BanshkhaliTimes

বাঁশখালীর কৃতিসন্তান সাহেব মিয়া চৌধুরী: সমাজহিতৈষী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

বাঁশখালীর কৃতিসন্তান সাহেব মিয়া চৌধুরী: সমাজহিতৈষী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

আরকানুল ইসলাম

বাঁশখালীর সাহেব মিয়া চৌধুরী একনামে পরিচিত। অনেকটা ‘উপাধী’ পাবার মতো একটা নাম ছিল। ওনার আসল নাম মকবুল আহমদ চৌধুরী। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গুনাগরি রাজার পাড়া ওনার বাড়ি। রাজার পাড়া নামটি নিয়ে ছোট একটা তথ্য পাওয়া যায়। সাহেব মিয়া চৌধুরীর পিতা আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী, তাঁর পিতা আমীর আলী চৌধুরী, তাঁর পিতা নেয়ামত আলী খাঁন চৌধুরী, তাঁর পিতা মুহাম্মদ রেজা খাঁন চৌধুরী প্রকাশ রাজা আব্বাস, যার নামেই গুনাগরির “রাজার পাড়া” নামকরণ । ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা আব্বাস মোগল সেনাপতি বা সামন্ত ছিলেন।

সমাজ সংস্কারে সাহেব মিয়া চৌধুরী এমন কিছু জনহিতকর কাজ করে গেছেন যা তরুণপ্রজন্মের অনেকেই না জানলেও এখনকার বৃদ্ধ-প্রৌঢ়রা বেশ ভালো করেই জানেন।

প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর তাঁর পিতা বিশিষ্ট জমিদার আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী প্রথম সন্তান হিসেবে তাঁকে উচ্চ শিক্ষা ও ব‍্যবসার জন‍্য ‘রেঙ্গুন’ বর্তমান নাম ইয়াঙ্গুন-মিয়ানমার পাঠিয়ে দেন।

দেশে ফিরে এসে আপন মামা বৈলছড়ির খানবাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর বড় কন‍্যা আয়েশা সিদ্দিকা চৌধুরীকে বিয়ে করেন। একাধারে তিনি বদি আহমদ চৌধুরীর জামাতা ও বড় ভাগিনা হন।
তাঁদের ঔরসে ৫ পুত্র ও ৭ কন্যা ছিল। সন্তানদের সকলেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিল, কন্যাদের সভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছিল।

সাহেব মিয়া চৌধুরী একাধারে সমাজসেবক, সুশিক্ষিত,  জমিদার, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, পরবর্তীতে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম জজ কোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য (জোরার), সিএন্ডবি বর্তমান ‘সওজ’ এর  প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ ও কোকদন্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাসহ নানান সামাজিক ও ধর্মীয় জনহিতকর কাজ করে গেছেন।

ছবি: সাহেব মিয়া চৌধুরীর হাতে লেখা চিঠি
ছবি: সাহেব মিয়া চৌধুরীর হাতে লেখা চিঠি

তিনি লোক-দেখানো কাজকর্ম ও আয়েশী জীবনযাপন পছন্দ করতেন না। একান্ত ধর্মীয় অনাড়ম্বর জীবনযাপন পছন্দ করতেন এবং সেই অনুযায়ী চলতেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুর প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল না। যা কিছুই করতেন একান্তই নীরবে সম্পাদন করতেন বিধায় কোথাও নিজ নামে কিছু লিপিবদ্ধ করে যাননি। তাঁর নিজস্ব অর্থে কর্মযজ্ঞ দেখে অবাক হতে হয়।

তৎকালে ০৫ নং কালীপুর ইউনিয়ন বোর্ড তথা পরিষদের দীর্ঘকালের নির্বাচিত অত‍্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট/চেয়ারম‍্যান ছিলেন সাহেব মিয়া চৌধুরী। নিজ হাতে গড়ে যাওয়া সমাজহিতৈষী মহৎপ্রাণের এই কর্মবীর সমাজসেবককে অমর করে রেখেছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। নিজ স্বত্ব ব‍্যয়ে প্রতিষ্ঠিত কালজয়ী কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো তাঁর অমর স্মৃতি বহন করে, তার মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
▪রাজারপাড়া জামে মসজিদ (রেজিস্টার্ড ওয়াকফনামা মতে প্রকাশ: ন‍্যামত খান মসজিদ, (নেয়ামত খান) স্থানান্তর পূর্বক পূণঃপ্রতিষ্ঠা।
▪রামদাশ মুন্সির হাট গরুবাজার জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা (সম্প্রতি রেজিস্টার্ড ওয়াকফনামা সম্পাদন করায় জামে মসজিদে রেকর্ডভূক্ত হয়েছে)।
▪সাতকানিয়া ছনখোলা চৌমুহনীর মসজিদ প্রতিষ্ঠা। ▪ছনখোলা এলাকায় তাল মোহাম্মদ দিঘী পাড় (তালমৌর দিঘী) মসজিদ প্রতিষ্ঠা।
▪পূর্ব গুনাগরী সাহেব মিয়া কাঠাস্থ অধুনা প্রতিষ্ঠিত নতুনপাড়া “সাহেব মিয়া চৌধুরী জামে মসজিদ” (তাঁরই সুযোগ‍্য উত্তরসূরীগণ কর্তৃক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত: নতুন মসজিদ ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসা)।
▪সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন‍্য গুনাগরি খাসমহালস্থ স্বীয় স্বত্ব দানে(রেজিস্টার্ড) “আনসার ক্লাব” প্রতিষ্ঠা।
▪তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের চাষাবাদের সুবিধার্থে
গুনাগরি কলেজ রোডে নিজ স্বত্বদানে “ইউনিয়ন বীজাগার” (রেজিস্টার্ড) প্রতিষ্ঠা অন‍্যতম।

এছাড়া “সাহেব মিয়ার খেলা” তৎকালে প্রসিদ্ধ একটি মেলা ছিল। জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের জন্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে তথায় ঘোড়দৌড়, ভেড়ার লড়াই, মোরগ লড়াই , কুস্তি খেলার ইভেন্ট ছিল অন্যতম। সপ্তাহব‍্যাপী (কারো মতে, মাসব্যাপী) বিভিন্ন রকমের খেলাধুলা সমৃদ্ধ: বৈশাখী মেলার নিয়মিত বর্ণিল আয়োজন করা হতো যা- “সাহেব মিয়ার খেলা” বা পূন‍্যাহ নামে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তখনকার আমলে খুবই জনপ্রিয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এই মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে দিত।

সাহেব মিয়া চৌধুরী প্রায় ৩০ বৎসর যাবৎ কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদেরর (গুনাগরি) প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান থাকাকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক উন্নয়ন সাধন করেন।
বাঁশখালী হতে সাতকানিয়া হয়ে আরাকান সড়কে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল সাধনপুর সাহেবের হাট দিয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই রাস্তা দিয়ে তখন ছনখোলা হয়ে সাতকানিয়ায় যাতায়াত ছিল। সাহেব মিয়া চৌধুরী দক্ষিণ ও পশ্চিম বাঁশখালীর মানুষের কথা চিন্তা করে নিজ তহবিলের অর্থ ব্যয়ে বর্তমান গুনাগরি পয়েন্ট হতে পাহাড় কেটে, সমতলে রাস্তা বেঁধে আজকের বাঁশখালী-সাতকানিয়া সড়কটি প্রবর্তন  করেন। অথচ এই তথ্যটি আমাদের অনেকেরই অজানা!  সাতকানিয়া ডলু খালের উপর ডলু ব্রিজটি পাকিস্তান আমলে তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্মিত ।
কালীপুর ইউনিয়ন বোর্ডের তাঁর পূর্বেকার প্রেসিডেন্ট কালীপুর সুপারিন্টেন্ডেন্টের কার্যালয়ে অফিস করতেন। সাহেব মিয়া চৌধুরী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কালীপুর না বসে গুনাগরিতেই নিজ অর্থ ব্যয়ে ভবন নির্মাণ করে পরিষদ পরিচালনা করতেন। তখন থেকে আজঅবধি কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদ গুনাগরিতেই স্থায়ী রূপ লাভ করে। তার এমন বহু জনহিতকর কাজ রয়েছে।

সাতকানিয়া কোর্ট, আরাকান সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হতে বাঁশখালীর পথচারীদের  চলাফেরার জন্যে শুধু রাস্তা নির্মাণ করেছেন তা নয়, মানুষের বিশ্রাম ও নামাজের জন্যে পয়েন্টে পয়েন্টে পাকা এবাদতখানা, অজুর ব্যবস্থা, পানির জন্যে টিউবওয়েল ও মটকা ভর্তি করে সুপেয় পানি এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা করে রাখতেন। যাতে পথচারী মুসল্লিদের কষ্ট না হয়। সেই এবাদতখানাগুলো চলতি পথে এখনো দৃশ্যমান।

উত্তর বাঁশখালীতে তৎকালে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানাদি প্রতিষ্ঠা এবং জনস্বার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণসহ যাবতীয় আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে মরহুম সাহেব মিয়া চৌধুরী সক্রিয় নিঃস্বার্থ একজন উদ‍্যোক্তা ছিলেন।

অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত হলেও তিনি ছিলেন সৌখিন। তৎকালে বাঁশখালীতে হাতেগোনা যে ক’জন জীপগাড়ি ব্যবহার করতেন তারমধ্যে সাহেব মিয়া চৌধুরী অন্যতম।

তার ভাইদের মধ্যে আব্দুল গণি চৌধুরীও সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন । তাঁর বেয়াই অ্যাডভোকেট নূর আহমদ চৌধুরী ও তার ছেলে সাহেব মিয়া চৌধুরীর জামাতা মফজল আহমদ চৌধুরী দীর্ঘদিন কালীপুর ইউনিয়ন বোর্ডের যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৬৪ সালে সাগর পথে জাহাজযোগে পবিত্র হজ পালন করে এসে পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে দুনিয়াদারি থেকে গুটিয়ে নেন। তাঁর বড় দুই ছেলে হারুনুর রশীদ চৌধুরী (হারু মিয়া) ও মায়মুনুর রশীদ চৌধুরীকে (মারুন মিয়া)  জমিদারিসহ সামাজিক দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে অনেকটা অবসর জীবনযাপন শুরু করেন।

১৯৮০ সালে ৮০ বছর বয়সে (১৯০১-১৯৮০) ইহলোক ত‍্যাগ করেন।

তাঁর কর্ম, তাঁর জনহিতকর কাজ তাকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাঁশখালী টাইমস

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *