বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় বসলাম অবশেষে। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে আমার ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়। সকাল বেলা সিদ্ধান্ত নিই যেভাবে হোক পরীক্ষা দেব। সেই ২০০৭ সাল থেকে করে আসা যুদ্ধে আমি কিছুতেই হারব না। তাই স্বামীর সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে গেলাম পরীক্ষার হলে। পরম করুণাময় আমাকে ফেরালেন না। উত্তীর্ণ হলাম স্বপ্নের বিসিএসে প্রাণিসম্পদ ক্যাডারে ১১তম হয়ে।

শিক্ষক বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সুপর্ণা দে। স্বপ্নের শুরু সেই ’৯৫ সালে।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার সুবাদে বাবা-মা তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। এরপর প্রাথমিকে বৃত্তি, এসএসসিতে সর্বোচ্চ জিপিএ নিয়ে ২০০৩ সালে বাঁশখালীতে প্রথম হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ভালো ফলাফল নিয়ে এইচএসসি পাস করেন ২০০৫ সালে। ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। তবে তিনি বরাবরই গতানুগতিক পড়ালেখার বাইরে ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছিলেন। তাই অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে ভেটেরিনারিকে বেছে নেন। এরপর ভর্তি হন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদে। কিন্তু মাত্র ১৯ বছর বয়সে ২০০৭ সালে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে হুট করেই পারিবারিক কারণে বিয়ে হয়ে যায়। বলেন, ‘জীবনের প্রথম ছন্দপতন সেদিন অনুভব করেছিলাম।
অবশ্য আমার স্বামী আমাকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু বিয়ের পর বোঝলাম বাস্তবতা বড্ড কঠিন। কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক দূরে আরেকটা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থেকে সবার বাঁকাকথা সহ্য করে পড়ালেখা শেষ করাটা ছিল দুঃসহ। অবশেষে শ্বশুরবাড়ি, বাবারবাড়ি সামলিয়ে ডিবিএম (ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন)-এর পাহাড়সম পড়া শেষ করলাম ২০১২ সালে। ’
ছোটবেলা থেকে আবৃত্তি শিখেছিলেন সুপর্ণা। ক্যাম্পাসে সুযোগ পেলেই আবৃত্তি করতেন। ক্যাম্পাসের সবাই ভেবেছিলেন তিনি আর হয়তবা পড়বেন না। কিন্তু কারো আশঙ্কাকে সত্যি হতে না দিয়ে ভালো ফলাফল করে শেষ করলেন কোর্স। এর মধ্যে শ্বশুরবাড়ির সবাই বলাবলি করছিল এতবছর বিয়ে হলো এখনও বাচ্চা হয়নি কেন?
‘আসলে আমাদের দেশে সবাই বিয়ের বয়সটাই দেখে, মেয়ের বয়স কেউ দেখে না। তাই চট্টগ্রাম ফিরে এসে এরপর শাশুড়ির চাপে প্রথম সন্তানের মা হই। শুধু সংসারে মন দিলাম। কিন্তু পরিচিতজনরা কটু কথা বলতে শুরু করল। এত বছর বাইরে পড়ালেখা করে কি হলো? সেইতো সংসার করছে। এক ধরনের হতাশায় পড়ে গেলাম। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। কিন্তু ডুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছোট ভাই সন্দীপন চাইতো আমি যেন বিসিএস পাস করি। তাই ছোট ভাই আর স্বামীর অনুপ্রেরণায় চেষ্টা করলাম ঘুরে দাঁড়ানোর। টার্গেট করলাম যেভাবেই হোক পাস করব বিসিএস। কিন্তু প্রকৃতি একটু বেশিই পরীক্ষা নিতে চায় আমার। ’ যোগ করেন সুপর্ণা দে।
তিনি আরো বলেন, ‘৩৫তম বিসিএসের যখন আবেদন করছিলাম তখন দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে যাচ্ছিলাম। নিজের অসুস্থতার সঙ্গে দুই বছরের ছোট মেয়েকে সামলানো, সংসারে সব কাজ, বিসিএসের এত পড়া পেরে উঠছিলাম না। বারবার হতাশ হচ্ছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়িনি। অবশেষে বসলাম লিখিত পরীক্ষায়। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে আমার ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়। সকালবেলা সিদ্ধান্ত নিই যেভাবে হোক পরীক্ষা দেব। সেই ২০০৭ সাল থেকে করে আসা যুদ্ধে আমি কিছুতেই হারব না। তাই স্বামীর সাথে অ্যাম্বুলেন্সে করে গেলাম পরীক্ষার হলে। পরম করুণাময় আমাকে ফেরালেন না। উত্তীর্ণ হলাম স্বপ্নের বিসিএসে প্রাণিসম্পদ ক্যাডারে ১১তম হয়ে। ’
সুপর্ণা আনন্দে কেঁদেছিলেন সেদিন। অবশেষে বিয়ের ১০ বছর পর ২০১৭ সালে একটা নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে পারলেন তিনি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) এর গর্বিত সদস্য হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। যোগদান করলেন খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে প্রাণিসম্পদ ক্যাডারে ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে। পাশাপাশি বেশ কিছুদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেরেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে পাশের উপজেলা মানিকছড়িতে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬ মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন বার্ডে। সেখানে ৯টি বিভিন্ন ক্যাডারের ৪৬ কর্মকর্তার মধ্যে মেধাতালিকায় তৃতীয় হন সুপর্ণা। এ জন্য সরকার কর্তৃক পুরস্কার হিসেবে মালয়েশিয়ার ইউপিএম (ইউনিভার্সিটি পুত্র মালয়েশিয়া) তে ১০ দিনের একটা ট্রেনিংয়ের সুযোগ পান। যা চাকরি জীবনের খুবই সম্মানজনক বলে মনে করেন তিনি। কিছুদিন আগে এফএও এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। সেখানে প্রশিক্ষণ মূল্যায়নের মাধ্যমে তিনি প্রশিক্ষক হওয়ারও আমন্ত্রণ পান।
বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন রোগতত্ত্ব অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ঊঢ়রফরসরড়ষড়মু’র ওপর একটি কোর্স করছেন সুপর্ণা। এখানে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এবং বিসিএস প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের ১৯ জন কর্মকর্তা আছেন। সেখানে একাই নারী প্রশিক্ষণার্থী সুপর্ণা। খুব সম্প্রতি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলা অধিদপ্তরের উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বাঁশখালী উপজেলা থেকে শিক্ষা ও চাকরি ক্যাটাগরি থেকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পরে জেলা প্রশাসন এবং জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন। এখন বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ হয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে পুরস্কার নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সুপর্ণা। বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার কাছে। আসলে আমাদের দেশের মেয়েদের বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েদের অনেক বাধা বিপত্তি পাড়ি দিতে হয় গন্তব্যে পৌঁছাতে। কিন্তু আমরাও পারি আমাদের সেরাটা দিতে যদি পরিবার পাশে থাকে।
বিয়ের পর গত ১০ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছি। সামাজিক বাধার সম্মুখীন হয়েছি আজকের এই অবস্থানে আসতে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য এবং মনোবলের জন্য আমি বাধার হিমালয় অতিক্রম করেছি। আমি মনে করি ক্যারিয়ারের সফলতায় আমার সন্তানরা আমার দুর্বলতা নয় বরং তারা আমার শক্তি। কর্মজীবনে আরো এগিয়ে যেতে চাই। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে অর্জিত জ্ঞানকে পেশাগত দক্ষতায় রূপান্তর করতে চাই। আর ব্যক্তিগত জীবনে আমার মেয়ে আর ছেলের আদর্শ মা হতে চাই। ’
সুপর্ণার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভার জলদীর মহাজনপাড়ায়। তাঁর বাবা-মা দুজনই শিক্ষক। মা অপর্ণা নন্দী বাঁশখালী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। বাবা স্বপনেন্দু দে আনোয়ারার হাজিগাঁও বরুমছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর ছোট ভাই সন্দীপন দে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। সুপর্ণার স্বামী টিটো শিকদার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। মেয়ে পরী এবং ছেলে নীলকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার।
সুত্র: কালেরকণ্ঠ