভাই আর বামে সেঝ ভাই। বললাম-

‘কি মনে করেন? পর্যটন উপজেলা হওয়ার যোগ্যতা আছে বাঁশখালীর?’ ( Banshkhali Sea Beach )

সেঝভাই- তোর কি মনে হয়?

(ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে) আপনি বলেন।

ছোটভাই- তুই বল শুনি…

: সম্ভব। ইনফ্যাক্ট, খুব ভালভাবে সম্ভব। তবে তার আগে অনেক কাজ করতে হবে।

উত্তর-দক্ষিণে বাঁশখালীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। আমাদের পশ্চিমে সমুদ্র একেবারে অগভীর।

বাঁধ হয়ে গেলে পলিমাটি জমে অল্প সময়ের মধ্যেই এই বাঁধের পশ্চিমে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিস্তৃত এক সৈকতের উদয় হবে,

যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম! তার উপর আছে ইকো পার্ক আর চা-বাগান! পুর্বপাশে আছে বিস্তৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

সরকার চাইলে বড় প্রকল্প হাতে নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে ওই সংরক্ষিত এলাকায়।( Banshkhali Sea Beach )

পশু-পাখিদের ঘোষিত অভয়ারণ্য জাতীয় কিছু। আমাদের ইকো-পার্কের ঝুলন্ত সেতুটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম হিসেবে সংসদের প্রস্তাবনায় বা পত্র-পত্রিকায় আলোচিত হয়নি বলেই এখনো পর্যন্ত রাঙামাটির সেতুটিকে দীর্ঘতম বলে ধরে নেয়া হয়।

চা-বাগানের ক্ষেত্রেও একই কথা। আয়তনে একক ক্লোন টি-স্টেট হিসেবে আমাদেরটাই তো বৃহত্তম। জলকদরকেও প্রসেসিং করা যায়। এটা নিয়ে আমার একটা প্ল্যানও ছিল…

– ‘কি প্ল্যান?’

‘ছোট ভাইয়া, মনে আছে একবার বলেছিলেন যে ইকো পার্কের লেকে পানসি বা ছোট ছোট স্পীড বোটগুলো আবার চালু করা উচিৎ?’

‘হুম…’

‘জলকদরকে হালকা সম্প্রসারিত করে এখানেও আপনার ওই সার্ভিস চালু করা যায় না?

অথবা পরিসরটা আরো বড় করে ইশ্বরবাবুর হাট থেকে, প্রেমাশিয়া থেকে, গন্ডামারা থেকে বা যে কোন একটা পয়েন্ট থেকে শুরু করে,

জলকদর-সাঙ্গু-বঙ্গোপসাগরকে রুট হিসেবে নিয়ে জলকদরের পশ্চিমাঞ্চলটা চক্কর দিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরুর পয়েন্টে ফিরে আসা; কেমন হবে?’

‘প্ল্যান হিসেবে দারুণ। কিন্তু এখন কি সম্ভব বলে মনে করিস!?’, সেঝ ভাই বললেন।( Banshkhali Sea Beach )

ছোটভাই- ‘ঠিকই আছে। পর্যটন উপজেলা ঘোষিত হলে অবশ্যই সম্ভব। আমার কথা হল, সরকার যদি বাঁশখালীতে পর্যটনের নিমিত্তে ইনভেস্ট করে, কয়েকগুন বেশি করে ফিরে পাবে- চোখ বন্ধ করে বলা যায়।

কর্ণফুলির ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত যে টানেল বাঁশখালীর মুখে এসে উঠবে, সেটা যদি বাস্তবে হয়, তাহলে বাঁশখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে আর কোন চিন্তা থাকবে না। কক্সবাজার রুটের রাস্তা বলেই এটা আলাদা গুরুত্ব পাবে…’

বললাম, ‘সম্ভাবনা অনেক আছে। এখন এগুলো নিয়ে প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেই হয়…’

সুর্য দিগন্ত থেকে একহাত মত উপরে উঠেছে। এলাকার এক ছোটভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আসা ক্যামেরা ছিল।

ছোট ভাইয়া ফটোগ্রাফে ওস্তাদ। শুধু ফটোগ্রাফেই নয় আসলে, মাল্টি-ট্যালেন্টেড…

দুই.

‘মজার একটা কাহিনী শুনাই, কী বলেন’ -বললাম।

সাঙ্গুর তীর বেয়ে হাটছি আমরা বঙ্গোপসাগরের দিকে। সাঙ্গুর স্রোতে প্রতিফলিত সুয্যিমামার মনোরম দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে করতে ছোটভাইয়া বললেন,

‘কি কাহিনী?’

বললাম, ‘যেখানে যাচ্ছি সেখানকার কাহিনী। কল্পকাহিনী নয় ঠিক, ইতিহাস। চন্দইন্যা হাট, অংগারকেল, বালুখালি- নামগুলো শুনেছেন?’

সেঝভাই- অংগারখালী শুনেছি। একটা খালের নাম।

ছোট ভাই- কোথায় যেন পড়েছিলাম এটা একটা প্রাচীন শহর। এখন হারিয়ে গেছে। প্রত্নতাত্বিক কোন শহর হতে পারে।

বললাম- ঠিক বলেছেন, একটা খালের নাম। আবার এই নামে একটা প্রাচীন লোকালয়ও ছিল।

যাইহোক, আরেকটা প্রশ্ন করি। দ্বীপ কীভাবে গঠিত হয় জানেন কেউ?

ছোটভাই- কোরাল আইল্যান্ড সম্পর্কে তো জানি। আরো থাকতে পারে। বিস্তারিত জানা নেই। হঠাৎ আবার এই প্রসঙ্গ কেন? কি যেন ইতিহাস বলবি বলছিলি?

আমি- বলছি বলছি। একটু গুছিয়ে নিচ্ছি। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে।

আচ্ছা, আমাদের খানখানাবাদের পশ্চিমে যে একটা দ্বীপের মত দেখা যায়, ওটা সম্পর্কে জানেন কিছু?

হঠাৎ সমুদ্রের মাঝখানে ওভাবে জেগে ওঠার মানে কি?

ছোটভাই- ভাবিনাই ওভাবে। জানা উচিৎ। ইন্টারেস্টিং।( Banshkhali Sea Beach )

আমি- দ্বীপের ফরমেশন নিয়ে বলছিলাম না? আমাদের পশ্চিমের ওই দ্বীপটা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই এ ব্যাপারে হালকা পড়াশুনা করেছিলাম।

বেশ কয়েকটা উপায়ে দ্বীপ জেগে উঠতে পারে সমুদ্রের বুকে।

কন্টিনেন্টাল, টাইডাল, ব্যারিয়ার, ওশানিক, কোরাল এবং আর্টিফিশিয়াল- এই ছ’টি উপায়ে দ্বীপ গঠিত হয়।

কন্টিনেন্টালের ধারনাটা হল- একদা পৃথিবী সংযুক্ত একটা ভূখণ্ড ছিল। অতঃপর ভুগর্ভের ক্রমাগত কম্পনের ফলে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।

এর মধ্যে আকারে ছোট কিছু ভূখণ্ডকে দ্বীপ বলা হয়। টাইডাল হল জোয়ার ভাটা কেন্দ্রীক, এবং ওশানিক হল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জেগে ওঠা দ্বীপ।

সেঝভাইঃ এক মিনিট এক মিনিট! সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে দ্বীপ গঠিত হবে কেমনে!

আমিঃ আসলে দ্বীপ গঠিত হয় না এক্ষেত্রে, বরং দ্বীপ আকারে দৃশ্যমান হয়।

সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে অনেক নিচু ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত উচু হয়ে থাকা যেসব ভূমি পানিতে বিলীন হয়ে যায় না, সেগুলোই মূলত ওশানিক আইল্যান্ড।

যাই হোক, কোরাল আর আর্টিফিসিয়াল সম্পর্কে তো জানেনই। আমাদের মূল কনসার্ন ব্যারিয়ার আইল্যান্ড নিয়ে।

সমুদ্রতীরবর্তী ভূখণ্ড বরাবর সামনে সমুদ্রের তলদেশে কোন কারণে অপেক্ষাকৃত উচু জায়গা গঠিত হলে, শত-সহস্র বছরের ক্রমাগত ঢেউ সেখানে পলিমাটি জমা করতে থাকে।

অবস্থানে অপেক্ষাকৃত উচু হওয়ায় ওই জায়গায় এসে সামুদ্রিক বালি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বাসা বাধতে থাকে। ( Banshkhali Sea Beach )

এভাবেই গড়ে ওঠে নতুন নতুন দ্বীপ। প্রবাল দ্বীপগুলোও ব্রড সেন্সে ব্যারিয়ারের ক্যাটাগরিতে পড়ে।

সেঝ ভাইঃ বেশ মজার তো! আচ্ছা এবার বল এটার সাথে আমাদের গন্তব্যের কি সম্পর্ক?

বলেছিলি আমাদের সৈকত সম্পর্কে কোন কাহিনী বলবি।

আমিঃ শুরুতে তিনটা নাম বলেছিলাম না?

“অংগারকেল, চন্দইন্যা হাট, বালুখালী?” এগুলো হল ঐতিহাসিক কিছু জায়গার নাম- বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কিছু লোকালয়।

আব্দুল করিম স্যার তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে,

অংগারকেল জায়গাটি, স্থানীয়ভাবে যেটি আংগরখালী নামে পরিচিত, খানখানাবাদের পশ্চিমেরই কোন একটা জায়গা হবে, ভাঙ্গনের ফলে যেটা এখন সমুদ্রের নিমজ্জিত হয়ে আছে।

এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা পর্তুগিজ ঔপনিবেসিকদের ডায়েরীতে এর সম্পর্কে জানা যায়।

আমার কি মনে হয় জানেন, আব্দুল করিম স্যারের হাইপোথিসিসটা যদি সত্যি হয়,

তাহলে আমাদের খানখানাবাদের পশ্চিমে জেগে ওঠা ক্রমবর্ধমান দ্বীপটা ওই অংগারকেলের ধ্বংসাবশেষকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠছে।

ছোটভাইঃ দারুণ তো! কোথায় জেনেছিস এগুলো?

আমিঃ আব্দুল করিম স্যারের বইয়ে হালকা বর্ণনা দেয়া আছে।

ওনি কিছু সোর্স উল্লেখ করেছেন- সেখান থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। তাছাড়া হালকা পড়াশুনা করেছি সমুদ্রবিজ্ঞান সম্পর্কে।

আমাদের এ অঞ্চলে পর্তুগীজদের আগমন এবং বসতি সম্পর্কে জানেন নাকি কেউ?

খুব জ্ঞান গবেষণা না হলেও এ ব্যাপারে মজার কিছু তথ্য জানা যায় ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে।

ছোটভাইঃ বল দেখি…

৮টা পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রাস্তার অর্ধেকটাও শেষ হয় নি এখনো।

দেড় ঘন্টায় পৌছানোর প্ল্যান থাকলেও টের পেলাম যে পায়ে হেটে আড়াই-তিন ঘন্টার আগে কিছুতেই পৌছানো সম্ভব না।

আমাদের এলাকায় শরৎকালের সকাল ৮টা মানে ঝাঁঝালো টাটকা রোদ। কথা বলতে বলতেই দ্রুত পদে হাটা শুরু করলাম ।

তিন.

“ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে”, বললাম, “কররানী সুলতানদের পতনের পর চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায়। পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে মূলত এই সময়টাতে।

আব্দুল করিম স্যার তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম নোঙ্গর করে ১৫১৮ সালে।

শেরশাহের বাংলা দখলের পর তাদের আধিপত্য বেশ বিঘ্নিত হলেও পরবর্তীতে আরকান রাজার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তারা বেশ জাঁকজমকের সাথেই চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন এবং লুটতরাজ করে।

সায় দিয়ে সেঝ ভাই বললেন, “এই অঞ্চলে পর্তুগীজদের দস্যুপনার একটা গল্প পড়েছিলাম।

নদীপথ ধরে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ধনসম্পদ লুট করত, এমনকি সুন্দরী নারীদেরও নাকি ধরে নিয়ে যেত।

এসব অন্যায় অবিচারের ফলেই তারা মুঘল সম্রাটের ক্রোধের শিকার হয় এবং বিতাড়িত হয়।

“ফাদার সেবাস্তিয়ান ম্যানরিকের নাম শুনেছেন?”, জিজ্ঞেস করলাম।

ছোটভাই- “পর্তুগীজ ধর্মযাজক? নাম তো তাই বলে।”

“এক্স্যাক্টলি। ভদ্রলোক খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। ওনার আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নেই।

১৪৫৩ সালে ওসমানী তুর্কীদের দ্বারা কনস্টানটিনোপল বিজিত হওয়ার পর প্রাচ্য জগতের সাথে য়ুরোপের ব্যবসায়িক সম্পর্ক একেবারেই ভেঙ্গে যায়।

বেঁচে থাকার জন্যেই তারা ব্যবসার নতুন দিগন্ত খুঁজতে বাধ্য হয়।

কনস্টানটিনোপলের পতন শীঘ্রই য়ুরোপের জন্যে এক ধরনের আশীর্বাদ রূপে প্রতিভাত হয়।

ইয়ুরোপীয় নাবিকেরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েন। ভৌগোলিক আবিষ্কারের (Geographical discovery) হাত ধরে ইয়ুরোপে শুরু হয় ঔপনিবেশিক যুগ (Colonial era)।

নতুন কোন জায়গায় উপনিবেশ গড়ার জন্যে তাদের বিশেষ কিছু টেকনিক ছিল।

ব্যবসা বা ধর্মপ্রচারের মত নিরীহ ও আকর্ষণীয় কাজের মাধ্যমে তারা প্রথমে বসতি স্থাপন করত। ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী হলে তারা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত।

পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা, আলভারেজ ক্যাব্রাল প্রমুখেরা ভারতে এসে ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা করেছিলেন একই উপায়ে।

ইতিহাস বলে যে, কালিকট অঞ্চলে পর্তুগীজেরা প্রথমে থাকার ও ব্যবসা করার অনুমতি নেয়। পরে তারা নিজেরাই স্থানীয় লোকদেরকে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় এবং দাঙ্গা সৃষ্টি করে।

সেই দাঙ্গাকে উসিলা করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বিশাল নৌ-বহর নিয়ে হাজির হয় এবং শেকড় গেড়ে বসে।”

“অন্যদিকে ইয়ুরোপে”, বলে চললাম, “মার্টিন লুথার তৎকালীন চার্চের মারাত্মক কিছু অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করে ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন।

তার সংস্কার আন্দোলনে সারা য়ুরোপ জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। ক্যাথলিক চার্চের বিকল্প হিসেবে প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

স্পেন, পর্তুগাল এবং ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্য বজায় থাকলেও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ফলে ক্যাথলিক নেতৃবৃন্দ তাদের সংখ্যাধিক্য বজায় রাখার জন্যে সারা বিশ্বব্যাপী নতুন কলোনিগুলোতে তাদের ধর্ম প্রচারে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন।

ব্যাবসায়িক বা সামরিক বাহিনীর সাথে তাই সর্বদা কিছু ধর্মীয় যাজক থাকতেন। এমনই একজন যাজক ছিলেন ফাদার সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক।”

থামলাম। আর পারছিলাম না। একে ঝাঁঝালো রোদ, তার উপর প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

পানি নিয়ে আসা উচিৎ ছিল, বেশ বুঝতে পারছিলাম। আশে পাশে গাছ-গাছালিও নেই যে ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেব। আরো ঘন্টা-আধেক হাঁটতে হবে গন্তব্যের পৌছুতে।

চার.

সেঝভাই- “তারপর?”

বললাম, “ওনার লেখা “ট্রাভেলস অফ ফ্রে সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক ১৬২৯-১৬৪৩” বইটা চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগীজদের কর্মকান্ডের সবচে’ শক্তিশালী দলীল।

১৬২৯ সালে তিনি হুগলি থেকে চট্টগ্রাম আসেন। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে দেয়াঙ অঞ্চলে তাদের বানিজ্য কুঠি এবং একটি গীর্জা ছিল।

এখানেই ছিল তাদের কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্রস্থল। আরাকান রাজ্যসভায় একদা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হলে রাজা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেন।

পর্তুগীজদের নির্দোষ প্রমাণ করে তাদের পক্ষে ওকালতি করার জন্যেই তিঁনি প্রথম আরাকান ভ্রমণ করেন।

সমুদ্রপথ বিপদসঙ্কুল হওয়ায় তিনি যতদুর সম্ভব, ওনার বর্ণনামতে রামু পর্যন্ত, নদীপথে গিয়েছিলেন।

তাঁর সেই নদীটাই ছিল আমাদের জলকদর খাল। জলকদরের নামকরণের ইতিহাস জানেন?”

সেঝভাই বললেন, “মোঘল ফৌজদার জুলকদর খানের নামানুসারে হয়েছে নিশ্চয়ই।

১৭৩০’র দশকে মোঘল পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খালটি সংস্কার করেছিলেন।

শুনেছি আগেকার যুগে নাকি এই খাল, যেটাকে তোর যাজক মশায় নদী আখ্যা দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখত।”

“যাই হোক, আরাকান রাজসভায় গিয়ে তিনি সফলতার সঙ্গে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করেন।

সাথে ‘পর্তুগীজ পাদ্রীদের ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তকরণের অনুমতি’ সংক্রান্ত একটা ফরমান পাশ করিয়ে নিয়ে আসেন।

আংগরখালীতে (প্রথম পর্বে এই স্থানের বিস্তারিত পরিচয় দেয়া আছে) পর্তুগীজদের বসতি ছিল আগে থেকেই।

প্রায় শতাধিক বছর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত পর্তুগীজ জেলেদের অনেকেই এ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে।

আবার পর্তুগীজ জলদস্যুরাও বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে লোকজন ধরে এনে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত।

ফাদার ম্যানরিক যখন ফরমান নিয়ে আসেন, সে সময়ে অংগারখালীতে বসবাসরত খ্রীষ্টানরা ছিল গরীব।

এরা স্থানীয় অখ্রীষ্টান (জেলে সম্প্রদায়ের হিন্দু বা মুসলিম) মেয়ে বিয়ে করে তাদের সঙ্গে বসবাস করত। স্থানীয় প্রধানদের অধীনে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করত তারা।

গীর্জা থাকলেও অবস্থার শিকার হয়ে তারা গীর্জা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের স্ত্রীরা খ্রীষ্টান না হওয়ায় পরিবারের অসম্মতিতে তারা গীর্জায় বসবাস করতে পারত না।

কালচারাল এসিমিলেশনের হাত ধরে ধীরে ধীরে এনিহিলেশন (Annihilation through cultural assimilation)। কতকটা স্পেনের মরিস্কোদের মত, তাই না?” থামলাম।

ছোটভাই সোৎসাহে প্রতিবাদ করলেন, “বলিস কী! কোথায় মরিস্কো আর কোথায় এরা! মরিস্কোদের তো বিতাড়িত করা হয়েছে।

নাম-পরিচয় পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, অচ্ছুৎ করা হয়েছে। আর এরা তো নিছক পরিস্থিতির শিকার।

খাবার কিছু নেই দেখে একজনের ঘরে ঢুকে পড়েছে, ধীরে ধীরে এই ঘরের সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এখানে তো তাদেরকে কেউ কোন কিছুতে বাধ্য করে নি! Were they forced?”

“Culture forced them, not the people, I guess”- সেঝভাই জবাব দিলেন।

আমি কাহিনীতে ফিরে গেলাম। বললাম-
“ফাদার আরাকান থেকে ফরমান নিয়ে এসে আংগরখালীর খ্রীষ্টানদের একত্রিত করার কাজে হাত দেন।

তিনি তাদের গীর্জায় বসবাসের প্রস্তাব দিলে জবাবে তারা অক্ষমতা প্রকাশ করে।

তারা তাদের সমস্যার কথা জানায়; তাদের স্ত্রী-রা মেনে নিবে না, স্ত্রী-দের ছেড়ে দিলে জীবিকা নির্বাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ইত্যাদি।

ফাদার তাদের আশ্বাস দেন যে, গীর্জায় পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার মত ঘর তৈরির ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে দিবেন, এবং ন্যুনতম এক মাস তাদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নিবেন।

তিনি সুস্পষ্ট নির্দেশন প্রদান করেন যে, হয় তাদের স্ত্রী-রা খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে গীর্জায় এসে তাদের সাথে থাকবে, নতুবা তারা তাদের স্ত্রী-দের ত্যাগ করবে।

সবাই ফাদারের কথা মেনে নেয়। ফাদার ম্যানরিক অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব কিছু সরবরাহ করেন। আংগরখালী চার্চ পুনরায় সরগরম হয়ে ওঠে।

বিচ্ছিন্ন খ্রীষ্টানদের পুনরায় খ্রীষ্টান পরিচয়ে একত্রিত করা হয়, আর স্থানীয়দের নতুনভাবে দীক্ষিত করা হয় খ্রীষ্ট ধর্মে।”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম অবশেষে! উফ, গরম একেবারেই অসহ্য! এক দোকান থেকে পানিতে চুবিয়ে রাখা (ফ্রিজের বিকল্প হিসেবে) তিনটা কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে আসলেন ছোটভাইয়া।

নয়নাভিরাম দৃশ্য সামনে। ইট বাঁধাই করা সংকীর্ন রাস্তাটা হঠাৎ করেই যেন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে! ভাঙ্গনের কুফল।

পর্যাপ্ত পানি এবং কিছু খাবার জিনিসপত্র নিয়ে, সমুদ্রের তীর ঘেষে দোকানপাট থেকে একটু দক্ষিণে গিয়েই বসে পড়ালাম।

আমাদের সামনে, মানে পশ্চিমে এখন বঙ্গোপসাগর, আর সোজা উত্তরে বঙ্গোপসাগরের সাথে সাঙ্গুর মোহনা।

আমার চোখে ভাসতে থাকে বাঁশখালীর পশ্চিমে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা বাঁধ, সরলরেখার মত, অথবা ধনুকের মত বাঁকানো! সম্মুখে নয়নাভিরাম বেলাভূমি, অসীম সমুদ্দুর।

পাঁচ

আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে উত্তর পশ্চিমে প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কোণে তাকালে দেখা যায় নাব্যতার অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকতে না পেরে অপেক্ষাকৃত গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা অট্টালিকা সদৃশ সুবিশাল জাহাজের বহর।

আমাদের সামনেই প্রথম পর্বের হাইপোথেটিকাল সেই দ্বীপটি।

মনে হচ্ছে খুবই কাছে; যেন খুব সহজেই সাঁতরে যাওয়া যাবে। ডানে সাঙ্গুর মোহনা; মিয়ানমারের মদক অঞ্চলের পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে উৎপন্ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ নদীটি এখানে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গিয়েছে। নদীর ওপারে আনোয়ারা থানা।

আমাদের বাঁয়ে প্রায় ৩২ কিলোমিটার ব্যাপি বাঁশখালীর পশ্চিম সীমানা, যেটি আবার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশস্থ পূর্ব সীমানাও বটে।

“ইশ! দ্বীপটা যদি কিনে নিতে পারতাম!”

“নে না। সমস্যা কী!”, ছোটভাই।

“ট্যাকা দেন, নিয়ে নিচ্ছি।”

ফটোশুটিং এর সাথে সাথে অগোছালো আলাপ আলোচনা চলতে লাগল। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল, আমাদের যে রাস্তা [বেড়িবাঁধ] বেয়ে খানকানাবাদ সৈকতের দিকে, মানে দক্ষিণ পাশে যেতে হবে, তা বিপজ্জনকভাবে ভাঙা।

সমুদ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বাঁধের পার্শ্বটা নব্বই থেকে স্থানে স্থানে নিরানব্বই শতাংশ পর্যন্ত সমুদ্রে মিশে গেছে। যেটুকু বেঁচে আছে, তাতেই অতি সন্তর্পণে পা পা করে এগিয়ে যেতে হবে।

“বেড়ানোর এত সুন্দর জায়গা, কিন্তু এসে স্বাদটা আর পাওয়া হয় না!”, একটি দীর্ঘশ্বাসের সাথে সেঝ ভাই বললেন।

“ঠিক…”

এই এলাকায় নবাগত কারও এই দীর্ঘশ্বাসের মানে বোঝার কথা না।

আমরা বুঝি। বর্ষাকালে [দুই মাস, মাঝে মাঝে যা এখন চার-পাঁচ মাসও ছাড়িয়ে যায়], পূর্ণিমা ও অমাবস্যার চার তিথিতে সমুদ্রে ওভারফ্লো হয় এবং কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

এই সময়টিতে আমাদের ভঙ্গুর বেড়িবাঁধের ‘কল্যানে’ প্রতি বছরই এই এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকে; তাও আবার লোনা পানি!

এখানকার অন্তত দশ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ফি-বছর নবায়ন করতে হয়।

অনেক পরিবার ভিন্ন উপায় খুঁজে নিয়েছে ইতোমধ্যে; প্রায় দশ থেকে বারো কিলোমিটার পূর্বে বাঁশখালি-সাতকানিয়ার সীমান্তবর্তী পাহাড়ে অপেক্ষাকৃত কমদামী জমি কিনে, সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেছেন তাঁরা।

কিন্তু নতুন একটি স্থানে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকার মত সামর্থ তো সবার নেই; সত্যি বলতে অধিকাংশেরই নেই।

স্থানীয় রাজনীতিক এবং প্রশাসকদের উদাসীনতা, নিমকহারামী আর বে-ঈমানির নিত্য খেসারত দিয়ে যায় সংগ্রামী এই মানুষগুলো।

লোনা পানির প্রভাবে উপকূলবর্তী মাইলের পর মাইল ফসলি জমি এখন বিরান হয়ে গেছে।

পরিস্থিতির শিকার এই এলাকার হতদরিদ্র মানুষদের নিয়ে সেঝ ভাইয়ের খুব চমৎকার একটা আইডিয়া ছিল এক সময়; উপকারি ব্যবসা। মহিলাদের হালকা ট্রেনিং দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হবে।

তারপর চুক্তির ভিত্তিতে স্থানীয় একটা পোশাক শিল্পের মত গড়ে তোলা হবে।

[ফর এক্স্যাম্পল] এক মাস সময়, দশটা কাপড় সেলাই করে দিতে হবে, তার পাওনা তাকে মিটিয়ে দেয়া হবে। এর বাইরে সে তার মত করে কাজ করবে।

এভাবে যদি একশ’ জনকে মেশিন কিনে দেয়া হয়, তাহলে মাসে কাপড় হয় এক হাজার পিস। এক হাজার জনকে দেয়া হলে মাসে দশ হাজার পিস কাপড়। আরো বেশী হলে…?

বিভিন্ন পোজে দাঁড়িয়ে-শুয়ে-বসে বেশ কিছু ছবি নিলাম আমরা। সময় নেই হাতে।

আমাদের প্ল্যান হল খানখানাবাদ পয়েন্ট হয়ে বাড়ি ফেরা। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, প্রেমাশিয়া পয়েন্ট, সেটা ৩২ কিলোমিটার প্রস্তাবিত বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতের সর্ব-উত্তরের পয়েন্ট।

পরবর্তী পয়েন্টের নাম ‘খানখানাবাদ’, এখান থেকে প্রায় আড়াই হতে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে।

এটুকু রাস্তা একেবারে সমুদ্রের পাড় ঘেষে যেতে হবে; ভাঙা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়া বাঁধ বেয়ে পায়ে হেটে। দুর্গম। হাঁটা শুরু করলাম অতি সন্তর্পণে।

বাঁধটা বহাল তবিয়তে থাকলে কতই না আনন্দদায়ক, রোমান্টিক হত এই যাত্রা! দীর্ঘশ্বাস…( Banshkhali Sea Beach )

“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন আপনারা? প্রেমাশিয়া আর খানখানাবাদকে আমরা আলাদা আলাদা পয়েন্ট বলি কেন?”, আলাপ শুরু করলাম।

ছোটভাই আমার ইঙ্গিত বুঝে নিলেন।

“ঠিক বলেছিস। খানখানাবাদ থেকে প্রেমাশিয়া পর্যন্ত বাঁধটা একেবারে সরলরেখার মত।

বাঁধটা যদি স্থায়ীভাবে থাকত, আই মীন বারবার ভেঙে গিয়ে যদি ইন্টেরাপ্টেড না হত, এতদিনে এই দুই পয়েন্ট মিলে একেবারে একক বেলাভূমি আকারে দেখা দিত। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ, নাকি?”

সেঝভাই, “কদমরসুল পয়েন্টও তো একই সুত্রে যোগ করা যায়।”

ছোটভাই, “অবশ্যয়ই!”

“আচ্ছা আমাদের এখানে মহীসোপানের বিস্তৃতি কেমন জানেন?”

“একশ’ থেকে একশ’ বিশ মিটার তো হবেই”, ছোটভাই বললেন। সেঝ ভাই সায় দিলেন।

আমার মনে নেই। মহীসোপানের সীমানা পর্যন্ত গিয়েছিলাম একবার; তখন অবশ্য এ টার্মটার সাথে পরিচিত ছিলাম না।

চৌদ্দ কি পনের বছর বয়সে। ভাটা ছিল। কোমর পানিতে সবার সাথে মজা করতে করতে খেলছিলাম।

ভাটায় পানি আরো কমে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে দেখলাম বেলাভূমি আর সমান নেই।( Banshkhali Sea Beach )

একেবারে প্রায় নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। নায়াগ্রা প্রপাতে যেভাবে পানি পড়ে, একেবারে একই স্টাইলে বেলাভূমি থেকে নিচের দিকে পড়ছিল পানি।

সমুদ্রের পাড় থেকে শুরু করে ভেতরের দিকে যেটুকু জায়গা অতি অল্প পরিমাণে, সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঢালু থাকে, সেটাই মহীসোপান।

সার্বিকভাবে ধরলে এই মহীসোপানের গড় গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত হয়। কিন্তু আমাদের এখানকার গভীরতা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে দশ মিটার।

আমাদের এটা কার্যত মহীসোপান না হলেও, মহীসোপানের মডেলে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় বৈ কি!
যাই হোক, একশ’ থেকে একশ’ বিশ মিটার মহীসোপান মানে বিশাল কিছু।

একশ’ বিশ মিটার প্রশস্থ বেলাভূমি থাকলে একটি সৈকতের জন্যে আর কী লাগে!

তার উপর আছে সযত্নে লাগানো সারি সারি ঝাউ গাছ। ইশ! বেড়িবাঁধের একটা স্থায়ী সুরাহা যদি হয়েই যেত! রাস্তাঘাটগুলো যদি যথোপযুক্ত হত! দীর্ঘশ্বাস…

খানখানাবাদ পয়েন্ট দেখা যাচ্ছে। সারি সারি ঝাউ গাছের বাগান। তীরে বেশ কিছু জেলেদের নৌকোয় মেরামতের কাজ চলছে।

বাতাসের সাথে ঝাঊ পাতার ঘর্ষণে সৃষ্ট হু হু তান ভেসে আসছে অনবরত। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম তিন ভাই।

হাঁটাচলা করার আর শক্তি নেই। গল্প গুজব করলাম অনেক বসে বসে। পানি-টানি খাইলাম, ছবি-টবি তুললাম, আর শেষমেশ, বেশ বড় তিনটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম আর কি…।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *