সীরাতুন্নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আজকের মুসলিম উম্মাহ

ইসলামী ডেস্ক: ইদানীং ১২ রবিউল আওয়াল একটি আনন্দ-উৎসবের দিবসে রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর রবিউল আওয়াল মাস এলেই সমগ্র দেশজুড়ে শুরু হয় সিরাতুন্নবী ও মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠানের ধুম। এ কথা অনস্বীকার্য যে, নবীজীবনের পবিত্র আলোচনা মহা সৌভগ্যের বিষয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকের মুসলিম সমাজে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতপূর্ণ আলোচনাকে কেবল রবিউল আওয়াল মাস, বরং শুধুই ১২ রবিউল আওয়ালের ফ্রেমে ফ্রেমবন্দি করে দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে যুক্তি দাঁড় করানো হয় যে, মহনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন ১২ রবিউল আওয়াল। তাই এই দিবসটিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মদিবস হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে হবে এবং সীরাতুন্নবীর অনুষ্ঠানে তাঁর আলোচনা করতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এগুলো করার সময় আমরা ভুলে যাই, যে-মহাপুরুষের জীবনী আলোচনা করা হচ্ছে, যে-মহামানবের জন্মদিবস পালন করা হচ্ছে এবং যে-দিবসটিকে ঈদের দিবস বানানো হয়েছে, এ ব্যাপারে তাঁর শিক্ষা কি এবং তাঁর শিক্ষায় এ জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোন ধারণা আছে কি-না? এ ধূলির ধরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমন নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল ও শ্রেষ্ঠ ঘটনা। এমন বিরল, শ্রেষ্ঠ, কল্যাণকর, বরকতময় ও পবিত্র ঘটনা পৃথিবীতে আর ঘটেনি। তার আগমনে জিন ও ইনসান লাভ করেছে তাঁর পবিত্র ও কল্যাণকর শিক্ষার আলো। ধন্য হয়েছে পরশপাথরতুল্য তাঁর পবিত্র সাহচর্য লাভে। যার ফলে পৃথিবী হয়েছে কালিমামুক্ত। জিন ও ইনসান লাভ করেছে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির সনদ। তাই দ্বীনে ইসলামে যদি জন্মদিবস পালনের কোন অস্তিত্ব বা ধারণা থাকত, তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকত ও কল্যাণে পরিপুষ্ট জন্মদিবস পালন করার ও ঈদ হিসেবে গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হত। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। এই ২৩ বছরের প্রতি বছরই ১২ রবিউল আওয়ালের আগমন ঘটত। কিন্তু ১২ রবিউল আওয়ালে কোনদিন তিনি জন্মদিবস পালন করেননি। এমনকি তাঁর ইশারায় প্রাণ উৎসর্গকারী লক্ষাধিক সাহাবীর একজনেরও হৃদয়জগতে এ ভাবনার উদয় হয়নি যে, ১২ রবিউল আওয়াল প্রাণের নবীর জন্মদিন। তাই মহাধুমধামে উৎসব করে তা উদযাপন করতে হবে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহলোক ছেড়ে গেলেন। রেখে গেলেন প্রায় সোয়া লাখ সাহাবীর এক বিশাল জামাত। তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন প্রাণের নবীর প্রতিটি নিঃশ্বাসের বিনিময়ে পুরো জীবন বিলীন করতে। তাঁরা ছিলেন নবীপ্রেমে এমন দেওয়ানা যার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এতদসত্তেও একজন সাহাবীও এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি এই দিবসটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালন করেছেন কিংবা এই দিবস উপলক্ষে কোন সীরাতুন্নবী বা মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহফিল কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। [আশশিরআতুল ইলাহিয়া : ২৫৩; রাহে সুন্নাত : ২৫৩; ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩০৬]  প্রশ্ন জাগে, সাহাবায়ে কিরাম এই দিবস উপলক্ষে এমন আয়োজন কেন করলেন না? এই জন্যই করলেন না যে, ইসলাম কোন প্রথা বা রুসুমসর্বস্ব ধর্ম নয়। যেমনটি অন্যান্য ধর্মের অবস্থা। অন্যান্য ধর্মগুলো কেবল রুসুম-রেওয়াজ ও প্রথা-পার্বণসর্বস্ব। প্রথা-পার্বণগুলো পালন করলেই মুক্তি। পক্ষান্তরে ইসলাম হলো আমলের ধর্ম। এতে রয়েছে মানবের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের মূলকথা হলো, তার অনুসারীরা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নিজের ইসলাহের চিন্তায় থাকবে মশগুল এবং অনুসরণ করবে মানবতার মুক্তির দিশারী বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উসওয়ায়ে হাসানা বা উত্তম আদর্শ। 

কিন্তু এরপরও দেখুন, ১২ রবিউল আওয়াল এলেই কিভাবে ঝুলানো হয় কাবা শরীফ ও রওজা মুবারকের ছবি। মানুষ কিভাবে এগুলোকে তাওয়াফ করে ? মসজিদ-মাজারে কিভাবে আলোকসজ্জা করা হয়? কিভাবে সাজানো হয় পতাকা দিয়ে ? হয় ভিডিও ও রেকর্ডিং। এতে সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হলো, এগুলো হচ্ছে দীনের নামে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে। এ সব করা হচ্ছে এই ভেবে যে, এগুলো বড় পুণ্যের কাজ। মুসলিম উম্মাহ ভাবছে, এগুলো করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসার হক আদায় করছি। যদি এ শ্রেণীর লোকদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনি কি শরীয়ত মুতাবিক চলেন? তাহলে তারা অকপটে বলে দেবেন, আমরা মিলাদ পড়ি। নবীজীর জন্মদিবস পালন করি। এভাবে কি শরীয়তের হক আদায় হচ্ছে না ? অথচ শাশ^ত সত্য হলো, এটি দীনে ইসলামের তরিকা নয়। নয় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তরিকা। নয় মহান সাহাবা জামাতের তরিকা বা আদর্শ। এটি যদি কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ কাজই হতো, তাহলে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রা. প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম এ কাজ ছাড়ার মত মুসলমান ছিলেন না। এ ব্যাপারে মুফতী শফী রহ. প্রায়ই একটি প্রবাদ বাক্য বলতেন। প্রবাদ বাক্যটি হলো,  ‘যে ব্যক্তি ব্যবসায় নিজেকে বেনিয়ার চেয়ে চালাক ও চৌকস মনে করে সে পাগল ছাড়া কিছুই নয়।’ কারণ ব্যবসায় বেনিয়ার চেয়ে চালাক কেউ হতে পারে না। এই প্রবাদ বলার পর তিনি বলতেন, শোনো তোমরা! যদি কোন মুসলমান ভাবে যে, আমি সাহাবায়ে কিরামের চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বেশি ভালবাসি এবং দাবি করে যে, সে মহান সহাবা জামাতের চেয়েও বড় আশিকে রাসূল, তাহলে বুঝে নিতে হবে, এই লোকটি পাগল ছাড়া কিছুই নয়। মহান সাহাবা জামাতের চেয়েও বড় আশিকে রাসূল কেউ হতে পারে না। তাঁদের অবস্থা এই ছিল যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনাদর্শ তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিশে ছিল। মিশে ছিল প্রতিটি কদমে, প্রতিটি নিঃশ^াসে। তাদের জীবনের প্রতিটিদিন ছিল সীরাতে তায়্যিবার দিন। প্রতিটি ক্ষণ ছিল সীরাতে তায়্যিবার ক্ষণ। প্রতিটি কাজে ছিল পবিত্র সীরাতের অনুসরণ। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পবিত্র সীরাতের প্রভাববলয়ে। [ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩০৮-৯] এই মাটির পৃথিবীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনের উদ্দেশ্য কি ছিল সাহাবাগণের এই মহান জামাত তা খুব ভালভাবেই জানতেন ও বুঝতেন। তাঁদের এ কথা খুব ভাল করেই জানা ছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনের উদ্দেশ্য এই নয় যে, তিনি উম্মাহকে নিজের জন্মদিন পালন কিংবা প্রশংসা করার শিক্ষা দিবেন। মক্কার কাফের সম্প্রদায় তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিল, আপনি কি চান বলুন, আমরা আপনার সকল চাওয়া পূর্ণ করতে রাজি আছি। আপনি যদি মক্কা নগরীর সরদার হতে চান, আমরা আপনাকে সরদার বানাতে প্রস্তুত আছি। যদি বিপুল সম্পদের আকাক্সক্ষা থাকে, তাহলে আপনার পদতলে সম্পদের স্তূপ ঢেলে দিব। যদি রূপসী রমণীর কামনা থাকে, তাহলে আরবের সেরা রূপসীকে আপনার চরণতলে উৎসর্গ করে দিব। বিনিময়ে কেবল আপনি আপনার নতুন ধর্মের প্রতি দাওয়াতি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন। তো চিন্তা করুন, এ সকল বস্তু যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্য হত, তাহলে এ সকল লোভনীয় প্রস্তাব তিনি বিনাবাক্যে কবুল করে নিতেন। কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন কি? দৃপ্তকণ্ঠে তিনি তাদের জানিয়ে দিলেন, তোমরা যদি আমার এক হাতে চাঁদ এনে দাও, অপর হাতে সূর্য; তবুও আমি আমার মিশন হতে এক চুল পরিমাণও সড়ে দাঁড়াবো না। [সীরাতে মুস্তফা : ১/১৮১-১৮২; ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩০৮-৯] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এই ধূলির ধরাতে এই উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন যে, মানুষ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করবে? না, কক্ষনো না। তো তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য কি ছিল ? সে কথা মহামহীম আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ সেই ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে।’ [সূরা আহযাব : ২১] আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, “রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর। আর (যেন রাখ) নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠিন শাস্তিদাতা’। [সূরা হাশর : ৮] তো আল্লাহ তাআলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন যে, তাঁর শিক্ষার আলো আল-কুরআনের বাস্তবমুখী ব্যাখ্যা প্রদান করবে। তিনি মানুষকে শিক্ষা দেবেন হাতে কলমে। মানুষের সামনে আমলী নমুনা পেশ করে দেখাবেন যে, কুরআনের উপর আমল করতে হবে এভাবে। তিনি ছিলেন মানবজীবনের সকল অঙ্গনের পূর্ণাঙ্গ নমুনা। এমন নমুনা যার নজীর পেশ করতে পৃথিবী অক্ষম। আপনি যদি কোন কন্যার জনক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি দেখুন, ফাতেমাদের জনক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিতা হিসাবে কী আচরণ করতেন। আর যদি হয়ে থাকেন কোন নারীর স্বামী, তাহলে দেখুন, খাদিজা ও আয়শাদের স্বামী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বামী হিসাবে কী কী কাজ করতেন। আর যদি হয়ে থাকেন কোন রাষ্ট্রের শাসক, তাহলে দেখুন, মদীনার শাসক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। আর যদি হয়ে থাকেন ব্যবসায়ী, তাহলে দেখুন, সিরিয়ার ব্যবসায় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। এক কথায় মানবজীবনের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যক্তিসত্তা উত্তম নমুনা হিসাবে উপস্থাপিত হয়নি। আপনারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামের এই নমুনাটিকে দেখুন এবং তাঁর অুনসরণ করুন। তাঁকে এ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যেই ধূলির ধরায় আল্লাহ পাঠিয়েছেন। তাঁকে এই উদ্দেশ্যে পাঠাননি যে, তাঁর জন্মদিন পালন করা হবে মহাধুমধামে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বের করা হবে শোভাযাত্রা। আয়োজন করা হবে জমকালো মিলাদ মাহফিলের। তাঁর জন্মদিবসে উদযাপন করা হবে ঈদে মিলাদুন্নবী। বরং আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, তাঁর হাতে গড়া মহান কাফেলাটি যেভাবে তাঁর আনুগত্য করে দেখিয়েছেন, ঠিক সেভাবে পরবর্তী উম্মতও তাঁর আনুগত্য করবে। [ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩১২-৩১৩]

সাহাবায়ে কিরাম রা. আনুগত্যের এমন নজীর স্থাপন করে গেছেন যার নজীর মানবেতিহাসে নেই। তাঁরা সর্বদায় এই ভাবনায় বিভোর থাকতেন, কিভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করব। কি করলে তিনি খুশি হবেন। সাহাবাগণের মহান এই জামাত এমনিতেই ‘সাহাবা’ হয়ে যাননি। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা শুনুন। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ করলেন যে, কিছুলোক মসজিদের আশ-পাশে দাড়িয়ে আছে। যেমনটি বর্তমানেও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেখা যায় যে, সমাবেশ চলাকালে কিছু কিছু মানুষ মাহফিলের আশ পাশে দাড়িয়ে থাকে। তো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন যে, লোকগুলো বসছেও না আবার সরেও যাচ্ছে না। অথচ এটি মজলিসের আদবের খিলাফ। কারণ মজলিসের আদব হলো, হয়তো মাহফিলের ভিতর বসে যাবে অন্যথায় চলে যাবে। কারণ এমন হলে আলোচকের জেহান এলোমেলো হয়ে যায়। শ্রোতারাও মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ানো লোকদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা বসে পড়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই আদেশ দিলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা তখনো রাস্তায় ছিলেন। মসজিদে নববীর দিকে আসছিলেন। এখনো মসজিদে প্রবেশ করেননি। এমন সময় হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন ‘তোমরা বসে পড়’। শোনামাত্র তিনি সেখানেই বসে পড়লেন। বয়ান শেষে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাস করলেন, তুমি রাস্তায় বসে পড়লে কেন? বসার আদেশ তো আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম যারা মসজিদের আশপাশে দাঁড়ানো ছিল। আমি তো রাস্তার লোকদেরকে বসতে বলিনি। জবাবে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, আল্লাহর রাসূলের আদেশ ‘তোমরা বসে পড়’ কানে প্রবেশের পর মাসউদের বেটা আব্দুল্লাহর সাহস ছিল না এক কদম সামনে অগ্রসর হওয়ার। পাঠক! এই ছিল সাহাবাগণের আনুগত্যের অবস্থা। তাঁর এমনিতেই ‘সাহাবা’ হয়ে যাননি। মুহাব্বতের দাবিদার তো অনেকেই আছে। আশেকে রাসূলের দাবিদারেরও অভাব নেই। কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের মত প্রকৃত আশেকে রাসূল বা রাসূল প্রেমিক কয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে? [ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩১৪]

এ ব্যাপারে আরো একটি ঘটনা শুনুন। হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা.। ইরান জয়ের সিপাহসালার। পারস্য সম্রাট কিসরার উপর আক্রমণের জন্য পারস্যে উপস্থিত হলেন। সংবাদ পেয়ে আলোচনার জন্য সম্রাট তাঁকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি দরবারে উপস্থিত হলেন। আপ্যায়নের ব্যবস্থা হলো। আহার শুরু করলেন। আহারের সময় একটি লোকমা তাঁর হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষা হলো, কোন খাবার পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খেয়ে ফেলা। কোন ময়লা লাগলে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে খেয়ে ফেল। অবজ্ঞা করে ফেলে দিও না। তো তখন হুযায়ফা রা.-এর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। তাই তিনি পড়ে যাওয়া খাবারটুকু তুলার জন্য হাত বাড়ালেন। তাঁর সোজা সামনে তাঁর একজন সঙ্গী বসা ছিলেন। তিনি চোখের ইশারায় তাঁকে বললেন, আপনি একি করছেন? এটি পরাশক্তি কিসরার দরবার। পড়ে যাওয়া খাবার উঠিয়ে খেলে এদের কাছে আপনার সম্মান ও মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হবে। এরা ভাববে আপনি একজন কাঙ্গাল মানুষ। এমন মজাদার খাবার কখনো দু-চোখে দেখেননি। তাই আজকের মত এই সুন্নাতটি পালন থেকে বিরত থাকুন। এটি পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়ার সুন্নাত আদায়ের পরিবেশ নয়। এ কথার জবাবে হযরত হুযায়ফা রা. যে উত্তর দিয়েছিলেন, বিশ^বাসী তা স্মরণ রাখবে। দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি কি এ সকল নির্বোধদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত ছেড়ে দেব।’ এরা যে যাই ভাবুক, যে যাই বলুক, আমি আমার হাবীবের সুন্নাত ছাড়তে পারব না। [ইসলাহী খুতুবাত : ২/৩১৬-৩১৭]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মদিন পালনের ক্ষেত্রে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ১২ই রবিউল আওয়াল ইন্তিকাল করেছেন এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। সকলেই এ ব্যাপারে একমত। কিন্তু জন্ম তারিখের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি মত পাওয়া যায়। ৮ই রবিউল আওয়াল, ৯ই রবিউল আওয়াল, ১২ই রবিউল আওয়াল। এর মধ্যে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, তিনি ৮ই রবিউল আওয়াল জন্ম গ্রহণ করেছেন। [যুরকানী :১/১৩১; সীরাতে মুস্তফা: ১/৫৯; ইখতিলাফে উম্মত আওর সীরাতে মুস্তাকিম : ৯০-১২৯ কিফায়াতুল মুফতী : ১/১৪৫; ওফাতুল আয়ান : ৪/১১৭] তো দেড় হাজার বছর পর আজকে যারা ১২ই রবিউল আওয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুদিবস নিশ্চিত জেনেও এ দিন উৎসব আর আনন্দে মেতে ওঠে তারা কি আশিকে রাসূল, নাকি দুশমনে রাসূল, এই সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিলাম বিজ্ঞ পাঠকের উপর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১২ই রবিউল আওয়াল জন্ম গ্রহণ করেছেন, তর্কের খাতিরে এ কথা মানতে আপত্তি না থাকলেও বিপত্তি হলো ১২ই রবিউল আওয়াল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুদিবস এটা সুনিশ্চিত। এ ব্যাপারে কোনই মতভেদ নেই। কাজেই এ দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মসুখে উল্লাস করবেন, নাকি মৃত্যুশোকে মাতম করবেন, তার সিদ্ধান্ত নিবেন এ দিনে ঈদের উৎসবকারীগণ। উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আপনি বলেছেন, নবীর সুন্নাত পরিত্যাগ করলে অপদস্থ হতে হয়, নেমে আসে লাঞ্ছনা। অথচ আমরা দেখছি, অমুসলিম সম্প্রদায় এবং আমেরিকান ও ইউরোপীয় দেশগুলো সুন্নাত বর্জন করেছে। তা সত্তেও তাদের উন্নতি ও মর্যাদার পাগলা ঘোড়া এগিয়ে চলছে। এমন হলো কেন? এর উত্তর হলো, আমরা হলাম মুসলমান। পড়েছি কালিমা। গ্রহণ করেছি ইসলাম। তাই যতক্ষণ না আমরা মুসলিম উম্মাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরণ তলে লুটিয়ে পড়বো এবং তাঁর সুন্নাত মজবুতভাবে ধরবো, ততক্ষণ আমরা মার খেতেই থাকব। অপদস্থ হতেই থাকব। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে কেবল দুনিয়া। পরকালে তাদের নেই কোন হিসসা। তাই এই জগতে তারা মর্যাদা পাবে। আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করেই। চৌদ্দশ বছরের ইতিহাস উল্টিয়ে দেখুন, মুসলিম জাতি যতদিন তাদের নবীর সুন্নাত আঁকড়ে ধরেছে মজবুতভাবে আর আমল করেছে তার উপর, ততদিন তারা পেয়েছে মর্যাদা, সাধন করেছে বিস্ময়কর উন্নতি। লাভ করেছে অর্ধজাহানের রাজক্ষমতা। কিন্তু যখন সুন্নাতের আমল ছেড়ে দিয়েছে। আঁকড়ে ধরেছে বিজাতীয় সংস্কার, তখনই শুরু হয়েছে তাদের অধঃপতন। বিশ্ব দেখেছে মুসলিম জাতির কী করুণ পরিণতি হয়েছে। তাই পরিশেষে বলব, অবগত হোন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক একটি সুন্নাত সম্পর্কে এবং তা প্রয়োগ করুন বাস্তব জীবনে। দেখবেন, ইনশাআল্লাহ সুন্নাতের কী পরিমাণ বরকত হাছিল হচ্ছে। ফলে আপনার প্রতিটি দিবস হয়ে যাবে সীরাতুন্নবীর দিবস। প্রতিটি মুহূর্তই হয়ে উঠবে সীরাতুন্নবীর মুহূর্ত। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সীরাতুন্নবী ও সুন্নাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর যথাযথ আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

গ্রন্থ প্রণেতা, ধর্মীয় গবেষক ও মুহাদ্দিস

জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *