হিমালয়ে অভিযানের কাহিনী শুনালেন বাঁশখালীর হাসনাত
আবু ওবাইদা আরাফাত (বাঁশখালী টাইমস): অতিসম্প্রতি হিমালয়ের বুকে দেশের পতাকাসহ পদচিহ্ন রেখে বাঁশখালীবাসীর জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছেন বাঁশখালীর তরুণ হাসনাত আল কোরাইশী। তিনি হিমালয়ের স্টোক কাংড়ি গ্লেসিয়ারে ৫,৫৩০ মিটার উচ্চতায় দেশের পতাকা উড়িয়ে অসামান্য কৃতিত্ব, সম্মান, গৌরব ও অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মানুষের জীবন একটাই। এই এক জীবন নিয়েই মানুষের যত স্বপ্ন আর সাধনা। কারও কারও স্বপ্নের পরিধি নিছক গতানুগতিক আর কারও স্বপ্নের ডালপালা বেয়ে গেছে ব্যতিক্রম কোন শখের হাতধরে। স্রেফ সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার তুলনায় নিজেকে অসাধারণ হিসেবে গড়ে তোলার নেশায় মানুষ এডভেঞ্চারকে বেছে নেন। জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে কত প্রকৃতিপাগল অনন্য সুন্দর আবিষ্কারের নেশায় পাহাড়-পর্বত, আকাশ-পাতাল চষে বেড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য চাক্ষুষ দর্শনের সাথে যখন দেশের ভাবমূর্তির পালক যুক্ত হয়ে যায় তখন তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ছুঁতে নির্দ্বিধায় জীবনবাজি রেখে যায়। দেশের গৌরবের প্রশ্নে লড়াকু পর্বতারোহীরা নিজের জীবনকে ব্যাকপ্যাকে রাখতেও পিছপা হননা।
এমন শত শত লড়াকু, স্বপ্নাচারী, এডভেঞ্চারপাগল আরোহীর শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের গল্পের পাতায় স্থান করে নিয়েছে বাঁশখালীর ছেলে হাসনাত আল কোরাইশীর হিমালয়ের বুকে অভিযান।
এ বিষয়ে কথা বলার আমন্ত্রণ জানালে গল্পের সাথে সাথে উঠে এসেছে তাঁর ১১ দিনব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের নানা অজানা দিক। বর্তমান প্রজন্মের কাছে পর্বতের বিশাল দিগন্তের অনন্যভূবনের সাথে পরিচিতি করার প্রয়াসে বাঁশখালী টাইমসের পাঠকদের উদ্দেশ্যে এই ফিচার সাজানো হলো।
শুরুর দিকে ভ্রমণ শখের বিষয় হলেও শেষ পর্যন্ত পর্বতের সুউচ্চ চূড়া ছোঁয়ার নেশায় পেয়ে বসলো হাসনাতের মাঝে। ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ের হিলারি ও তেনজিং এর এভারেস্ট জয়ের গল্প যখন প্রথম পড়েছিল, তখনই তার মধ্যে এভারেস্টের প্রতি অন্যধরনের ভাললাগা ও কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। পরে বড় হতে হতে তাঁর এই কৌতূহল ও ভাললাগাকে চূড়ান্তরূপ দিতে, দেশ বিদেশের নানা পর্বতারোহীদের পর্বত অভিযান গুলো নিয়ে স্টাডি করতে থাকেন। ডিসকভারী চ্যানেলের বিভিন্ন এডভেঞ্চার প্রোগ্রামগুলো প্রতিনিয়ত ফলো করতেন। এভাবেই, ধীরে ধীরে নিজেকে একসময় পর্বতের সাথে জড়িয়ে ফেলেন।
পর্বত আরোহণের শুরুর দিকের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন- “প্রথমে দেশের বিভিন্ন ছোট-খাট পাহাড়ে অনুশীলন করতাম। সীতাকুণ্ড, খৈয়াছড়াসহ বিভিন্ন পাহাড়ে জুমারিং( দড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠা), রেপেলিং (দড়ি বেয়ে নিচে নামা), জিপ লাইন, নট ইত্যাদি শিখেছি। বাংলাদেশের স্বনামধন্য মাউন্টেইনিয়ারিং ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রীমার্স এ যুক্ত হই বছর দুয়েক আগে।’
তিনি কলকাতার হাওড়া ডিস্ট্রিক মাউন্টেইনার্স এন্ড ট্রেকার্স এসোসিয়েশনের অধীনে রক ক্লাইম্ভিং (পাথরের পাহাড়ে খালি হাতে উঠা) ট্রেনিং সম্পন্ন করেন । তাছাড়া, ক্লাইম্ভাথন বাংলাদেশ সিজন-১ এ সারা দেশে প্রথম রাউন্ডে দ্বিতীয় ও ফাইনাল রাউণ্ডে সারা দেশের মধ্যে ৬ষ্ট স্থান অধিকার করেন। কলকাতার HDMTA থেকে পেয়েছিলেন প্রমিসিং মাউন্টেইনিয়ার্স এওয়ার্ড।
হিমালয়ের পথে অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন- স্টোক কাংড়ি পর্বতটার উচ্চতা ৬,১৫৩ মিটার। এটি হিমালয়ের স্টোক রেন্ঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পর্বত। এটি জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের লাদাখে। আমি ১৯ জুন ২০১৮ ইং যাত্রা শুরু করি। আমার এজেন্সির সাথে প্রয়োজনীয় কাগজ, চুক্তি ও IMF(Indian Mountaineering Foundation) থেকে অভিযানের অনুমতি নিয়ে মহান আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। আমি সচেতনভাবেই অবগত ছিলাম এই অভিযান ছিল আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে জীবনঝুঁকি মাথায় রেখেই এগিয়ে চলা। বলে রাখা ভাল, আমার মত প্রাথমিক অবস্থায় স্টোক কাংড়ির মত উঁচু পর্বত আরোহণ পর্বতারোহনের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। আমার গুরু কলকাতার এভারেস্টার কুন্তল কারার আমাকে এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছিল, যাতে আমি আগে কোনও ৫,০০০ মিটারের পর্বত জয় করে,তারপর ৬,০০০ মিটার পর্বত অভিযানে যাই। কিন্তু, হিমাচল প্রদেশে ৫,০০০ মিটারের যে পর্বতে অভিযানে আমার যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে আবহাওয়া খারাপ থাকায়, অনেকটাই বাধ্য হয়ে আমাকে সরাসরি স্টোক কাংড়ি অভিযানে চলে যেতে হয়েছিল।
পর্বতে উঠার জন্য সবার বাধ্যতামূলক একজন গাইডের দরকার হয়। তারা শেরপা গোত্রের হয়। আমার গাইড ছিলেন একজন নেপালী। নাম চেওয়াং শেরপা। পর্বতের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ও মাঝের ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতে রাত কাটিয়ে যাত্রা শুরুর কয়েকদিন পর আল্লাহর রহমতে ভালোভাবেই আমরা বেস ক্যাম্পে এসে পৌঁছলাম। এটি ৪৮৯০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। চূড়ায় যাওয়া আগ পর্যন্ত এটাই সর্বশেষ ক্যাম্প। এখান হতেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও নির্দেশনা নিয়ে টার্গেট চূড়ায় যেতে হয়। আমরা পর্বতের যত উঁচুতে উঠছিলাম, অনুভব করতে পারছিলাম বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান ততই কমে আসছে।
আমাকে নিয়ে আমার গুরুর ভয় সত্য হলো। যখন আমি বেস ক্যাম্পে, তখন আমার শরীরের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ দেখাচ্ছিল মাত্র ৬৫% যা স্বাভাবিক অবস্থায় ৯০%+ থাকে; আর পালস রেট ছিল ১৩৫, যা সর্বোচ্চ ১০০- পর্যন্ত নিরাপদ। এমন অবস্হায় বাহ্যিক অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্য ছাড়া স্টোক কাংড়ির চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত ক্যাম্পে কোনও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্হা ছিল না। তখন, আমার এই অবস্থাটা কাটিয়ে উঠার জন্য আমার শরীরকে সঠিকভাবে এক্লাইমেটাইজ (উচ্চতা ও স্বল্প অক্সিজেনে শরীরকে রপ্ত করানো) করার কোনও বিকল্প নেই। এজন্য, আমি বেস ক্যাম্পে এক এক করে ৩ দিন কাটিয়ে দিলাম ও আশেপাশের পর্বতগুলোর ৩০০-৪০০ মিটার পর্যন্ত বেস ক্যাম্প হতে বারবার উঠানামা করতে লাগলাম। এরপরও অক্সিজেন লেভেলের খুব একটা উন্নতি না হলে, আমার গাইড আমাকে বেস ক্যাম্প থেকেই ফিরে যেতে বললো। কিন্ত আমি এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলাম না। আমি বললাম চূড়ায় তোমরা আমাকে যেতে না দিলেও, গ্লেসিয়ার পর্যন্ত আমি যে কোন মূল্যে যাবোই। আমার গাইড ও এজেন্সি এতে কোনভাবেই রাজি হচ্ছিল না। বললো যদি কোনও দূর্ঘটনা ঘটে তবে এর দায়ভার তাদের উপরই আসবে। তাই, তাদের পক্ষে আমাকে গ্লেসিয়ারে যাওয়ার অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। তখন, আমার জেদ চেপে গেল। এতদিনের স্বপ্ন, পরিশ্রম, এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসে এভাবেই খালি হাতে ফিরে যাবো, তা হতে পারে না। তাই, আমার গাইডকে বললাম, তুমি আমার সাথে চলো আর না চলো, প্রয়েজনে আমি একাই গ্লেসিয়ারে যাবো। তারা আমার একগুঁয়েমি দেখে, শেষ পর্যন্ত অনুমতিটা দিতে বাধ্য হল। আর আমার গাইড মুখটাকে কালো করে বললো, “ঠিক হ্যাঁয়, অঁর কেয়া করু; তো চালিয়ে ।” আর কালক্ষেপণ না করেই প্রয়োজনীয় গিয়ার নিয়েই গ্লেসিয়ারের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলাম।’
পর্বতে উঠার সময় সমূহ ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘এটি অনেকটা নিয়তির উপর নির্ভরশীল। এখানে প্রতিমুহূর্ত ঝুঁকি আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই,সাথে আছে তুষারধসের আশংকা,অত্যধিক ঠান্ডার কারনে ফ্রস্ট বাইট, হাইপোথারমিয়ার শিকার হওয়া, অক্সিজেনের স্বল্পতার কারনে এ.এম.এস সহ আরোও নানা প্রতিকূলতা। বরফের মধ্যে হেঁটে যাওয়ার সময় বিশাল বিশাল গুপ্ত খাদ রয়েছে। যা চোখে দেখা যায়না। তাই হাঁটার সময় আইস স্টিক দিয়ে চেক করে করে যেতে হয়। এমন খাদে অহরহ আরোহীর জীবন চলে গেছে। আমি যেদিন অভিযান শেষ করে দেশে ফিরেছি সেদিনই খবর পাই, আমার এক গুরু, যার সারভ্যাইলেন্সেই আমার রক ক্লাইম্বিং শেখা, ৮ বারের এভারেস্ট জয়ী পেমবা শেরপা, সাসের কাংড়ি নামের পর্বতের এমন একটি গুপ্ত খাদে পড়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। উদ্ধারকারী টিম তিনদিন ধরে উদ্ধার অভিযান চালানোর পরও, তাঁর কোন হদিস পায়নি।’
তিনি আরও বলেন- “ফাটলে পড়ে কেউ মারা গেলে তারা জীবন্ত লাশ হয়ে থেকে যায়। বরফের কারণে পঁচে গলে যায়না।”
এই যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পর্বতে অভিযান; কী এমন ‘কারণ’ যেটি জীবনের ঝুঁকিকেও তুচ্ছ করে দেয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন- সুন্দর ও আবিষ্কারের নেশা। এই যে শুভ্র তুষারাচ্ছাদিত পাহাড় কিংবা শ্বেতবরফের পর্বতের উপর নিজেকে আবিষ্কার করা; এমন সুন্দরের বর্ণনা কিংবা অনুভূতির প্রকাশ আদৌ সম্ভব নয়। এক কথায় অসাধারণ, কল্পনাতীত। ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের মধ্যে আত্মাবগহান কে না চায়? সবচেয়ে বড় কথা এই এডভেঞ্চারের মাধ্যমে আমার দেশকে, আমার নিজ এলাকাকে এবং আমার দেশের পতাকাকে বিশ্বের দরবারে রিপ্রেজেন্ট করার অপূর্ব সুযোগ রয়েছে।’
দীর্ঘ ১১ দিনের অভিযানে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে আর মাত্র ৬০০ মিটারের জন্য স্টোকের চূড়া ছুঁতে না পারলেও, ৫,৫৩০ মিটার উচ্চতায়, স্টোক কাংড়ি গ্লেসিয়ার পর্যন্ত পৌঁছে, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আরও একবার বাঁশখালীবাসীর জন্য গৌরব বয়ে আনলেন বাঁশখালীর কৃতিবালক হাসনাত।
Vertical Dreamers তাদের ফেসবুক পেজের ওয়ালে বাঁশখালীর কৃতিমুখ হাসনাতের ব্যাপারে লিখেছে,
“হাসনাত আল কোরাইশী, চট্টগ্রামের ছেলে।
গতবছরই ডিসেম্বরে করে এলেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের সাথে “হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট ট্রেকার্স এন্ড মাউন্টেনিয়ার্স এসোসিয়েশন” আয়োজিত বেসিক রক ক্লাইম্বিং কোর্স। প্রথম রাউন্ডের আগের এই ছবিতে তিনি ভাবুক ছিলেন বলেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ফাইনাল রাউন্ডে ৫ম স্থান অধিকারীর কাছে ১ সেকেন্ডের ব্যবধানে পিছিয়ে পরে ১৯ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে অধিকার করেন ৬ষ্ঠ স্থান।
প্রথম রাউন্ডেই পায়ের নখ ফেটে যাবার পরও এমন পারফর্মেন্সে আমরা মুগ্ধ। শুভ কামনা।”
হাসনাতের বাড়ি বাঁশখালীর শীলকূপ ইউনিয়নে। তিনি চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজ হতে একাউন্টিং নিয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে, বর্তমানে নিজ ব্যবসায় যুক্ত আছেন।
ভবিষ্যতে পর্বতে আরও অভিযানের মিশন নিয়ে, এগিয়ে যাওয়া হাসনাত সবার দোয়া কামনা করেছেন।