বাঁশখালী টাইমস: বীরপ্রসবিনী বাঁশখালী উপজেলা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য -সম্পদ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আঁতুড়ঘর হিসেবে অনন্য বাঁশখালী উপজেলা।
ঠিক তেমনি একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের অনন্যকীর্তি তুলে ধরার প্রয়াসে এ নিবন্ধ। বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী সুশীল চন্দ্র রায় প্রকাশ পেলু বাবু।
তিনি ১৯২৪ সালে বাঁশখালী উপজেলার বাণীগ্রাম গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-সুরেন্দ্র চন্দ্র রায় ছিলেন অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ও বাণীগ্রাম সাধনপুর স্কুলের ৩ প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে ১জন।
১৯৪২ সালে তিনি বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়
থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।
চট্টগ্রাম কলেজে আইএসসি-তে ২ বছর পড়াশুনা করে পরীক্ষা না দিয়ে কলিকাতা চলে যান।
কলিকাতা জর্জ টেলিগ্রাফ স্কুল থেকে বেতার প্রকৌশলে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করে চট্টগ্রাম
এসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠিকাদারি
ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন।
পেশাগত জীবনে তিনি ০১.০৩.১৯৫২ সালে
বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে “শিক্ষক” হিসেবে যোগদান করে ৩০.০৫.১৯৫৩ এবং পরবর্তীতে ০২.০৭.১৯৫৯ সালে পুণঃরায় যোগদান করে ৩০.০৯.১৯৭৮ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে নাটমুড়া পুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিষ্ঠাতাবৃন্দের অনুরোধে তিনি “প্রধান শিক্ষক” পদে যোগদান করে প্রায় ১৮ মাস দায়িত্ব পালন করে পরবর্তিতে পূর্বপূরুষদের প্রতিষ্ঠিত বাণীগ্রাম স্কুলে ফিরে আসেন।
শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ
সব বিষয়ে সমান পারদর্শী পেলু বাবু একজন
আর্দশ শিক্ষক, মানবদরদী সমাজসেবক, প্রতিভাবান নাট্যকর্মী এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে সমগ্র চট্টগ্রামে ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়ত অর্জন করেছিলেন।
তাঁর জীবনযাপন সবাইকে মুগ্ধ করত। এখনো প্রবীণ লোকজনের মুখে শুনা যায় পেলু বাবু ছিলেন অতুলনীয়, একজন আদর্শ, জ্ঞানী
ও নীতিবান শিক্ষক এবং সমাজসেবক হিসেবে পেলু বাবুর গুণাবলী বলে শেষ করা যাবে না।
বাঁশখালীর ক্রীড়াঙ্গনে এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব
পেলু বাবু। তাঁর ফুটবল খেলা পরিচালনা ছিল
অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাঁর নেতৃত্বে বাঁশখালীতে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনের প্রথম দল গঠিত হয়।
এ দুদল সাতকানিয়া কলেজে মাঠে অনুষ্ঠিত টূর্নামেন্টে অংশগ্রহন করে বিজয়ী হয়।
সৌম্যদর্শন পেলু বাবুর অভিজাত চেহারার মধ্যেই
প্রতিভাত হত তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁর আবৃত্তি, অভিনয়
ও বক্তৃতা সবসময় শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ রাখত।
১৯৬১ সালে সারাদেশে আদমশুমারী শুরু হলে
বাঁশখালীতে শুমারীর কাজ পরিচালনা কঠিন হিসেবে বিবেচিত হয়। সাতকানিয়া সার্কেল অফিসার এ কাজ পরিচালনার দায়িত্ব পেলু বাবুর উপর অর্পন করেন। তিনি নাটক ও গানের মাধ্যমে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন।
গ্রামীন সমাজের বিরোধ মীমাংসা, অসহায় শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন, মানুষের যেকোন বিপদে সহযোগিতা তাঁর রুটিনমাফিক কাজ। ১৯৬০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীর জনজীবন বিপর্য়স্ত হয়ে গেলে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে নিজ অর্থে জনগনকে পানীয় জল, শুকনা খাদ্য ও কাপড় বিলি করেন।
তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের
“নির্বাহী সদস্য” ছিলেন এবং এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমূখ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আতাউর রহমান খান কায়সার বাঁশখালী আসনে এমএনএ নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে পেলু বাবুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পেলু বাবু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
সমাজে পেলু বাবু ছিলেন একজন বড়মাপের মানুষ। সাধরণ মানুষ তাঁকে গভীরভাবে ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত। এতদঅঞ্চলে বর্তমানে পেলু বাবুর অনুপস্থিতি সর্বসাধারণের কাছে প্রতিমূহুর্তে অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও পেলু বাবু ছিলেন নিরহংকারী।
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাবান পেলু বাবু বাঁশখালীর অহংকার এবং আমাদের প্রেরণার উৎস। বিগত ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচলে ভাগ্নীর বাড়ীতে পেলু বাবু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর শূণ্য স্থান পূর্ণ হবার নয়। কিন্তু তাঁর জীবনাচরণের প্রতিটি ধারা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, আর সে পথ ধরে চলার অনুশীলনই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন।