স্মৃতির পাতায় আন্দোলিত সেই নাম…..
– জামশেদুল আলম চৌধুরী
নির্ধারিত শিক্ষকের অবর্তমানে হযরত আবদুল জাব্বার রহ. ইতিহাস ক্লাস নিচ্ছেন, হযরত কুতুব উদ্দিন রহ. মিশকাত শরিফ পড়াচ্ছেন। এমনই এক সোনালী সময়ে আমি বাইতুশ শরফে ইন্টার সমমান ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম।
প্রথমদিন কুতুব উদ্দিন হুযুরের ক্লাস করে আমি হুযুরের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও অসামান্য মেধার পরিচয় পেয়ে যেমন অভিভূত হই, ছাত্রদের সাথে তাঁর বন্ধুসুলভ আচরণ দেখে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আরও বাড়তে থাকে। ভর্তি পরীক্ষায় আরবি বিষয়ে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়া ক্লাসের বাইরে আমার সাথে কোনদিন তিনি কথা বলেননি। অনাকাঙ্ক্ষিত একদিন আমাকে হাতের ইশারায় ডেকে কাছে নিয়ে বললেন, “তুই কোথায় থাকস?”
— দুই নং গেইট থাকি হুযুর।
— ভাড়া বাসায়?
— জ্বী।
— এত দূরে! আমি তোকে এক বাড়িতে দিচ্ছি। আমাদের একজন ৬ষ্ট শ্রেণির ছাত্র পড়াবি। ওদের গাড়ি আছে। গাড়িতে আসবি যাবি, ঠিক আছে?
— জ্বী আচ্ছা।
ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই হুযুর আমার খবরাখবর নেয়া শুরু করেছেন। ভাবতেই একবার শিউরে উঠি। মনে হল যেন আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের নিবিড় যত্নে শহুরে জীবন শুরু করেছি। আরও বিস্মিত হই যখন দেখি, শুধু আমার নয়; হুযুর সব ছাত্রেরই সুবিধা অসুবিধার খবরাখবর রাখছেন। আমার অবস্থা সরেজমিন দেখার জন্য দুয়েকবার ধনিয়ালাপাড়া থেকে হালিশহর সবুজবাগ গ্রামে গিয়েছেন। আমি এখনও ভেবে কূল কিনারা পাইনা যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও হুযুর এতজন ছাত্রের কথা মাথায় ধারণ করেছেন কী করে!
এরই মধ্যে ঘটে গেল এক দুঃখজনক ঘটনা। কয়েকজন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে আমি মুসলিম হলে গিয়ে একটি শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে এক সংগীতসন্ধ্যায় কোরাস শিল্পী হিসেবে অংশ গ্রহণ করি। বেশ জমকালো অনুষ্ঠান ছিল ওটি। ৪০ টাকা টিকিটের মূল্য তখন কম নয়। নিজেকে বেশ রোমান্টিক মনে হচ্ছিল তখন। পরেরদিন সকাল ছিল আমার একান্ত এক গৌরবময় দিনের সূচনা। আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে আরেকটি সুসংবাদ নিয়ে এলো আমার সিনিয়র ক্লাসের বন্ধু বর্তমানে বাইতুশ শরফের কৃতি শিক্ষক জনাব শাহাদাত হোসেন। শিক্ষা দিবস উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতায় আমি ফার্স্ট হয়েছি। ক্লাসে গিয়ে দেখি সবাই বলাবলি করছে বাইতুশ শরফ ফার্স্ট, মহসিন কলেজ সেকেন্ড, চট্টগ্রাম কলেজ থার্ড। কেউ আমার নাম বলছে না। আমার সাথে কেউ কথাই বলছে না। অথচ আমিই হয়েছি ফার্স্ট। আর এই প্রতিযোগিতা মোটেই প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমিও বা কোন কৌশলে বলি যে সেই ফার্স্ট হওয়া ছেলেটা আমি? এখানে বন্ধুদের বলে রাখি, রচনার বিষয় ছিল ‘পরীক্ষায় নকল প্রবণতা একটি অভিশাপ’ যার সিংহভাগ আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে কয়েকটি বই থেকে নকল করেছিলাম। নকল প্রবণতা সত্যি সত্যি অভিশাপ হয়ে থাকলে ঐ বছর আমি ছিলাম শ্রেষ্ঠ অভিশপ্ত।
নতুন শহরে এসেছি আমি। জানতাম না যে, বাইতুশ শরফের অগণিত ছাত্র শিক্ষকের সবাই কুতুব উদ্দিন হুযুরের বিশাল হৃদয় কারাগারে বন্দী। কোন ছাত্রের বাড়ি কোথায়, বাবা কী করে, ভাইবোন কয়জন সব তথ্য তাঁর নখ-দর্পণে আঁকা। কেউ এর বাইরে নয়। এমনই এক অলৌকিক স্মৃতিধর মুহাদ্দিস উনি। যাহোক, সেই গৌরবময় শুভদিনে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি পিটি- তে অংশ নিতাম না। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই হুযুরকে কেউ আমার অবহেলার কথা ইনফর্ম করেছেন, তাই আমাকে হুঁশিয়ারি শোনানোর জন্য ডাকছেন। কাছে গিয়ে দেখি হুযুরের চেহারা শুধু নয়; সারাটা দেহেই যেন প্রচণ্ড রাগের অগ্নিসংযোগ। দেখা হওয়ার সাথে সাথে কোন কথা বলার আগে হাতের প্রকাণ্ড বেত দিয়ে প্রচণ্ড গরু-পেটা শুরু করলেন আমায়। একজন সেলিব্রিটির এভাবে নিরবে মাইর হজমের গৌরব মনে হয় একমাত্র আমারই।
আমি অতি কনফিউজড হয়ে অশ্রু হারালেও বন্ধু শাহাদাত তার অশ্রু লুকাতে পারেনি। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে আমার ওপর হুযুরের এই বীভৎস রাগের সুন্দর তাফসীর করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, সেকালে বাইতুশ শরফ চত্ত্বরে অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আঞ্জুমান নওজোয়ান’ ও ছাত্র শিবিরের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। কেউ যেন কারো ছায়াও মাড়াতো না, এমন পরিস্থিতিই আমি দেখেছি। কুতুব উদ্দিন হুযুর সে সময় ক্লাস বাদ দিয়ে শিবিরের ছেলেদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। শাহাদাত বলল, এই চরম অসন্তোষের ফলাফল তোর পিঠের ওপর দিয়ে গড়িয়েছে। কারণ চট্টগ্রাম মুসলিম হলের সেদিনের পুরো অনুষ্ঠানটাই ছিল শহীদ আবদুল মালেকের স্মৃতিতে শিক্ষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত। কেউ তোর কথা উনার কানে পাঠিয়েছে এটা ধরে নে। বিশ্বাস করুন, ভয়ে আমি কোনদিন আমার পুরস্কারটি গ্রহণ করার জন্য ওদের অফিসে যাইনি। ওরাও এটি উচিত মনে করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়নি। আর ঐ শিক্ষা দিবসকে আমি ভেবেছিলাম বিভাগীয় কোন বিশেষ দিবস।
কয়েকদিন পর ১ম বর্ষ চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। হুযুরের মেশকাত শরিফে সর্বোচ্চ নম্বর ৮১ পেয়ে আমি ফার্স্ট বয় হয়েছি। হুযুর আমাকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হেসে হেসে বললেন, “রচনা প্রতিযোগিতায়ও এভাবে লিখেছিলি না রে? পত্রিকায় দেখলাম, গান গেয়ে তিন নম্বর হইছস…. বিড়াল!” অতঃপর তিনি অপার মমতায় আমার পিঠে মৃদু চপেটাঘাত করতে থাকেন। তারপর বললেন, “যা যা যা।” আমার বুঝতে বাকি ছিল না, আমাকে হুযুরের বেধড়ক পেটানোর মধ্য নির্ভেজাল ভালোবাসাই নিহিত ছিল। আক্রোশ ক্ষোভ থাকলে শুধু একটি নম্বর বেশি দিয়ে আমাকে এগিয়ে রাখার ইচ্ছা হয়তো তাঁর মনে জাগতো না। আমাকে এত আদরও করতেন না।
ইনসাফ ও উদারতার প্রতীক বাইতুশ শরফ। আমি বিস্মিত না হয়ে পারিনি, আবদুল জাব্বার সাহেবের দূরবর্তী বিভিন্ন সফরে আমাকেও নেয়া হয়েছে কয়েকবার। অথচ এখানে কারো সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আমার মত ক্লাসের অনেকেরই মনে হত তাকেই বুঝি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এতিমদের প্রতি এই দুই কীর্তিমানের কী বিরল সহানুভূতি ছিল তা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার মত নয়। দরবারে প্রেরিত হাদিয়া নাজরানা বন্টনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ছিল এই বাবা ডাকহারা অনাথ শিক্ষার্থীদের। আমি দেখেছি, এতিম ছাত্রদের আবাসন এতই ভাল ছিল যে হোস্টেলের ছেলেরাও এখানে এসে আনন্দে সময় কাটাত। বাইতুশ শরফের আমার অধিকাংশ সময় এই সুপরিসর এতিমখানাতেই কেটেছে।
আজ বাইতুশ শরফের ক্যাম্পাস আবদুল জাব্বার ও কুতুব উদ্দিন শূন্য। এতে দুঃখিত হবার অনেক কিছুই আছে; কিন্তু বিচলিত, আশাহত হবার কিছু নেই। এই পবিত্র বাগানে একবার ঘুরে আসুন। দেখতে পাবেন, অসংখ্য অগণিত কলি শাহ আখতার রহ, শাহ আবদুল জাব্বার রহ, ও কুতুব উদ্দিন রহ. হয়ে ফোটার অপেক্ষায় নিরন্তর জ্ঞান সাধনায় রত। এই সুশৃঙ্খল বাগানের দৃশ্য দেখলে আপনার চক্ষু শীতল না হয়ে পারবে না। আর হযরত কুতুব উদ্দিন রহ.? উনি তো হাযার বছর বেঁচে থাকবেন গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ আবাল বৃদ্ধ বণিতার হৃদয়ে হৃদয়ে, দেশ জুড়ে তাঁর অবারিত মানবতার স্মৃতিচিহ্নে, অচেনা অজানা কোন লোকালয়ে তাঁর রেখে আসা মহিমায়, অগণিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটিতে, দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এতগুলো ছাত্র, শুভাকাঙ্ক্ষীর অন্তরে অন্তরে। আল্লাহ, আমাদের প্রাণপ্রিয় হুযুরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করে নাও। আমীন।।
লেখক: বিশিষ্ট অনুবাদক ও শিক্ষক