সবুজ কবির: শুদ্ধ চিন্তার ক্ষণজন্মা লেখক || রায়হান আজাদ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আল কুরআনে ইরশাদ করেন “যখন তাদের মৃত্যুর সময় হয় তখন তারা এক মুহুর্তকাল অগ্রবর্তী কিংবা পশ্চাতবর্তী হতে পারে না”। জীবনের গতি চলছে। এ গতি আমাদেরকে বেমালুম মাতিয়ে করে রেখেছে। আমরা আমাদের জীবন নিয়ে ভাবি না। বহমান জীবন যে রবি ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতার নিষ্ঠুর উপমা তা কিন্তু আমাদের স্মরণে থাকে না। আল্লামা ইকবাল বলেছেন “জীবন তো মৃত্যুর যাত্রা” তাও আমরা খেয়াল করি না। আমাদের মাঝ থেকে প্রত্যহ হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব কিন্তু আমরা নিজেদের হারাবার প্রস্তুতি নেই না। সম্প্রতি অনুজ লেখক সবুজ কবীরের মুত্যু আমাকে বার বার জীবনের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিয়ে তোলছে। তার চেহেরা ও স্মৃতি মনে পড়লে আমি নির্বাক বনে যাই। তাকে আমি কিভাবে মূল্যায়ন করবো জানি না । সে তো বহুমুখী প্রতিভার আকর। আমি তাকে দেখেছি একজন ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক হিসেবে। তার মধ্যে ছিল সৃজনশীল চেতনা, পরোপকারের বলিষ্ট মনোভাব সর্বোপরি শুদ্ধ সমাজ গড়ার তীব্র আকুলতা । আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। সে জন্মগতভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী বংশের উত্তরাধিকার। তার বাবা হলেন প্রফেসর আবদুল্লাহ ইউসুফ (১৯৪৩-২০০৮)। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মাতা রওশন আরা এখনও সুস্থভাবে জীবন যাপন করছেন। তিনি চট্টগ্রাম শহরের বিখ্যাত দোভাষ বাড়ির মেয়ে। সবুজ ভাইয়ের দাদাজান মরহুম নুরুল কবীর (১৯১৫-১৯৮৮) ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি গ্রাজুয়েট; তিনি বই প্রেমের প্রবাদ পুরুষ। ইন্তেকালের সময় এক বিশাল পারিবারিক লাইব্রেরী রেখে যান। কর্মজীবনে তিনি কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও চিটাগাং মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের শিক্ষক এবং টার্নার গ্রাহামস লি: কো: (পাকিস্তান) এর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের কোষাধ্যক্ষ (১৯৮১-১৯৮৮) হিসেবে উক্ত সংস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সাহিত্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সবুজ কবীর’ নামটি বহুল পরিচিতি পেলেও দাদার নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয় রিদওয়ানুল কবীর। ১৯৮১ সালের ১লা জুলাই চট্টগ্রাম শহরের মাদারবাড়িতেই তার জন্ম হয়। শতাধিক বছর পূর্বে তার পূর্বপুরুষ লোহাগাড়া উপজেলার বড় হাতিয়া গ্রাম থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসতবাড়ি গড়ে তোলেন। তিন চাচা মুহাম্মদ শফিউল্লাহ, মে‘রাজুল ইসলাম ও আনওয়ারুল ইসলাম সবুজ কবীরকে পিতৃস্নেহে দেখাশোনা করতেন। পরিবারে সবুজ ভাই ছোট, তার এক বড়ভাই আছেন নাম রেফায়েত কবীর শাওন; ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র; তিনি এক সময় মুক্তকন্ঠের সাহিত্য সভায় আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিতেন। ১৯৯৭ সালে সবুজ কবীর চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় হতে বিজ্ঞান থেকে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করে। এরপর ভর্র্তি হয় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখান থেকে ২০০১ সালে ডিপ্লোমা ইন ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করে কৃতিত্বের সাথে। এরপর এ.এম. আই.ও কোর্স করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘টেলিযোগ প্রকৌশলী’ হিসেবে চাকুরি করে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিদ্যায় ছিল তার প্রবল ঝোঁক। ২০০৫ সালে ঢাকার প্রীতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ ‘স্যাটেলাইটের কথা’। ২য় গ্রন্থ ‘সোনালী যুগের সন্ধানী’ প্রকাশিত হয় চলতি বছরের বইমেলায়। আমাদের সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড পলিসি স্টাডিজ (সিআরপিএস) থেকে ছাপানোর জন্য গত বছর সে আমাকে এ বইয়ের পান্ডুলিপি দিয়েছিল কিন্তু সেন্টারের কাজে ভাটা পড়ায় সেটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
আমার সাথে সবুজ কবীরের সম্পর্ক ছিল প্রগাঢ়। খুব সম্ভবত ২০১২-১৩ সালের দিকে হবে, সে সময়ে যে ভবনে আমাদের কলেজের শহর ক্যাম্পাস ছিল সে ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে সবুজ ভাইয়ের একটি দোকান ছিল। দোকানে বই বিক্রিসহ আরো নানা কাজ চলত। কলেজে ‘ইসলামের পরিচয়’ নামে আমার লেখা একটি বই পাঠ্য ছিল। সবুজ ভাই আমার সাথে যোগাযোগ করে সেটি খুঁজে নেয় অন্যান্য বইয়ের সাথে বিপনণের জন্য। মূলত এসময়ই আমাদের পুরোপুরি পরিচয় ও সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। অবশ্যই সবুজ ভাই নাকি সে বহু আগে থেকে আমাকে চিনতো। পরবর্তীতে আমার ‘চট্টগ্রামের একশ মুসলিম মনীষা’ সংকলন তৈরীতে সবুজ ভাইয়ের যথেষ্ট সহায়তা পাই এবং এ সিরিজ প্রকাশনার ৪র্থ খন্ডের পরিশিষ্টে তার পিতামহ নূরুল কবীরের জীবনীও সংযুক্ত করি। এসময় সবুজ ভাই এমন কতিপয় বই ও তথ্য দিয়ে আমাকে সহায়তা করে যাতে আমার কর্মপ্রয়াস একধাপ এগিয়ে যায়। আমিও আমার বইয়ের ভূমিকায় তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
একাডেমিক কাজের পাশাপাশি সবুজ ভাই আমার সামাজিক কাজেও ছিল সহযোগী । সবুজ ভাই জানত ২০১১ সালে আমি অসহায়-দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য আমার অজপাড়াগাঁ টইটংয়ে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করি। সেখানকার কর্মকান্ড আমার ফেইসবুকের টাইমলাইনে পোস্ট করা হলে মাদরাসা নিয়ে তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এ কাজে আমাকে নানাভাবে তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালে মাদরাসার পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ভুলবার নয়। তার দাদা মরহুমের একটি অভ্যাস ছিল বাজারে কোন নতুন বই এলেই তিনি ন্যূনতম পাঁচ/দশ কপি কিনে নিতেন আর বন্ধু-স্বজনদের হাদিয়া দিতেন। দাদার ইন্তেকালের পর সবুজ ভাইয়েরা উত্তরাধিকারসূত্রে বিশাল এক লাইব্রেরীর মালিকানা লাভ করে। পারিবারিক সিদ্ধান্তক্রমে সে লাইব্রেরী থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার বই সবুজ ভাই আমাদের পশ্চিম টইটং রহমানিয়া আদর্শ মাদরাসা পাঠাগারে উপহার দেয়। ২০১৬ সালের কথা। সবুজ ভাই আমার সাথে দেখতে যায় আমাদের নিভৃত গ্রামের মাদরাসা। শরীক হয় সেখানকার কচিকাঁচার ঈদ পূণর্মিলনীতে। মাদরাসা ভ্রমণ সম্পর্কে ব্লগে উঠে আসে তার বক্তব্য,“এক সাথে সালাম জানানোর মাধ্যমে একদল শিশু আমাদের আমন্ত্রণ করল মাদরাসায়। নিষ্পাপ মুখের এই শিশুদের গায়ে দামি জামা নেই। হাতে নেই আইপ্যাড,আইফোন। কিন্তু এদের চোখে আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আছে জ্ঞানার্জনের আগ্রহ । মাটির মেঝে,বাঁশের বেড়া আর ফাটা টিনের চালের নিচে বসেই এরা নিজেদের উদ্ভাসিত করছে জ্ঞানের আলোয়। এই এলাকায় বিদ্যুত নেই। নেই আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা। তার মাঝেও তারা সুখি।”
সবুজ কবীর বেশী দিন হায়াত পায়নি। তার রোগের কথা সে সহজে কাউকে বলত না। সে ছিল অন্তর্মূখী, চাপা স্বভাবের। দাম্পত্য জীবনে সে একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রী রেখে বিদায় নেয়। মেয়েটা ছিল তার স্বপ্নের ঠিকানা। মেয়েকে নিয়ে সে বেড়াতে যেত এখান-ওখান। মেয়েও ছিল পিতৃভক্ত। একবার সবুজ ভাইকে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে জানায়, ভাই! “আমি হলাম সাদাসিদে মানুষ, নিজের যা আছে তা দিয়ে চলি, অত সুখ-সৌখিনতা বুঝি না আর কাউকেও চাপে রাখতে পছন্দ করি না”।
বই-ই ছিল সবুজ ভাইয়ের সম্বল ও সাথী। গত বছর অসুস্থতা বেড়ে গেলে ইদানিং সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম মাসুম ও আমি তাকে বাসায় দেখতে যাই আর দেখি তার শোয়ার ঘরের চারপাশে বই আর বই। অনেক দুর্লভ ও ঐতিহাসিক বই তার কাছে ছিল। তার লেখা পড়লে বুঝা যেত সে কত বেশী পড়ে ও জানে। তার লেখায় ছিল ইসলামী আদর্শের সুস্পষ্ট ছাপ। মুসলিম ঐতিহ্যের পূনরুজ্জীবনে তার কলম ছিল সদা প্রস্তুত। আধুনিক বিজ্ঞান ও ইসলামের ইতিহাস ছিল তার লিখার অনুসঙ্গ। ফেইসবুকে তার পোস্টগুলো যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। এ সম্পর্কে তার দীর্ঘ কালের হাউস টিউটর নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন,“সবুজের পোস্ট ও লিখার মধ্যে একটা ভিন্নতা কাজ করত। নতুন ধরণের তথ্য থাকত। এমন জায়গা থেকে উপমা দিত যা সচরাচর মানুষ পড়ে না। সে ভুল নাকি অসত্য এ ধরণের কথা সহজে কেউ তুলতে পারত না। ঐতিহাসিক বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারত। আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার, ঐতিহাসিক তথ্য সে ভুলত না।”
কোরবানির ঈদের পরের সপ্তাহ-গত ২০ আগস্ট ২০১৯। আমি মাদরাসার খিদমতে গ্রামে যাচ্ছিলাম। হঠাত গাড়িতে সবুজ ভাইয়ের চাচা আনওয়ার ভাইয়ের ফোন পেলাম । তিনি কাঁদছেন আর বলছেন,‘ আমার ভাইপো সবুজ আর নেই’। তৎক্ষণাৎ আমি বাহার ভাইকে খবরটি পৌছালাম আর ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার চোখে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো। আমাদের জীবন এমনই অনিশ্চয়তায় ভরা। তবু আমরা নিশ্চিত গন্তব্যের কথা ভুলে যাই। দু‘সপ্তাহ পরে সবুজ ভাইয়ের চাচা আনওয়ার ভাইয়ের সাথে আলাপ করলে তিনি জানান, “সবুজ জানতো সে আর বেশী দিন বাঁচবে না, সে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে দেয়। হাসপাতালে সে কালিমায়ে তাইয়েবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ’ সশব্দে পড়তে পড়তে এ নশ্বর জগত থেকে বিদায় নেয়। আসলে এখানেই সবুজ ভাইয়ের সারা জীবনের সাফল্য ও স্বার্থকতা। কারণ পেয়ারা নবীর ভাষ্য হচ্ছে,“যার শেষ বাক্য কালিমায়ে তাইয়েবা হবে আল্লাহ পাক তাকে জান্নাত দান করবেন”। আয় আল্লাহ! প্রিয় সবুজ ভাইকে জান্নাতের মেহমান করুন। আমীন ॥
লেখক: গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ