শিশুকাম, প্রকৃতির প্রতিশোধ ও নৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি
✏️ দিলুয়ারা আক্তার ভাবনা
‘তৌসিফ আঁতকে উঠল। সেই কন্ঠ! সেই হাসি! এবার পাগলের মতো দরজার ছিটকিনি নিয়ে টানাটানি শুরু করল সে। এখানে আর একমিনিট বন্দী থাকলে তৌসিফ মরে যাবে। পেছন থেকে রক্তশীতল করা হাসি ঘড়ির আ্যলার্মের মতো বেজেই চলেছে। ভয়, আতঙ্ক, দূশ্চিন্তা সব মিলিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে সে।’
এর পরে কি হয়েছে নিশ্চয় পাঠকের জানতে ইচ্ছে করছে? কার কন্ঠ? কার অমন রক্ত শীতল করা হাসি? তৌসিফ কি বেঁচেছিলো? বইটির ছোট বড় প্রায় ঘটনা এমন শিহরণ জাগানোর মতো। সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে টানতেই থাকবে।
কাহিনী প্রেক্ষাপট : উপন্যাসটি লেখা হয়েছে মূলত ‘শিশুকাম’ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। ২০১৩ সালে ছয় বছরের একটি শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে ছয় জন যুবক। প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে জয়াকে নিজের বাসায় (ফ্ল্যাট এল-৫ এ) অাগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। এবং সকল প্রমাণ নস্যাৎ করার জন্য ধর্ষিত শিশুটিকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
এর পরপরই শান্তি ভবনের মালিক ফ্ল্যাট এল-৫ কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পরিবার নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান।
উক্ত ঘটনার ছয় বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালে এল-৫ ফ্ল্যাটে আসেন তুলি ও রায়হান। সেখানে তারা একের পর এক অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হতে থাকে। রায়হানের ছবি আকাঁর ক্যানভাসে কে যেনো মৃত্যুছবি এঁকে দিয়ে যায়। নিচে থাকে রায়হানের সিগনেচার। কিন্তু সে বুঝতে পারেনা আদৌ ছবিটি কে এঁকেছে! তাহলে কি সেই ফ্ল্যাটে জয়ার আত্মা আছে বলে ফ্ল্যাটটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো?
সে সময়ে ইতালি থেকে দেশে আসেন নিহাল। যিনি ছিলেন শান্তিভবনের মালিকের ছোট ছেলে এবং ধর্ষকদের একজন। সে দেশে আসতে না আসতেই তার ধর্ষক বন্ধুরা একের পর এক মারা যেতে থাকে। বাকি রয় কেবল সে। কিন্তু, এতোবছর পরে এভাবে তার বন্ধুরা মারা যাচ্ছে কেনো? এর পিছনের রহস্য কি? সেও কি মরে যাবে শেষপর্যন্ত?
ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু উপন্যাসটিতে যখন একেকটা ধর্ষকের মৃত্যু হয় তখন মনে হয় ভৌতিক কারণেই তাদের মৃত্যু ঘটছে। তবে কি রিয়ার আত্মা ছয় বছর পর ফিরে এসেছে প্রতিশোধ নিতে? নাকি তার পিছনে রয়েছে অন্য রহস্য!
বইটির টুইস্ট এবং মাস্টারপ্ল্যানিং এ নিখুঁত ভাবে এসবের উত্তর দেওয়া আছে।
নিজস্ব অভিব্যক্তি-
‘ক্যানভাসে আকাঁ মৃত্যু’ উপন্যাসটি আগাগোড়া প্রতিশোধে মোড়া। একেকটা ঘটনা শিহরণ জাগানিয়া। ধন সম্পদের জোরে মানুষ যদিও সাময়িক সময়ের জন্য শাস্তি থেকে মুক্তি পায় তবে পাপ প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ে। লেখিকা দেখিয়েছেন মানুষ কিভাবে একটি অপরাধ ঢাকার জন্য আরো জঘন্যতম অপরাধ করতে পারে। যেটি আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। কিভাবে একটা পাপের জন্য মানুষ বন্ধুত্ব, পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিলে তিলে ধ্বংস হতে থাকে। লেখিকা পাঠকদের কাছে সন্তানের সুষ্ঠু নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী হওয়ার জন্যেও এই বইয়ের অবতারণা করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। নৈতিক শিক্ষা,পর্দা কেবল মেয়েদের জন্য নয় বরং ছেলেদের জন্যও এটা সমানভাবে জরুরি। বাবা-মায়ের সুশিক্ষা যেমন সন্তানকে সুপথ দেখায় সেই বাবা-মায়ের একটু অবহেলা সন্তানকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে।
সর্বোপরি, বইটি পড়ার পর থেকে আমার মনে প্রাণে ইচ্ছে করছে ভালো মানুষ হতে। আর লেখিকার এমন নিখুঁত চিন্তার জন্য কৃতজ্ঞতায় ভরে যাচ্ছে মন। ‘ক্যানভাসে আঁকা মৃত্যু’ বইটির মতো করে বাস্তব সমাজের অপরাধীদেরও যদি ওভাবে শাস্তি দেওয়া যেতো! তাহলে কতই না সুন্দর হতো এই পৃথিবী। সত্যিই সালসাবিলা নকির মতো লেখকের খুব দরকার এই সমাজে। খুব।
লেখিকার নতুন বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।
🌺এই উপন্যাসের তুলি এবং জেনি চরিত্র আমার মনে দাগ কেটেছে। আমি এই চরিত্র দুটোর সাথে একাত্ম হতে পেরেছি। এবং চেষ্টা করেছি তাদেরকে নিজের ভেতর ধারণ করতে।
🌺 পাঠক হিসেবে আমার কাছে কেউ বইটির ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি বলবো কাল বিলম্ব না করে এখনি বইটি পড়ার জন্য। হয়তো এখানে অপেক্ষা করছে আপনার সুন্দর কিছু সময় এবং আপনার চিন্তাজগতের প্রসারতা।
🌸এই উপন্যাসটির ভুলভ্রান্তি বলতে গেলে আমি তেমন কিছুই পাইনি। তবে কেন জানি মনে হয়েছে ভৌতিক ব্যাপারগুলোতে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
🌸আর ২৯ এবং ৩৯ নং অধ্যায় দুটির জায়গায় দুবার-ই ২৯ পড়েছে।
শেষ করছি উপন্যাসটির প্রিয় কিছু কথা দিয়ে ;
☀️ওরা যা করেছে তা বেঁচে থাকার সময় দিয়েছে দুর্নাম আর পরকালে ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
☀️ যেই ছেলেরা ধর্ষন করে ওদের জন্ম নরকে হয়না। কোনো পরিবারের, তোমার আমার মতো কারো না কারো সন্তান ওরা। পরিবার থেকে, বাবা মায়ের থেকেই ওদের শিক্ষা পাওয়া উচিত।
কিন্তু আমরা মেয়েদেরই শেখাই, তোমরা সাবধানে থেকো নাহলে ধর্ষিত হবে। ছেলেদের শেখাই না কেন, তোমরা ধর্ষণের মতে জঘন্য অপরাধ কোরো না?
সমাজ বাস্তবতামূলক আধিভৌতিক এই রহস্যোপন্যাস প্রকাশ করেছে ভূমি প্রকাশ, প্রচ্ছদ করেছেন সজল চৌধুরী। চমৎকার বাইন্ডিংসহ ১৯২ পৃষ্টার এই বইয়ের মলাটমূল্য ৩২০ টাকা হলেও সংগ্রহ করা যাবে ২০০ টাকায়। যোগাযোগ ০১৮১৪ ৮৯ ৬৭ ৩৮
লেখক: শিক্ষার্থী- বিবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সংগঠক- ডিবিএফ