BanshkhaliTimes

সালসাবিলা নকির গল্প ‘ছোবল’ | শেষ পর্ব

প্রথম পর্বের পরর—

BanshkhaliTimes

ফাতিমা বাপের বাড়ি এসেছে বহুদিন পর। মেয়েরা নাইওর আসলে যত্ন-আত্তির শেষ থাকে না। ফাতিমার বেলাতেও সব সময় তেমনটা হয়ে থাকে। খাদিজা বেগম সবচেয়ে বড় নাদুসনুদুস মোরগটা জবাই করেন, পুকুরের বড় মাছ রান্না করে মাথাটা মেয়েকে খাওয়ান, মানুষ ঠিক করে গাছের কচি ডাবগুলো পাড়ান, সর উঠা গরুর দুধ দিয়ে পায়েশ রাঁধেন, পিঠাপুলি বানান, যা যা করা যায় সব করেন। কিন্তু এবার ফাতিমা লক্ষ করলো সবাই, সবকিছু কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। দূরন্ত আব্দুল্লাহ যে সারাক্ষণ ফুপি, ফুপি করে মাথা খেয়ে ফেলতো সেও কেমন অচেনা হয়ে গেছে। ভোরে মাদ্রাসায় যায়, দুপুরে এসে ভাত খেয়ে নদীপাড়ের চলে যায়, তারপর সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে আসে। মনমরা হয়ে বসে থাকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। আর শাহনূর তো তার গাই গরুটা নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চা হবে, তাই একটু বেশিই যত্ন নিতে হচ্ছে।

ফাতিমার মন উসখুশ করে। দু’দিন কেটে গেল। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। মাকে জিজ্ঞেস করতে মন চায় না। হয়তো ভাববে, বাপের বাড়ি আসলেই ওর আবদার বেড়ে যায়। ভাবিকে বলতেও কেমন সংকোচ হচ্ছে। সেদিন আব্দুল্লাহ দুপুরে খেয়ে বাইরে যাচ্ছে তখনই খপ করে ওর হাত ধরে মা আর ভাবীর চোখের আড়ালে নিয়ে যায়। তারপর আদর করে বলে, “কী রে আব্দুল্লাহ, আঁই আইস্যি দুই দিন অই গেইয়্যে তুই আঁর লই তো বালা গরি হতাও ন হর। কী অইয়্যে দে তুরার বেগ্গুনত্তুন?”

আব্দুল্লাহ উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফাতিমা অবাক হয়। এই একরত্তি একটা ছেলে সেও কেমন ভাবুক হতে জানে! ফাতিমা আবার চেষ্টা করলো কথা বলানোর, “আইচ্ছা, মামুন, বাবু ইতারা কেউ আরত নো আইয়্যেদে? তুর লই ন মাতে? হইজ্জা গইজ্জুস নেকি তুরা?”

প্রশ্নটা শুনে আব্দুল্লাহর ঠোঁট ফুলে উঠে, নাকটা লাল হয়ে যায়। পরক্ষণেই ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে, “ইতারার ঘর দইজ্যা ভাঙ্গি লইগেয়ই দে তুই ন জানো? ইতারা তো ফারত জাগা লইয়্যে। এডে ঘর বাইন্ধে। এহন এড়ে কেউ নাই ফু। আই এহন খেলিত ন ফারি। হাইল্যেগা মাদ্রাসাত যাই। আর এহন হনো বন্ধু নাই অ ফু। বেগ্গুন গেয়ই।” আব্দুল্লাহ ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ফাতিমা স্তব্ধ হয়ে গেছে কথাগুলো শুনে। এতকিছু হয়ে গেছে অথচ সে জানে না! জানার কথাও নয়। তার শ্বশুর বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া বাপের বাড়ির গ্রামের খবর শ্বশুরবাড়ির গ্রামের সীমানার কোন অলৌকিক কারণেই বোধহয় প্রবেশ করে না। নাহলে এতবড় ঘটনা সে কোনভাবেই পেল না কেন! হঠাৎ মনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় ফাতিমার। আব্দুল্লাহর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুর মুন্সি দাদার বাড়ি ঠিক আছে তো?”

ফুফির প্রশ্ন শুনে আব্দুল্লাহর এমন মুহূর্তেও হাসি পায়। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, “মুন্সি দাদার ভিডা তো বেগ্গুনর আগে গেইয়্যে। তুই এত বেকুব ক্যা!”

তাইতো! ফাতিমা এমন প্রশ্ন করলো কেন? মামুন আর বাবুদের বাড়ির আরও সামনেই তো মুন্সি কাকাদের বাড়ি। নদীভাঙনের কবলে সেটারই তো প্রথমে পড়ার কথা।

ফাতিমা হঠাৎ বলে উঠে, “তুই থিয়াই থাক। আঁই এহন আইর।” তারপর সে দৌঁড়ে ঘরের ভেতর যায়। দুপুরের খাবার খেয়ে তার মা আর ভাবি একটু বিছানায় গড়িয়ে নিচ্ছে। এই সুযোগে সে বোরখাটা গায়ে চাপিয়ে বের হয়ে যায়। আব্দুল্লাহর হাত ধরে বলে, “চল দইজ্যার ফারত যাই।” আব্দুল্লাহ খুশি মনেই রাজি হয়। এতদিন নদী পাড়ে একা একা বসে কতকিছু ভেবেছে। আজ তার মনের সব কথা ফুপিকে বলবে সে।

পথে যেতে যেতে পুরনো দিনের কত স্মৃতি মনে পড়ে যায় ফাতিমার। এই তো দশ বারো বছর আগের কথা। তখন সে আব্দুল্লাহর চেয়েও ছোট। ছয় কি সাত বছর বয়স। বুকে কিতাব জড়িয়ে ধরে এই পথেই হেঁটে মাদ্রাসায় যেত। পথের ধারেই ছিল মুন্সী কাকাদের বাড়ি। এ পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি ছিল ওটা। অনেক বড় উঠোন, চার-পাঁচটা আলাদা আলাদা ঘর নিয়ে পুরো ভিটে। ঘরগুলো আলাদা দেখতে মনে হলেও আলাদা না। একটার সাথে অন্যটার সংযোগ ছিল। রান্নাঘর ছিল মূল বাড়ি থেকে আলাদা। সেটাও প্রকাণ্ড ছিল। মুন্সী কাকারা চার ভাই। বাড়ির বৌ-ঝিরা উঠোনে কত কাজ করতো, গল্প করতো। কাজের লোক ছিল ছয় সাতজন। মানুষে ভরপুর বাড়িটা সবসময়ই গমগম করতো।

ফাতিমার বাড়িটা দেখতে খুব ভালো লাগতো। মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো সদর দরজার সামনে। ভেতরের মানুষগুলোর কাজ, কথা সব চুপচাপ দেখতো, শুনতো। বাড়ির মেয়ে মানুষরা আবার ফাতিমাকে খুব আদরও করতো। ভেতরে ডেকে নিয়ে এটা ওটা খেতে দিত। একবার খুব গরমের সময় ফাতিমাদের টিউবয়েল নষ্ট হয়ে যায়। পানি আনতে যেতে হবে মামুনদের বাড়িতে। কিন্তু ফাতিমা সেখানে না গিয়ে মুন্সী কাকাদের বাড়িতে চলে যায়। পানিও আনা হবে, ভেতরেও যাওয়া যাবে। সেবার পানি নেয়ার বাহানায় দু’তিনদিন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার সুযোগ হয় তার। এরপর যখন সে বড় হয়, অকারণে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়, তখন আর মুন্সী কাকাদের বাড়ি যাওয়া হয় না তার। ঠিক তখন থেকেই মনে মনে অসম্ভব একটা অভিলাষ জাগে, মুন্সী কাকাদের বাড়িতে যদি চিরদিনের জন্য যাওয়া যেত! যদি তাদের ঘরেরই একজন সদস্য হতে পারতো সে!

“অ ফু, এড়ে হড়ে যন দে? সামনে আর যাইবার রাস্তা নাই তো।” আব্দুল্লাহর ডাকে পুরনো দিনগুলো থেকে ফিরে আসে ফাতিমা। অবাক হয়ে দেখে, তারা নদীর পাড়ে এসে গেছে। পায়ের নিচে কাঁদামাটি, সামনে অথৈ জলরাশি। এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছে ওরা! আগে তাদের বাড়ি থেকে মুন্সী কাকাদের বাড়ি যেতে সময় লাগতো প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট। এখন তো পাঁচ মিনিটের মতও লাগেনি। ঘর থেকে বের হলো, আর সাথে সাথেই নদীর পাড়ে এসে পৌঁছল। এটা কী করে সম্ভব! চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ফাতিমা। তার হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে আব্দুল্লাহ বুঝতে পারে তার ফুপি এই কুল কিনারাহীন পানির মধ্যে পরিচিত জায়গা খুঁজছে। সে ফুপিকে বলে, “তুঁই এড়ে কিছু ন বুঝিবা। হননানদি বাবুরও ঘর, হননানদি মুন্সী দাদার ঘর কিচ্ছু ঠাঁর ন ফাইবা। বেগ্গিন এহন এক্কো সমান অই গেয়ই।”

ফাতিমার মনের ভেতর তখন অন্যকিছু চলছে। তার বিয়ে যখন ঠিক হয় দূরের একগ্রামে তখন সে খুব কেঁদেছিল। বিয়ের আগের রাতে সে স্বপ্নে দেখেছিল মুন্সী কাকাদের ভিটের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেখানে তাদের ঘরের কোন চিহ্নই নেই। পায়ের নিচে কাঁদামাটি আর সামনে যদ্দুর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সেদিন সে স্বপ্নটার অর্থ বুঝতে পারেনি। আজ মনে হয় বুঝতে পারছে। যে ঘরের চাকচিক্য দেখে সে ঐ ঘরের সদস্য হওয়ার বাসনা করেছিল, অন্যত্র বিয়ে ঠিক হওয়াতে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল, সে ঘরখানা আল্লাহ পানির নিচে তলিয়ে দিয়েছেন। স্বপ্নটা দেখিয়ে আল্লাহ সেদিন অশান্ত মনের ফাতিমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন আল্লাহ চাইলে প্রাসাদকেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন। সেদিন মুন্সীবাড়ির সদস্য হতে না পেরে যে ফাতিমা দুঃখ পেয়েছিল, আজ সে ফাতিমাই নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়া মুন্সীবাড়ির কথা ভেবে শান্তি পাচ্ছে। অদ্ভুদ আল্লাহর ইচ্ছে, তেমনি অদ্ভুত মানুষের মন।

বুক ভরে নদীতীরের শীতল বাতাস নিল ফাতিমা। তারপর আব্দুল্লাহর হাত ধরে ফেরার পথ ধরল। তখন হঠাৎ কী মনে হতে পেছন ফিরে আবার তাকালো নদীর দিকে। তখনই তার মনে হলো, শৈশব থেকে সে যে শান্ত, সুন্দর, বহমান শঙ্খ নদী দেখে এসেছে, এটা সেই শঙ্খ নদী না। প্রমত্তা শঙ্খ নদীকে দেখে ফাতিমার মনে হচ্ছে, কোন সর্বনাশী ডাইনি তুমুল বেগে ধেয়ে আসছে তীরের দিকে। ভয়ংকর আঘাতে সে লন্ডভন্ড করে দিবে শত শত মানুষের সাজানো সংসার।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *