স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
-মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম

স্বাধীনতা এক অমূল্য রতন। যার রয়েছে অন্যরকম স্বাদ। স্বাধীনতা আত্নসম্মানবোধকে জাগ্রত করে। তাই স্বাধীনতা লাভ যেমন সব মানুষের কামনা, তেমনি স্বাধীনতা অর্জনেও থাকে অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম। স্বাধীনতা কেমন জিনিস তা কেবল বুঝে যে পরাধীন সে। কবির ভাষায়- ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে! কে বাঁচিতে চায়!’ স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। যার প্রমাণ স্বাধীনতা আদায়ে ফিলিস্তিনের মানুষের চলমান কান্না, ত্যাগ, সংগ্রাম। বাঙ্গালি জাতিকে স্বপ্নের সেই স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার তুলনা তিনি নিজেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলদ্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হবেন। তাকে অবলম্বন করেই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করবো, সেবা করবো। তার সঙ্গে যোগ রেখেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হবে।’

BanshkhaliTimes

রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষটির খোঁজ করেছিলেন তার সন্ধান পেতে বাঙ্গালি জাতিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন থেকে প্রায় শত বছর পূর্বে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে।মা-বাবার আদরে ধীরে ধীরে বড় হয় খোকা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিকামী সংগ্রামী এক মানুষ। পারিবারিক গন্ডি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের দুঃখ অনুভব করেন। তাঁর কোমলমতি মন ব্যাকুল হত অসহায় মানুষের দুঃখ, দুর্দশা দেখে। তিনি ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন অসহায়, দুঃখী, অভাবীদের কষ্ট লাঘবের সংগ্রামে। মানুষের অসহায়ত্ব অনুভব করে বিলিয়ে দেন বাবার গোলার ধান। জীবন অতিক্রম করার সাথে সাথে অর্জন করেন নেতৃত্বের গুণাবলী, সব কিছুকে জয় করার মানসিক দৃঢ়তা। বাঙ্গালি জাতির উপর পাকিস্তানিদের শোষণ দেখে বঙ্গবন্ধু নীরব থাকতে পারেননি। তিনি স্বদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে জনমত গঠন করেন। স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সূচনা হয় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। তবে তা বেশি গতি পায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাওরের মুক্তিযুদ্ধ- এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুকে অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এই সময় তিনি নিজে যেমন সংগ্রামী চেতনায় বেড়ে ওঠেছেন তেমনি পুরো জাতিকেও বেড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করছেন।

আসলে বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবনটা জুড়েই রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার এক ধারাবাহিক ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদান আমরা বুঝতে পারি যখন ফিলিস্তিনি মানুষদের দিনের পর দিন রক্ত দিতে দেখি, জীবন দিতে দেখি আর তাদের জীবনের গল্প শুনি। তিনি বিশ্ব মানচিত্রে স্থাপন করে দিয়েছেন স্বাধীন বাঙ্গালি জাতির পরিচায়ক লাল-সবুজের পতাকা। তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যদি স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব না দিতেন তাহলে কি আমরা এতো তাড়াতাড়ি স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পারতাম?

একাওরের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু :

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।” এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতিকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আরো ঘোষনা করেন,”রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।…প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই তেজোদৃপ্ত ভাষণে বাঙ্গালী জাতি বুঝতে পারে আর বসে থাকার সময় নেই। স্বাধীনতা তাদের হাতছানি দিচ্ছে। তাই এইমুহূর্তে উচিত বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। বাঙ্গালী জাতি আর দেরী না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির আন্দোলনে। চলে পাকিস্তানিদের অধীন থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই।

এরপর ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬শে মার্চ গভীর রাতে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় বন্দি রাখা হয়। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে দেশদ্রোহিতার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। প্রাণ বাঁচানোর প্রলোভন দেখিয়ে বারবার চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে আয়ত্তে আনার জন্য। কিন্তু নির্ভীক বঙ্গবন্ধু প্রতিবারই হাসিমুখে মৃত্যুর জন্য তার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেন। ১১ই নভেম্বর সকাল আটটায় বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, জেনারেল আকবরের সামনে হাজির করা হয়। ইয়াহিয়ার ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু তার কাছে এসে প্রাণের ভয়ে নরম হয়ে যাবেন। ইয়াহিয়া হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘দুঃখিত’ ও হাতে বাঙ্গালীর রক্ত লেগে আছে, ও হাত আমি স্পর্শ করতে পারব না।” বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে ইয়াহিয়া হতাশ হয়ে ফিরে যায়।

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতীয় সরকার অংশগ্রহণের পর ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্নসমর্পন করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু এই স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপে ৮ই জানুয়ারী পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন।

১২ ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ পূনর্গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ নেতৃত্ব আর সুন্দর পরিচালনায় যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।ঠিক তখনি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসারের হাতে স্বপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন (দুই মেয়ে ব্যতীত)।রচিত হয় এক কলঙ্কময় অধ্যায়। বাঙ্গালি জাতি প্রতিবছর এই দিনটিকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং দোয়া করছি আল্লাহ যেন বঙ্গবন্ধুকে জান্নাতবাসী করেন-আমিন।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *