BanshkhaliTimes

সালসাবিলা নকির গল্প || ভণ্ড

BanshkhaliTimes

ভণ্ড
সালসাবিলা নকি

এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড় খেয়ে মেঝেতে পড়ে আছে নীলা। কানে ও মাথায় ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে। সাইফুলের হাত এতোটা ভারী জানা ছিল না তার। অথচ সে এই হাতটাই ধরে বসে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন তো সে সুখস্বপ্নে বিভোর ছিল। আজ মারগুলো পড়েছে বলেই সাইফুলের হাতের জোর বুঝতে পেরেছে। সেই সাথে বিয়ের আগে চারবছর ধরে দেখা সুখস্বপ্ন আজ কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে গেছে। বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়ে আছে নীলা, অবশেষে সেও স্বামীর হাতে মার খেয়েছে!

বাবা যখন মাকে মারতো ভয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতো সে। ইচ্ছে করতো গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু মা তাকে ইশারা করতো সামনে থেকে চলে যেতে। এরপর মারের শব্দ আরও জোরালো হতো। বুঝতে শেখার পর থেকে তার নানুমনি ও নানাভাইয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ হতো। কেন বাবার সাথেই তার মাকে বিয়ে দিল? একটু দেখেশুনে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারতো না তারা! তাদের কারণেই মা এতো কষ্ট ভোগ করছে।

সেই ছোটবেলা থেকেই নীলা ঠিক করেছিল, বিয়ে করলে নিজেই দেখেশুনেই বিয়ে করবে। যেন মায়ের মতো নীরবে স্বামীর অত্যাচার সয়ে যেতে না হয়।

সাইফুলকে পুরো দুইবছর ধরে দেখে এসেছিল নীলা। তিনবছরের মাথায় প্রেম শুরু। আর চারবছর পেরোতেই পালিয়ে বিয়ে। বাবা-মা রাজি না হলেও সে ভাবতো, মায়ের মতো মার খেয়ে খেয়ে তো আর জীবন কাটাতে হবে না। সাইফুল খুব ভালো ছেলে। অত্যন্ত নম্র-ভদ্র ও মার্জিত আচরণের অধিকারী হিসেবেই সে ভার্সিটিতে পরিচিত ছিল।

কিন্তু আজ, একটু আগেই সেসব মিথ্যে হয়ে গেল। নীলার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নিজের পছন্দে বিয়ে করেও স্বামীর হাতের মার কপালে জুটল তার! তাহলে কি তার মায়ের জীবনের মতই হবে তার জীবনটা!

পিঠে সাইফুলের হাতের ছোঁয়া পেয়ে একটু কেঁপে উঠল সে। ইচ্ছে করেই ঘুরে তাকালো না। সাইফুলকে এখন ভীষণ পর মনে হচ্ছে। যেন অনেক দূরের কেউ। যার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। বিয়ের তিনমাসেই এতো পরিচিত মানুষটা বদলে গেল! নাকি সবটাই ছিল নীলার ভুল!

সাইফুল সামনে এসে নীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আর বলতে লাগল,
-বেশি লেগেছে? তোমাকে মারার ইচ্ছে ছিল না। মুখে মুখে তর্ক করছিলে কেন? আর কখনও আমার মুখের ওপর জবাব দিবে না, কেমন? খুব ভালোবাসি জান।

নীলা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। সে নাকি তর্ক করেছে! বাসায় এসে সাইফুল প্রথমেই জানতে চেয়েছিল, “ছাদে কেন গিয়েছিলে?”

সাইফুল একটু অস্থির স্বভাবের। কিন্তু ছাদে যাওয়ার কথা এতো রেগে জিজ্ঞেস করছে কেন সে বুঝতে পারেনি। সে ভীষণ অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল,
“ওমা! এমনিই ছাদে গিয়েছি? কেন, কী হয়েছে?”

সাথে সাথেই সাইফুলের প্রকাণ্ড চড়টা উড়ে এসে বসলো তার ডান গালে। আর মুখে অশ্রাব্য ভাষার বন্যা।
“ব্যাডা দেখতে গেসিলি বল না মা*, রঙ দেখাইতে গেসিলি। আমি বাসায় না থাকলে এইসব করে বেড়াস…

তাহলে নীলার জবাবটাই এতো কিছুর মূলে!

রাতে সাইফুল একপ্রকার জোর করেই ঘনিষ্ঠ হলো। তার মতে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কতকিছু ঘটে। এসব ভুলে যাওয়ার উপায় হচ্ছে একমাত্র এটাই। নীলা শোকে নাকি ঘৃণায় কে জানে, পুরোটা সময় নিস্তেজ হয়ে ছিল। নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়ে গেছে সাইফুল। কিন্তু নীলা পুরো রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

পরদিন খুব বেলা করেই ঘুম ভাঙে সাইফুলের। নীলাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু তার কোন সাড়া পাওয়া যায় না। বিছানা ছেড়ে পুরো ঘরে খুঁজে দেখে। কোথাও সে নেই। ডাইনিং টেবিলে গ্লাসের নিচে চাপা দেয়া একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পায় সাইফুল। সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করে…
“আমি যে পরিবারের মেয়ে সে পরিবার প্রেম-ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেবে না কখনও। এটা জেনেও তোমার সাথে প্রেম করেছি। কারণটাও তোমাকে বলেছিলাম, ‘আমার মা কখনও সুখ পায়নি। আমি সুখী হতে চাই।’ কিন্তু সুখ পাওয়া যেমন নিজের চেষ্টার ওপর নির্ভর করে তেমনই এর সাথে ভাগ্যের ব্যাপারও জড়িত। আমার চেষ্টা বিফলে গেছে, এখন ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলাম। নিজের যোগ্যতায় নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচব। কিন্তু তোমার সাথে আর একদিনও নয়। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। স্ত্রীকে অসম্মান করে এমন লোকের সাথে সংসার করা আমার মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু আমার পক্ষে হবে না।”

চিঠিটা চুলোর আগুনে ছেড়ে দিল সাইফুল। এরপর তাতে চায়ের হাঁড়ি চাপালো। ঠান্ডা মাথায় দারুণ একটা পরিকল্পনা করল সে। নীলা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে সে মামলা করবে। বলবে, স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা নিয়ে তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে।

মেয়ের কারনে এমনিতেই তাদের কম সম্মানহানি হয়নি। এখন আবার নতুন করে স্বামীর সাথে প্রতারণার কথা ছড়ালে যেটুকু সম্মান তাদের আছে তা নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের এটাই একমাত্র মূল্যবান সম্পদ। তাই সম্মান বাঁচাতে তারা চাইবে সাইফুলের সাথে কম ক্ষতিতে মীমাংসা করে নিতে। পালিয়ে বিয়ে করাতে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছুই পায়নি। এই সুযোগে কিছু লাভ হবে তার। সাইফুলের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।

চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিল সে। এরপর চোখে-মুখে যথাসম্ভব শান্ত-শিষ্ট ভাব ফুটিয়ে থানার উদ্দ্যেশ্যে বের হয়ে গেল।

রাস্তায় সাইফুলের মতো আরও অনেক ভণ্ড চলাচল করে। যারা নিপাট ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে। নীলার মতো মেয়েরা, অথবা তার নানা-নানীর মতো অভিভাবকগণ এই মুখোশের আড়ালের ভণ্ডদের চিনতে পারে না। ফলশ্রুতিতে তাদের বয়ে বেড়াতে হয় এক অভিশপ্ত জীবন।

সমাপ্ত

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *