স্বর্গে যাওয়ার টিকেট || জোবাইর চৌধুরী
সব ধর্মেই মরনের পরে আরেকটি জীবনের কথা বারবার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, পৃথিবীর কর্মফল ভোগ করার জায়গা হলো পরকাল যা শেষ হবার নয়, মানে মৃত্যু পরবর্তী জীবন। এখন এই অমরনীয় জীবন কেমন হবে? কিযে বলে! মরার পর আবার কি?
ধর্মগুলো তার বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছে যা সবাই নিজের ধর্ম বিশেষে জানে। পৃথিবীর এই বৈষয়িক জীবনে ধর্ম বিশ্বাসীরা তাইতো চিন্তিত থাকে মৃত্যু পরবর্তী “কাল” কেমন হবে তার। ধর্ম বিশ্বাসের কারনে নিশ্চিত পরকালের অবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে একটা অশান্তি কাজ করে। কিন্তু বৈষয়িক জীবনের প্রতি মায়াভরা টানের কারনে এই পরকালটা অনেকসময় ঝামেলার মনে হয়। কেনইবা এই পরকালটা থাকতে হলো? এটা না হলে কি প্রভুর চলতোনা! নির্ধিধায় এই ইহকালটা কাটিয়ে দেয়া যেতো। তবে এসব চিন্তা করলে নিজের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করে বৈকি। যেভাবে দিনক্ষণ পার করে যাচ্ছি পরকালের ফয়সালা কি হবে তাতো জানাই আছে। যেমন কর্ম তেমন ফল। পুরস্কার হিসেবে পরকাল আরাম-আয়েশে কাটাতে এই বৈষয়িক জীবন কেমন হওয়ার ছিল আর পুরস্কার হিসেবে শাস্তি-কষ্টে কাটাতে এই জীবন কেমন চলছে ভাবতেই আবার পীড়াদায়ক অশান্তি, চাপা উত্তেজনা।
তাইতো কিছু লোক এসব মাথা ব্যাথা না নিয়ে ধর্মটাই বিশ্বাস করা বাদ দিয়েছে। আহা কি আনন্দ, কতোইনা শান্তি। কখন কি হবে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই। পাদ্রী কিংবা মাওলানা কিংবা ধর্মগুরুর পিছে পিছেও ঘুরতে হলোনা, কারো কাছে কোন দায়বদ্ধতাও নেই। তবে সৃষ্টির একটা উৎপত্তির ব্যাপারে তাদের হালকা মাথা ব্যাথা আছে| এতগুলো ধর্মের মাঝে তারাও একটা নির্দেশনা খুঁজে ফিরে। হয়তো কেউ একজন আছে এসবের পেছনে। এসব বস্তুবাদীরা, মানে ধর্মহীন যারা তারা হয়তো ভাবছে, ওই পরকালে বিচার-ফয়সালার মাঝামাঝি কিছু একটা থাকতে পারে! আসলে কি তাই?
চলুন দেখি স্বর্গের টিকেট কিভাবে জোগাড় করা যায়! মানে পরকালের অন্তহীন জীবনে পরমানন্দে কাটানো আরকি। অরে! টিকেটতো কখনো বিনা মাশুলে বা ফ্রি পাওয়ার জিনিস নয়; এখন উপায় কি? আচ্ছা কোন পাদ্রী বা মাওলানা কি ব্যবস্থা করে দিতে পারেনা? ধুর! তাদেরও নাকি এই টিকেট পেতে দুর্দশা হয়, আমাদের কখন জোগাড় করে দিবে!
তবে? প্রবাদে আছে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।
পরকালে ওই বিচার ফয়সালার দিনে সবাই নিজের গন্তব্য কি হবে তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকবে। কারণ একান্তই যারা ধর্মের অবাধ্যতায় জীবন পরিচালনা করবে পরকালে বিচারের দিন তাদের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়টিও ধর্মীয় শিক্ষায় তারা জানে। কিন্তু যারা শর্ত পালন করেছে? এবং তাতে বৈষয়িক জীবনকে বিসর্জন দিয়েছে ? তাদের জন্য কি পুরস্কার ?
আসুন, একটা গল্প (বাস্তব ঘটনা) দিয়েই শেষ করি- নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে এক সাহাবী (সমাজের সর্বোচ স্তরের ব্যক্তি) হঠাৎ করে একটি দোকান খুললেন এবং কিছুদিন পর আবার বন্ধও করে দিলেন। লোকজনের জিজ্ঞাসা, এ কেমন ব্যাপার হলো ? এতো অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসা দাঁড় করলো আবার কিছুদিনেই বন্ধ করে দিলো! এ কয়দিনে কিইবা লাভ হলো! মালামালতো সব দোকানেই রয়ে গেল। তখন দোকানি উত্তর দিলেন, আমি এই দোকানের মাধ্যমে যে লাভ করেছি, তা তোমরা সারাজীবন ব্যবসা করেও পাবে কিনা আমি সন্দেহ করি। কারণ, আমি এই দোকানে অর্থকড়ি বিনিয়োগ করে আমার জন্য বেহেশত আবশ্যিক করে নিয়েছি, বাধ্যতামূলক করে নিয়েছি (ওয়াজিব)। আমি আমার ব্যবসায় এত অর্থ বিনিয়োগ করেছি যেন প্রয়োজনে সারা জীবন এই ব্যবসায় থাকা যায়। কিন্তু আল্লাহ কিছুদিনের মধ্যেই আমার চাওয়া পূরণ করে দেন। আমার এত বিনিয়োগ সার্থক। আমি পণ্য বিক্রি করতে থাকি আর অপেক্ষায় থাকি পণ্য নিয়ে কোন ক্রেতা অভিযোগ নিয়ে আসে কিনা। অবশেষে একদিন সেই সুসময় আসে। এক ব্যক্তি আমার দোকান হতে ক্রয়কৃত পণ্য কোন কারণ ছাড়াই ফেরৎ দিতে আসলো। আমি সানন্দে পণ্য ফেরৎ নিলাম এবং পণ্য ক্রয়ের সময় যে পরিমান অর্থ ক্রেতা আমাকে দিয়েছিল সে পরিমান অর্থ ক্রেতাকে ফেরৎ দিলাম। ক্রেতা খুশি হয়ে দোকান ত্যাগ করলো, আর আমার জন্য বেহেস্ত স্বর্গ নিশ্চিত করে ব্যবসা (দোকান) বন্ধ করে দিলাম। ওই ব্যক্তিই ছিল আমার দোকানের জন্য শেষ ক্রেতা।
প্রশ্নকর্তারা অবাক হয়ে জানতে চাইলো এই দাবির সত্যতা কি? তখন দোকানি বললেন, নবীজি স. হতে আমি জেনেছি (হাদিসের ভাষা / কথা ভিন্নরকম হতে পারে) যে ব্যক্তি (বিক্রেতা) ক্রেতার নিকট হতে পণ্য ফেরত নিবে এবং গৃহীত অর্থ ক্রেতাকে ফেরৎ দিবে, তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে যাবে। লোকসকল দোকানির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আর দোকানির চোখে-মুখে সন্তুষ্টির হাসি। এই দোকানদার আর কেউ নন, নবীজির বন্ধু, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রদ্বিয়াল্লাহু আনহু যার জন্য বেহেশত অপেক্ষায় থাকার কথা কিন্তু তিনি এই বৈষয়িক জীবনকে কতইনা অনিশ্চিত দেখেছেন আর বেহেশ্ত নিশ্চিত করার জন্য এত সাধনা করলেন।
তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপাসনায়, ভালো কাজে ব্যয় করে স্বর্গ – বেহেস্তের আশা করলেই চলবেনা, আমাদের জানা প্রয়োজন কোন কর্মফল আমার জন্য স্বর্গ নিশ্চিৎ করবে। “যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিল, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি।” (সুরা নিসা – ৮০) আপনি আপনার মতো করে ধর্ম পালন করলেই চলবেনা বরং তা প্রবাহিত হতে হবে নবীজি স. ও আল্লাহর পক্ষ হতে।
আল্লাহ সবার রোজা ও রমজানের আমল কবুল করুন। আমিন
লেখক: কানাডা প্রবাসী, লেখক, সামাজিক সংগঠক ও ইসলামি চিন্তাবিদ