জালাল উদ্দীন ইমন
২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির জাগরণের দিন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন উপাখ্যান। শাসকের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ করে ‘না’ বলে উঠার দিন। এই দিনটি আমাদের কাছে শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। কিন্তু ভুলতে পারিনি বাঙালির আরেক নির্মম ট্রাজেডি। ২০১৩ সালের একই দিনে বঙ্গোপসাগরে নিহত ৩১ জেলে হত্যা। দিনটি আজকের ২৬ শে মার্চের মতো সাধারণ ছিল না। ছিল না হাসিখুশি মুখ। স্বাধীনতা দিবসটি এখানে কালো দিবস।
৩টি ট্রলারের ৩১জন জেলে ভাইকে সামনে-পিছনে রশিতে বেঁধে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। কত নির্মম মৃত্যু তার ওজন নির্ণয় একমাত্র তারাই করতে পারে। আমি জানি না, প্রত্যক্ষদর্শী সাগরের মাছগুলো কীভাবে সহ্য করেছে। লম্বা রশিতে হাফ ডজন করে করে বাঁধা। জাল ডুবাতে ব্যবহৃত মণকে মণ পাথর বেঁধে আসামির মতো গলায় বেড়ি পরা।
ডুবন্ত মানুষগুলো একেকজন একেক দিকে আইঢাই করে বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল হয়তো। কিন্তু গরুর ঘানি ভাঙার মতো চক্রাকার ঘুরতে ঘুরতে এক দুই তিন করে ৩১জন সবাই ডুবে গেল। না, ভুল বলেছি ৩১জন নয় ৩১টা পরিবার। যাদের জীবন ও জীবিকা সঙ্কটের চরমাবস্থায় এখনো অন্ধকার। কী বিচার চাইবে! কার কাছে চাইবে! কে দিতে পারে একই সাথে ৩ সন্তান হারা পিতার হরেক প্রশ্নের উত্তর। ৪ সন্তানের বিধবা জননীর কাছে ভিক্ষার উত্তর? ২ মাস বয়সী রেহেনার কাছে ‘বাবা’ ডাকের ক্ষুধার্ত আনন্দ কতটুকু তা? ৯ বছরে পা রেখে টের পাচ্ছে।
দিন আসে দিন যায়। দুঃখ কি ফুরায়? ফিতরা জাকাতের লাইনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিতে হয় ‘এতিম’ বাবা নেই। বিধাতা এমন নিষ্ঠুর গুটি চেলে কী আমোদ পেয়েছে জানি না। তার তো ক্ষমতা ছিল উলটো চালার!
আট-দশদিন পর কতগুলো পচাগলা বিকৃত লাশ। দেখার সুযোগ হয়নি কারো। প্রশাসন একেক পরিবারের কাছে একেকটা প্যাকেটবন্দি লাশ দিয়েছে। নিজের ভাই বলে ভাইয়েরা কবরস্থ করেছে।
এতকিছুর পরেও সরকার বা প্রশাসনের উপযুক্ত দায়িত্ব কি ছিল না? বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষগুলো সাগরেই খায়, সাগরেই বসবাস। নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড ও মৎস্য অধিদপ্তর এই হত্যাকাণ্ডের দায় কী এড়াতে পারে? হত্যার ৯ বছরেও খুনীরা গ্রেপ্তার হয়নি। সন্দেহভাজন আসামিরাও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মাঝেমাঝে মনে হয় কোথাও পালিয়ে যাব। কিন্তু জীবন থেকে তো পালিয়ে বাঁচা যায় না। নবারুণ ভট্টাচার্যের জনপ্রিয় কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। শেষমেষ কবির সাথে মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়-
“যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি-
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি-
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব।”
আল্লাহ তায়ালা জেলে ভাইদের জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দিক। পরিবারের অন্ধকার ঘুচে আলো আসুক জীবনে। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মহল সদয় হোক। এই অসহায় বিপন্ন মানুষগুলোর সাহায্যে এগিয়ে আসুক। জেলে ভাতা প্রদান করা হোক। সাগরে নিরাপত্তার শুধু আইন নয়, যথাযথ প্রয়োগ হোক।
জালাল উদ্দীন ইমন
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
ডাক: শেখেরখীল
ই-মেইল: [email protected]