‘১০২ উপজেলার দেড়লাখ মানুষ প্রাণ হারায়’

জীবন থেকে সাতাশ বছর চলে গেল। আজ সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম। কৈশোরের শেষে তারুণ্যের হাঁকডাক। প্রত্যেহ ফজরের আজান হলে আম কুড়াতাম। চৈত-বোশেখের ঝড়ে জেঠাদের আম ও লিচু চুরির তরে লুকিয়ে থাকতাম কাছারি ঘরে। মনে পড়ে কী মজা ছিল চুপিসারে আজলা ভরে আম কুড়ানোর ভোর। সেদিন গুম ধরা আকাশে সন্ধের পর পিন পিন বৃষ্টি। পাড়াময় হিড়িক পড়েছে তুফান হবে আজ। ১০ নং মহা বিপদ সংকেত। কুতুবদিয়া, মগনামা, বদরখালী ছনুয়া ও রাজাখালীর হতদরিদ্র মানুষগুলো পাহাড়িয়া এলাকার আত্মীয়ের সন্ধানে তল্পিতল্পাসহ ছুটছে। টইটং ও রাজাখালীর মাঝখানে বয়ে চলেছে একটি খাল। এ খালের পাশেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘেঁষে যেই সড়কটি পাহাড়িয়া এলাকায় চলে গেছে সেই সড়কে আতংকিত মানুষের মিছিল। কাঁধে লেপ কাঁথা কম্বল। দু‘হাতে ব্যাগ-বাস্কেট আর কোলে পিঠে বাচ্চা-কাচ্চা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছে। খালে ফিশিং বোটের সারি। ডিঙ্গি, লঞ্চ, সাম্পান সবই আছে। মাঝি-মাল্লার চোখে মুখে বাঁচার আকুতি। আমাদের পাড়ার অস্বচ্ছল ও মধ্যবিত্ত সবাই যত পারে চাল ডাল আলু ক্রয় করে বেতার-টিভির নির্দেশনা মত পলিথিন ও প্লাষ্টিক মুড়িয়ে ঘরে গর্ত করে জমা রেখেছে। ইশার পর আমরা ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। রাত ১০টার পর চারিদিকে প্রবল বাতাস ছুটলে আব্বা আমাদেরকে পাশ্ববর্তী চাচাদের দ্বিতল বিল্ডিংয়ে রেখে আসে। সেখানে যাওয়ার পথটি ছিল আম আর নারিকেল বিছানো। মনে পড়ে আমি দু‘চারটি পাকা আম নিয়েছিলাম। মধ্যরাত হলে বাবুদের ঐ বিল্ডিংয়ে লোকে লোকারণ্য। আমাদের ঠাঁই নেই। দ্বিতলায় উঠে দেখি, সমাজের গরীব লোকগুলো ওখানে ইলিশ ফাইল। এলাকার মুরব্বীরা নিচ তলায় রেডিওর খবর শুনছে। র্ঘ্যা র্ঘ্যা করছে রেডিও। কিছু বুঝা যায় আর কিছু যায় না। ঘুম তো হয়নি সে রাত। খুউব ভোরে বিল্ডিং থেকে নেমে এসে দেখি চারিদিকে লোনা পানি থৈ থৈ। টিনের চাল উড়ে গেছে। ঘিরা-বেড়া মিশে গেছে। আমাদের বাড়ীর সীমানা প্রাচীর তছনছ হয়ে পড়েছে। মসজিদ- মাকতাব নাস্তানাবুদ হয়েছে। চারিদিকে লোনা পানিতে ভাসতে ডাব-নারিকেল,আসবাবপত্র,কাপড়-চোপড় আর নানান রকম জিনিসপত্র। আমাদের ঘরে কোমর সমান পানি। একটি ভাসমান চৌকিতে আমি আর বাবা জামাতে ফজর নামায আদায় করেছিলাম। পানির প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে আমি চলে এলাম ওয়াপদা বেড়িবাঁধে। সেখানকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। মৃত পশু-পাখি ও লাশের সারি। বাবা বহুজনের জানাযা পড়িয়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন। আমাদের এলাকায় দুয়েকজনের বেশী লোক মারা যায়নি তবে কতুবদিয়া-মগনামা ও রাজাখালী-ছনুয়ার সবকিছু ভেসে এসে ঠেস পায় এখানে। যা বিকট গন্ধ! আরো বহু স্মৃতি! অন্য দিন বলার আশা আছে, ইনশাল্লাহ।

এবার সামাগ্রিক পরিস্থিতির কিয়দংশ আপনাদের কাছে উপস্থাপন করছি। ১৯৯১ সালে আজকের এই দিনে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের দ্বীপগুলোতে শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়। মহা প্রলয়ংকরী এ ঘূির্ণঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ আবালবৃদ্ধবনিতা প্রাণ হারায়। অর্থনৈতিকভাবে সীমাহীন বিপর্যস্ত হয় এতদাঞ্চলের আড়াই কোটি জনগণ। নিরীহ পশুপাখী, ক্ষেত- খামার, হাট বাজার ও দালান-কৌটার ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ২০/২৫ফুট লোনা পানিতে তলিয়ে যায় দীন হীন মজুরের বসত ভিটা। সৃষ্টির সেরা মানুষ ও হিংস্র কীট-পতঙ্গ একাকার হয়ে লড়াই করে জীবনের শেষ অস্তিত্বটুকুর জন্য। চারিদিকে মানবতা ত্রাহি ত্রাহি । গলিত লাশের মিছিলে উৎকট গন্ধ। খালের পাড়ে, রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ লাশের মাংস নিয়ে কুকুর ও শকুনের কাড়াকাড়ি। কোন উসিলায় বেঁচে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা আহাজারি ও দু‘ মুঠো ভাত পেটে দেয়ার অশ্রুসজল আর্তনাদ আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছিল।

৪৭,২০১ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চল। ১৮০ কি. মি প্রচন্ড গতিবেগে আবহাওয়া মুহুর্তেই সব নিঃশেষ করে দেয়। সরকারি হিসেব মতে, ১০২ টি উপজেলায় দেড় লক্ষ মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি মতে, প্রায় আড়াই লাখ লোক মারা যায়। খোদ কুতুবদিয়াতে ১০ হাজারেরও বেশী লোক নিহত হয়।এভাবে গত ২০০ ( ১৭৯৪- ১৯৯৮) বছরে প্রায় ৭০টি জলোচ্ছ্বাস হয়। তার মধ্যে গত ৩৮ বছরে (১৯৬০-১৯৯৮) ১৫টি ভয়াল ঘূুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ১৯৯১ এর ঘূুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার,মহেশখালী, চকরিয়া,পেকুয়া, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, চাঁদপুর ও নোয়াখালীর ১ কোটি জনগণ আত্মীয়-স্বজন ও ধন-দৌলত সবকিছু হারিয়ে নিস্ব হয়ে পড়ে। ৫লাখ গবাদি পশু মারা যায়। ১১লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ২৭৮৬০০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়, ৬৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছিল,৪৭০কি.মি বাঁধ ধ্বংস হয়। ৭২০০০ হেক্টর আমন ধানের জমিতে নোনা পানি ঢুকে পড়েছিল । এসব এলাকার মৃত্যু বিভীষিকার করুণ চিত্র বর্ণনার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না।

লেখক: রায়হান আজাদ, কলামিস্ট

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *