খোরশেদ আলমঃ সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি শহীদ মৌলভী সৈয়দ-এর দুঃসাহসিকতার কথা। ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ বাঁশখালীর শেখেরখীল লালজীবন গ্রামে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল কোন দিন কি কেউ ভেবেছিল এই শিশু একদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন। ’৭৫ এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে কজন সাহসী সন্তান প্রাণ দিয়েছেন মৌলভী সৈয়দ ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম শহীদ। ১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিনা বিচারে তাকে হত্যা করেছিল। মেজর জিয়া সেদিন বিচারের নামে প্রহসন করে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। কর্ণেল তাহের সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিল, যাদের নাম হয়তবা আমাদের জানা নেই। সংগ্রামের মাধ্যমে যার জীবন শুরু তার নাম শহীদ মৌলভী সৈয়দ। ১৯৬০ সালে পুঁইছড়ি ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে উলা পাস করে পরবর্তী ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন, তার দুই বছর পর চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহি বিদ্যাপিঠ সরকারী মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাস করেন। মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিকমনা একজন মানুষ। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। (বর্তমান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল কলেজটি। সিটি কলেজ থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৮ ও ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাঁশখালী সংসদীয় আসনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয় প্রদান করেন। পোস্টার, লিফলেট, ফেষ্টুন ও ব্যানার ছাপিয়ে তিনি যখন ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন ঠিকসময় ঢাকা থেকে খবর আসলো তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে বাঁশখালীতে শাহ-ই-জাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। এই কথা শুনে তিনি এতটুকু বিচলিত হননি বা তার মাঝে কোন ধরনের ক্ষোভ দেখা যায়নি। এখন যেমন দেখা যায় সারা বছর দলের পক্ষে কাজ করে অনেক নেতাকর্মী নির্বাচনের সময় নিজের পছন্দের মানুষ মনোনয়ন না পেলে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে তাকে হটিয়ে নিজের কৃতিত্ব নেন। মৌলভী সৈয়দ সেইদিন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে বিপুল ভোটে জয়ী করে এম.পি বানিয়ে ছিলেন।
বড় বড় নেতারাও মাঝে মাঝে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। যেমন করেছিলেন ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোস্তাক। এই ধরনের অভিযোগ তার পরম শত্রুরাও কোন দিন দিতে পারবেনা। মৌলভী সৈয়দ প্রচুর লেখা পড়া করতেন, তিনি ভালো গান গাইতেন, তার একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরীও ছিল। আগ্রাবাদ মিস্ত্রীপাড়া যুবলীগ নেতা সৈয়দ মাহমুদুল হক বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তাদের বাড়ীতে মৌলভী সৈয়দ থাকতেন এবং সেখানে মাঝে মধ্যে গানের আসর বসাতেন তিনি। শহীদ মৌলভী সৈয়দ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। তার আত্মহননের কথা আমরা অনেকে জানিনা। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের আহবায়ক কমিটি গঠিত হলো। কিন্তু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক তা জানতেন না। সেই সময় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আওয়ামীলীগের দুর্দিনের কা-ারি মরহুম জননেতা আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জননেতা মোছলেম উদ্দীন আহমেদ। সেই কমিটিতে বাঁশখালীর কৃতি সন্তান মৌলভী সৈয়দের ঘনিষ্ট সহচর চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলামকে আহবায়ক, ওয়াহিদুজ্জামান ও আব্দুল মান্নানকে যুগ্ম আহবায়ক করে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পরে সাংগঠনিক স্থবিরতা ও দলীয় কোন্দলের কারণে কিছুদিন পরে সেই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। পরে দেবব্রত দাসকে আহবায়ক, মোসলেহ উদ্দীন মনছুর ও আমাকে যুগ্ম আহবায়ক করে আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়রম্যান শেখ সেলিম স্বাক্ষরিত আরেকটি কমিটি দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের ১১ আগস্ট শহীদ মৌলভী সৈয়দের ১৭ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের নেতারা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাঁশখালীর শেখেরখীলে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করেন। শহীদ মৌলভী সৈয়দের বড় ভাই ডাক্তার আলী আশরাফের সাথে সেখানে দেখা হয় এবং দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। বর্তমানে তিনি বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক। তার মুখ থেকে কিংবদন্তী এই নেতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস জানতে পারি তাছাড়া ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাঁশখালীর আরেক কৃতি সন্তান মরহুম জননেতা এড: সুলতান উল কবির চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দাযিত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন সভা সমাবেশে শহীদ মৌলভী সৈয়দ সম্পর্কে বক্তব্য রাখতেন। তাঁর মুখ থেকেও শুনেছি এই বীরের অনেক কথা। লালদিঘীর মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর মার্চফাষ্ট অনুষ্ঠিত হল। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হল। শহীদ মৌলভী সৈয়দ উত্তোলন করলেন বাংলাদেশের পতাকা আর মহিউদ্দিন চৌধুরী উত্তোলন করলেন জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা। শহীদ মৌলভী সৈয়দ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম নগর গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। অনলবর্ষী এই বক্তা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দীন আহমেদকে। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছে।
সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক কিংবদন্তী নেতা সাবেক মেয়র এ.বি.এম. মহিউদ্দীন চৌধুরী। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সম্পাদক এর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাতকানিয়া থেকে নির্বাচিত সাবেক এম.পি. মরহুম জননেতা এম সিদ্দিক আহমদ। যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আরো যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা হলেন মরহুম জননেতা আতাউর রহমান খান কায়সার, সাতকানিয়ার কৃতি সন্তান এম আবু সালেহ, মরহুম এ.কে.এম আব্দুল মান্নান ও নাজিম উদ্দীন। অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তার মাঝে যে সংগ্রামী চেতনা ছিল তা অনেক বড় নেতার মাঝেও দেখা যায় না। নীতি এবং আদর্শের প্রশ্নে কারো সাথে আপোষ করেননি। তিনি অন্যায়ের কাছে কোন দিন মাথা নত করেন নি।’ ৬৯ এর গণ আন্দোলনে চট্টগ্রামে যেকজন ছাত্রনেতা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটি সফল অভিযানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ব্যক্তি। জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন মৌলভী সৈয়দ। যার কারণে সফলতাও লাভ করেছিলেন সকল ক্ষেত্রে। ছাত্র জীবনে চট্টগ্রাম শহরে মিয়া খান নগর এলাকায় একটি বাড়ীতে লজিং থাকতেন।
এত অভাব অনটনের মাঝেও নীতি ও আদর্শ থেকে অতটুকু পিছপা হননি। ভোগের জন্য যে রাজনীতি সে রাজনীতি পরিহার করে ত্যাগের মহিমায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে এটাই ছিল মৌলভী সৈয়দের স্বপ্ন। গত ২৫ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সভানেত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন শহীদ মৌলভী সৈয়দের আত্মত্যাগের কথা বলেছেন। সেই বক্তব্য বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের চলার পথের পাথেয় হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে গর্বে আমাদের বুক ভরে গেছে। ধন্য আমরা বাঁশখালীবাসী, ধন্য সমগ্র দেশবাসী এই রকম একজন বীরের জন্ম এদেশে হয়েছিল। অনেকে বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে কোন প্রতিবাদ হয়নি, প্রতিবাদ যদি নাই হবে তবে কেন সেদিন সামরিক জান্তা স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে হত্যা করল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সশস্ত্রপথে সংগঠিত হয়ে হত্যাকা-ের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল মৌলভী সৈয়দ। সেদিন খন্দকার মোস্তাকের মত বেঈমানী করলে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান থেকে রাজনৈতিক অনেক সুবিধা নিতে পারতেন তিনি। মন্ত্রী হতে পারতেন কিন্তু তিনি সেটা করেন নি। সালাম জানাই এই মহান জাতীয় বীর দেশবরেণ্য নেতাকে। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে নতুন প্রজন্ম সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা আমাদের। শহীদ মৌলভী সৈয়দের অনুসরণে রাজনীতিতে ত্যাগী কর্মীদের সমাবেশ ঘটুক। দেশ, মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে জীবন উৎসর্গ করুক। শহীদ মৌলভী সৈয়দের ৩৮তম শাহাদাত বার্ষিকীতে ত্যাগের মহিমায় কাজ করার শপথ নিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিরোধে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ’৭১ ও ’৭৫ এর খুনী এবং তাদের দোসরদের বিকৃত রাজনীতির ইতহাসের সমাপ্তি ঘটুক।
লেখক: শ্রম সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।
দৈনিক পূর্বকোণের সৌজন্যে