সক্রেটিসের ভাবশিষ্য || পান্থজন জাহাঙ্গীর

BanshkhaliTimes

আরিফকে নিয়ে তার মা মহাবিপদের মধ্যেই আছেন। সেটা হচ্ছে তার লেখাপড়াটা চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে। আরিফ যেদিন থেকে কথা বলা শিখছে সেদিন থেকে সে আর চুপ থাকেনি। তার অনুসন্ধিৎসু মনের হাজারও কৌতুহল তার বাবা মা মিটিয়েছেন। কিন্তু সে অনেক আগের কথা এ বয়সে বেশির ভাগ শিশুরই এ কৌতুহল থাকে। কিন্তু তাই বলে টপাটপ সাত ক্লাস টপকিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠা আরিফের এ অভ্যাস কি থেকে যাবে? তার লেখাপড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে? এ নিয়ে তার মা খুব শঙ্কিত।

সাধারণত এ বয়সে ছেলেমেয়েরা লাজুক হয় কিংবা অনেকটা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কিন্তু আরিফ আগের চেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। কারণ, মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প পড়ে সে জানছে যে জানার অর্থ হচ্ছে জিজ্ঞাসা। তাই ক্লাসে যে কোন শিক্ষককে প্রতিদিন দু’একটা জিজ্ঞাসা না করেই ছাড়ে না। এতেই তার বিপত্তি। এই স্কুলে প্রথম দিকে এই আচরণের জন্য বেশ সুনাম গেয়েছে এমনও শিক্ষক আছেন কিন্তু এখন সে সবার চক্ষুশূল। হেডমাস্টার বরাবর কমপ্লেইন বক্সে তার বিরুদ্ধে বারটি কমপ্লেইন জমা পড়েছে। তারমধ্যে বিজ্ঞান স্যারের ক্লাসে সে নাকি মানুষ কোন পদার্থ তা জানতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি এর যুতসই উত্তর দিতে পারেননি। স্কুলের বাংলা স্যারের একটা অভ্যাস ক্লাসে ঢুকেই চক ডাস্টার টেবিলে রেখে হঠাত একটা সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করে বসা। আজকে তার প্রশ্ন ছিল” বড় কে? কবিতার রচয়িতা কে? বেশি ভাগ ছাত্র বলল,” ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত।” তিনি বললেন হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু আরিফ বলল,” ঠিক নাই স্যার। এর সঠিক উত্তর হবে হরিশচন্দ্র মিত্র।” কিন্তু স্যার মানতে বড়ই নারাজ। তিনি নাকি নিজেই ছাত্র অবস্থায় বইতে পড়ে এসেছেন।

সমাজ স্যার সঠিক উত্তর বাচাইয়ে বহুপদী সমাপ্তি সূচক প্রশ্ন করেছেন, মহাকাশে যাওয়ার যোগ্যতা কোনটি? সবাই বলেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং মহাকাশযান চালানোর দক্ষতা এ দুটি উত্তর কিন্তু আরিফ বলছে, “টাকা” সে স্যারের সাথে এই বলে তর্ক করেছে যে অন্য উত্তর দুটি টাকার উপরই নির্ভর করে। তার মতে কোন দেশ এই সেক্টরে যদি অর্থ লগ্নি না করে তাহলে সে দেশ মহাকাশে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে না। কিন্তু তিনি যেহেতু এই উত্তরটি বইতে নেই তাই মানলেন না। কিন্তু আরিফের মতে বইতে না থাকুক তাতে কি প্রশ্নের অপশনে তো আছে। ইংরেজির স্যার টেনস্ পড়াতে গিয়ে ইউনির্ভাসেল ট্রুথ এর উদাহরণে লিখলেন, “দি সান রাইজেস ইন্ দ্যা ইস্ট।”আরিফ বলল, এই বাক্য নাকি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ, সূর্য নাকি কোনদিকে উঠেও না আবার অস্তও যায়না। পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে নাকি এমনটা মনে হয়। তার ব্যাখা শুনে ইংরেজি স্যার তার সাথে কোন বাহাসে গেলেন না কিন্তু তার মুখটা টকেটকে লাল হয়ে গেল।

তার সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে ধর্ম ক্লাসের হুজুরের সাথে নাকি বেয়াদবী। কারণ তিনি যখন বললেন, আল্লাহর হুকুম ছাড়া নাকি কোনকিছুই হয় না তখন আরিফ বলে উঠল, তাহলে এ পৃথিবীতে যারা অপরাধ করছে তারাও তো তা আল্লাহর হুকুমে করছে। কিন্তু বান্দা তাদের শাস্তি দিচ্ছে কেন? কেনই বা তাদের মৃত্যুদন্ড দন্ডিত করেছ? হুদাইবিয়ার সন্ধি পড়াতে গিয়ে হুজুর সুরা আলফাতাহ্ র রেফারেন্স দিয়ে বললেন, “হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্য সুস্পষ্ট বিজয়। “তখন আরিফ বলল, চুক্তির ধারাগুলো হুজুর পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এটি অমুসলমানদের জন্যই বিজয়। হুজুর এটাকে মহা বেয়াদবি ধরে নিলেন।
এভাবে আরিফ ছেলেটির সাথে স্যারদের কোন না কোন বিষয়ে তর্ক বিতর্ক হয়। তবে এতে তার সহপাঠীরাও দারুন আনন্দ পায়। তারা তাকে খুব ভালবেসে কিন্তু যতসব বিপত্তি স্যারদের সাথে। তারা এটাকে মোটেই ভালভাবে নিচ্ছে না।

স্কুলের হেডমাস্টার জরুরি ভিত্তিতে মিটিং কল করেছেন। কারণ আরিফের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি সবার মতামত চাইবেন। সবাই যখন তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন তিনি একা সিদ্ধান্ত কেন নিবেন? তাছাড়া এটা একটা ভিন্ন কেস। এ রকম প্রশ্নপ্রিয় কৌতুহলি,বাকশক্তিসম্পন্ন ছাত্র তার স্কুলে একেবারেই নতুন। তারপরও শিক্ষকরা এটাকে যেহেতু বাড়াবাড়ি বা বেয়াদবি মানছেন তাহলে পদক্ষেপ তো নিতেই হবে।

অবশেষে কঠিন পদক্ষেপ। হেডমাস্টার সাহেব দ্রত মিটিং শেষ করে তার রুমে এসে আরিফের মাকে একটা তার সাইন করা স্কুলের প্যাড ধরিয়ে দিলেন। আরিফের মা ভাল করেই জানেন এটা কী। কারণ এর আগেও বেশ কয়েকটা স্কুল এই কাজটি করেছে। আরিফকে যখন ক্লাসরুম থেকে তার মা ডাকতে গেলেন, তখন ক্লাসের সবাই বুঝে ফেলছে তার ভাগ্যে কি জুটেছে। ক্লাসে পিনপতন নিরবতা। কেউ কেউ চোখের পানিটাকে আর ধরে রাখতে পারেনি। ক্লাস থেকে বের হয়ে আরিফ হেডমাস্টারের সাথে দেখা করতে চায় বলে দৌঁড় মারল। পেছন পেছন তার মাও দৌঁড় দিলেন। মায়ের বড় ভয়। কি না কি করে বসে আবার! স্যারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আরিফ বলল,
– স্যার আসতে পারি?
– এসো।
– স্যার, বুঝতে পারছি স্কুল থেকে আমাকে বের করে দিচ্ছেন।
– হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
– কিন্তু আপনি তো আপনার ইচ্ছটি পূরণ করলেন। আমারো দু’ টি ইচ্ছা আপনাকে পূরণ করতে হবে স্যার ।
– তুই আমাকে কি দৈত্য ভাবছিস যে তোর ইচ্ছা পূরণ করতে এখানে বসেছি?
– স্যার দৈত্যরা তো অন্তত: মানুষের ইচ্ছার কথা শুনে তাহলে আপনি মানুষ হয়ে আমার দুটো ইচ্ছার কথা কেন শুনবেন না?
– আচ্ছা তাড়াতাড়ি বল। আমার অনেক কাজ।
– প্রথমটা হচ্ছে আমি আপনাকেও একটা প্রশ্ন করতে চাই।
– আবারো প্রশ্ন? আচ্ছা বল।
– আপনি আমাকে বলবেন ন্যায়বিচার কী?
– হা হা হা! এটা তো একেবারেই সহজ প্রশ্ন! “যার যা প্রাপ্য তাকে তা প্রদান করাই তো ন্যায়বিচার।”
– তাহলে বলুন তো আমি যদি আজ আপনার কাছে লম্বা একটা ধারালো ছুরি জমা রেখে যাই এবং কাল পাগল হয়ে যদি সেটা চাইতে আসি তাহলে কি আমার প্রাপ্য আমাকে প্রদান করবেন?
– না।
কেন স্যার ?
– কারণ, তুই যেহেতু পাগল হয়ে গেছিস তাই প্রথমেই তুই এটা দিয়ে কয়েকটা মানুষ খুন করবি।
– তাহলে ন্যায়বিচারটা কী?
এবার হেডমাস্টার সাহেব রেগে গেলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চোখ থেকে চশমাটা খুলে টস করে টেবিলে রেখে,আঙ্গুল উচিঁয়ে চিৎকার করে বললেন।,” তোর নাম কেটে আমি যে বিচার করেছি সেটাই ন্যায়বিচার, হারামজাদা।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *