৮ অক্টোবর শুভ জন্মদিন “জগলুল হায়দার”।
বাঁশখালী টাইমসের পক্ষ থেকে অনেক শুভ কামনা।
জগলুল হায়দার মানেই ছড়ার জগতে অনিবার্য নাম। ছড়া পড়তে ভালোবাসেন অথচ জগলুল হায়দারকে চেনেন না, এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছড়ার জগতে তিনি নিজস্ব একটি ভঙ্গী দাঁড় করিয়েছেন। যা কিনা পাঠক মহলে `জগলুল হায়দারের বারোভাজা` নামে পরিচিত। শুধু ছড়া দিয়েই নয়, বিনয়ী আচরণের জন্য সবার কাছেই তুমুল জনপ্রিয় হাসিমুখের এই মানুষটি। সম্প্রতি লেখালেখি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে জাগোনিউজের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তাকে নিয়ে লিখেছেন হাবীবাহ্ নাসরীন-
ছেলেবেলা
জগলুল হায়দারের বড় একটি পরিচয় হলো তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। তার বাবা প্রকৌশলী জি কে এম আব্দুল লতিফ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। জগলুল হায়দার নিজেও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। তবে নিতান্তই শিশু ছিলেন বলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া হয়নি তার। যুদ্ধের সময়টাতে বাড়িতে রাজাকার বাহিনী এলে বাড়ির ছেলে, যারা বয়সে একটু বড়, তাদেরকে লুকিয়ে রাখা হতো। ছোট বলে জগলুল হায়দারকে লুকিয়ে রাখা হতো না বলে তার খুব মন খারাপ হতো! মুক্তিযোদ্ধা বাবার আদর্শকে বুকে লালন করেই বেড়ে উঠেছেন জগলুল হায়দার। তার বাবা বলতেন, `সৌরজগতে কোনকিছু অর্জন অসম্ভব নয়`। বাবার কথাটি খুব বিশ্বাস করেন জগলুল হায়দার, প্রচেষ্টা আর শ্রম থাকলে মানুষ যেকোনো উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে।
লেখালেখির শুরু যেভাবে
বাবা একদিন বললেন, যে কোনকিছুর শুরুটাই খুব ছোট কিছু দিয়েই হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রথম লিখেছিলেন `জল পড়ে, পাতা নড়ে`। বাবার সব কথার মতো এই কথাটিও খুব মনে ধরলো তার। বাবার কথায় উৎসাহী হয়ে তিনি লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম লেখাটি। কী ছিল সেই লেখা? দেশবরেণ্য ছড়াকারের প্রথম লেখা যে ছড়াই হবে এ আর অবাক কী। বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই দুই-চার ঘণ্টার প্রচেষ্টায় তিনি যে ছড়াটি লিখলেন সেটি ছিল দুই লাইনের একটি ছড়া- `মশা ওরে মশা/ তোরে দেবো ঘষা!` ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া জগলুল হায়দার তো আর তখন জানতেন না, কয়েক বছর পরেই এদেশের ছড়ার রাজ্যের অনেকটাই তার দখলে চলে যাবে!
জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ক্লাস টেনে পড়াকালীন সময়ে। প্রতিবেশী এক পরিবার বাসা বদল করে যাওয়ায় তার মনে এক ধরণের বিচ্ছেদ-যন্ত্রনা হচ্ছিল। সেই অনুভূতি থেকেই তিনি লিখে ফেললেন দীর্ঘ এক কবিতা। পৃথিবীর অধিকাংশ কবিতার জন্মই কি তবে বিচ্ছেদ থেকে হয়! নিজের লেখা প্রথমবার ছাপার অক্ষরে দেখতে পেয়েছিলেন একটি স্কুল ম্যাগাজিনে। তবে ছড়ার নিচে ছড়াকার হিসেবে যার নাম ছাপা হয়েছিল সে নাম জগলুল হায়দারের নিজের নয়! ছড়াটি তার হলেও নামটি ছিল তার ছোটবোনের! আসল ঘটনা হলো ছোটবোনই তার লেখা `চুরি` করে নিজের নামে ছেপে দিয়েছিল!
জগলুল হায়দারের বাবা মারা যান ১৯৯১ সালে। বাবাই ছিল তার পৃথিবী। বাবাকে হারিয়ে সদ্য যুবক ছেলেটি যেন কিছুটা ছন্দ হারিয়ে ফেলল জীবনের। জীবনের হারানো ছন্দ খুঁজতে গিয়েই সম্ভবত ছন্দের মাটিতে শেকড় ছড়াতে শুরু করলেন। পত্রিকার পাতায় ছাপানোর আগেই প্রকাশ করেছিলেন প্রথম ছড়ার বই। বিভিন্ন সময়ে লেখা ছোট ছোট ছড়া, যাকে বলে অণুকাব্য- তাই দিয়েই প্রকাশ করেছিলেন প্রথম বইটি। নাম দিয়েছিলেন `চুম্বক`। `চুম্বক`ই পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে আনতে লাগলো জগলুল হায়দারের ছড়ার রাজ্যে। প্রথম বই থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি।
তারপর থেকে এক মুহূর্তের জন্য থমকে থাকেননি জগলুল হায়দার। তার ভাষায় `অনেকটা রকেটের গতিতে লিখেছি`। যেমন দুই হাতে লিখেছেন, লিখছেন তেমনি প্রতিদানেও খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাকে। এখন দেশের প্রায় সবগুলো পত্রিকার ফান ম্যাগাজিন, শিশুতোষ পাতা, ছড়ার কলামগুলো জগলুল হায়দারের নাম ছাড়া কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘোষণা করলেন, এখন থেকে সন্তানের পরিচয়পত্রে বাবার পাশাপাশি মায়ের নাম থাকা বাধ্যতামূলক, তখন জগলুল হায়দারের মনে বেশ আনন্দ হয়েছিল কারণ তারও অনেক আগে ১৯৯৩ সালে জগলুল হায়দারের ছড়ায় উচ্চারিত হয়েছিল সেই দাবি! লেখককে তো এমনই হওয়া চাই, সাধারাণের দেখার বাইরে যিনি দৃষ্টি ছড়িয়ে দেবেন।
জগলুল হায়দারের বইয়ের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ত্রিশটি। তার মধ্যে ছড়ার বই ছাড়াও আছে গল্পের বই। নতুন যারা লিখতে চান তাদের প্রতি জগলুল হায়দারের একটাই পরামর্শ- `পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। সামনে যা পাবে তা-ই পড়ো। পড়তে পড়তেই তুমি একসময় বুঝতে পারবে, কী তোমার গ্রহণ করা উচিৎ আর কী উচিৎ নয়। তোমার লেখা যেন পাঠকের হৃদয়কে আলোকিত করে। লেখক হচ্ছে সমাজের অগ্রসর একজন চিন্তক। সমকালের হাত ধরেই তাকে মহাকালের দিকে ধাবিত হতে হবে। থাকতে হবে সাহস এবং সততা, থাকতে হবে লেখালেখির প্রতি দায়বদ্ধতাও`।