BanshkhaliTimes

শুনো মেয়ে, তোমাকে বলছি…

BanshkhaliTimes

শুনো মেয়ে, তোমাকে বলছি…

ডা. নাসিমন নাহার মিম্মি

শুধুমাত্র বাংলাদেশে বসবাসকারী মেয়েদের জন্য লেখাটি। আট মাস বয়সী থেকে আশি বছরের সব মেয়েদের জন্য। বাংলাদেশের একজন খুব সাধারন মেয়ে হিসেবে আমি কিছু কথা বলতে চাই রেপ সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে।

অবশ্যই কথাগুলো সবার মনের মত হবে না, সেটা জানি।কথাগুলো খুব কালচার্ডও হবে না। কারন— আমি তো আর সুশীল শ্রেণীর ধ্বজা ওড়ানো নারী না। লআমি ঘরোয়া খুব বেশি সাধারণ একজন বাংলাদেশী মেয়ে। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেই শিখেছি। আমার কোন ক্ষমতা কিংবা ফায়দা লোটার নেই যে সাদাকে কালো বলে প্রচার করে এই দেশের অতি আবেগ দিয়ে পরিচালিত খুব সাধারণ মানুষগুলোকে বোকা বানানোতে !

তবে এই কিম্ভূত সমাজকে এসি রুমে পাটভাঙা সুতি শাড়ি পরা এবং পাঞ্জাবি পড়ুয়া খাঁটি বাঙ্গালী ভেক ধরা বহু টকশো করা সুশীলদের থেকেও অনেক বেশি কাছ থেকে দেখেছি।

জন্মসূত্রে মেয়ে এবং ডাক্তার হবার সুবাদে নিজে এই সমাজের হাই সোসাইটি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম মধ্যেবিত্তদের জীবনটা মোটামুটি খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা এবং আমার অতি সাধারণ ভাবনা চিন্তার আলোকে কিছু কথা বলতে চাই।

এদেশে যে আইনের প্রয়োগ কতটুকু হয় তা আমরা সবাই জানি। রাজনৈতিক দলের নেতা এবং নেতার হাতা এবং টাকার বালিস কোলবালিশ যদি তোমার বাবার না থাকে তাহলে তুমি এই দেশের জন্য একটা অপদার্থ!
যতই লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, জজ ব্যারিষ্টার যাই হও না কেন ফাইভ পাশ চ্যালা চামুণ্ডার অফিসে কামলা দিবা তুমি , আমিও দিচ্ছি। মধ্যবয়সে পৌছানোর আগেই বিবিধ শারীরিক অসুখে ভুগে তারও বহু আগে মেরুদণ্ডহীন হয়ে বাতিল মালের খাতায় নাম লিখাবা। সংসার ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একের পর এক সমাজে ঘটে চলা অন্যায় মেনে নেয়াটা এক সময় অভ্যাস হয়ে যায় আমাদের। কারণ– অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তুমি আমি আমার মা বোন মেয়ে যে কেউই হয়ে যাবে তনু, পূজা, শাজনীন, কল্পনা চাকমা, তৃষ্ণা ।

দীর্ঘদিন ধরেই খুব মাষ্টার প্ল্যানের সাথেই এই দেশের একটা প্রজন্মকে সব দিক থেকে অসুস্থ করে বড় করে তোলা হচ্ছে— শিক্ষা থেকে শুরু করে সংস্কৃতি সমস্ত সেক্টরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বিষ। যার রেজাল্ট এখন আমাদের বর্তমান সমাজের চিত্র। এমন একটা সপ্তাহ পাই না যেখানে রেপসহ এইসব জঘন্য অপরাধের সংবাদ থাকে না। কত ঘটনা তো আমাদের জানাই হয় না, সে হিসেব নাহয় বাদই দিলাম।

আমার জীবনে প্রথম যে ঘটনা দিয়ে ‘ধর্ষণ’ শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তা ছিল শাজনীন কেস। প্রায় বিশ বছর আগের ঘটনা। এত ক্ষমতাধর বাবার মেয়ে হয়েও এত বছর ধরে মামলা নিয়ে ঝুলাঝুলি চলছে। সেখানে আমি তুমি আমরা কোন কুতুব বল ?

বরং আমি বলি কি, যাদের সুযোগ আছে তারা প্লিজ দেশের বাইরে চলে যাও মেয়েরা !
দেশ তোমাকে আমাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। বহুবার তার প্রমাণ দেশ দিয়েছে। রেপ কেসের ভিক্টিম হলে তোমাকে/আমাকে সারাজীবন ধরেই এই সমাজ জাবর কেটে কেটে চিবিয়ে চিবিয়ে মজা নিবে।সুতরাং যাদের সুযোগ আছে পালাও !

আর যাদের সুযোগ নেই তারা গৃহবন্দী হয়ে যাও ! অসূর্যস্পর্শা শব্দটা শুনেছ ? ঠিক এইরকম হয়ে যাও যেন সূর্যও তোমায় ছুঁয়ে দিতে না পারে !
কী দরকার লেখাপড়া শেখার?!
চাকরি বাকরি করে সংসারের আয় উন্নতি বৃদ্ধি করার ? দেশের জিডিপি সচল রাখার? তারথেকে বরং নিত্য নতুন এক্সপেরিমেন্টাল খাবার রান্না করে এই সমাজ- এই দেশকে গেলাও।

আর বাবা মায়েদের বলছি— কন্যা সন্তান জন্মানো মাত্রই মধ্যযুগীয় বর্বরতার মতো কন্যাকে মাটিচাপা দিয়ে ফেলুন।কারন আপনার আটমাসের/তিন বছরের/আট বছরের বাচ্চা যখন রেপ কেসের ভিক্টিম হবে তখন আপনারা তিনজনই সারাজীবন জীবন্মৃত হয়ে এই দেশের অক্সিজেন নষ্ট করবেন! বিশ্বাস করুন, একজন হযরত আলী এবং তার মেয়ে মরে গেলে কিচ্ছু যায় আসে না এই সমাজের! একজন পূজাকে তার নিকট আত্মীয় কেটে ফালাফালা করে রেপ করলেও এই সমাজ ঐ শিশুর পোশাকের ফাঁকফোকর খোঁজে। তনুকে পর্দা রক্ষা করতে পারেনি সেখানে হিন্দু/খ্রিস্টান মেয়েরা তো হালাল ***ল এই সমাজে! আর যদি একজন কর্মজীবি অথবা হোস্টেলে থাকা মেয়ের সাথে “রেপ” ঘটে সেটা অবশ্যই মেয়েটারই উস্কানি!

মেয়েরা শোনো আসল কথা বলি,
প্লিজ সবসময় মাথায় রেখ এই দেশে self defense ই একমাত্র ভরসা তোমার। কেউ তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না, কেউ না—দেশ সমাজ পরিবার, ভাই বাবা স্বামী বন্ধু ছেলে— নাহ ওরা অসহায়, ওদের কিচ্ছু করার নেই। তাই নিজেই নিজের শক্তি হও।
ভয় পেও না। কখনোই সাহস হারাবে না।
ঘরের বাইরে বের হলে সবসময়ই সাথে এন্ডিকাটার, সেফটিপিন, মরিচের গুড়া অবশ্যই সাথে রাখবা।
খুব ভালো হয় যদি জুডো কারাত শিখে ফেলতে পার।
সব সময় নিজের Guts ফিলিংসকে গুরুত্ব দিবা। জানোই তো আমাদের তৃতীয় নয়ন আছে। যখনই ফিল করবা খারাপ কিছু হতে পারে তখনই সর্তক হবে, সময় নষ্ট করবে না।
প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর মোবাইলে সেভ রাখবে।
আর যেহেতু আমাদের সমাজে সময়টা খারাপ, খুব খারাপ যাচ্ছে তাই বাইরে যাবার সময় অন্তত বাসায় বলে যাবে কোথায় যাচ্ছ।

আর একটা কথা বলি প্লিজ এই কথাটার ভুল ব্যাখ্যা করবেন না কেউ। প্রেম করা তো আর আটকে থাকছে না সমাজে তাই মেয়েদের বলছি— দেখা বা ঘোরাফেরা নিজের বুদ্ধি বিবেক বিবেচনা দিয়ে করবা, Girls u know what I mean. মনে রেখ বাস্তব জীবনের প্রেমিকরা কেউই টম ক্রুজ/শাহরুখ/সালমান/রণবীর কাপুর না। বিপদে পড়লে ঐ বেচারার কিচ্ছু করার থাকবে না। আর সে নিজেই যে অপকর্ম করার প্ল্যান করবে না তা কে বলতে পারে ?

নাহয় আমরা খানিকটা ধর্মীয় অনুশাসনে নিজেকে মুড়ে নিলাম। কারন— একসিডেন্ট জীবনে একবারই ঘটে কিন্তু তার যন্ত্রণা সারাজীবন ধরে ভোগ করতে হয়।

সবশেষে অভিশাপ দেই এই দেশকে। খুব শীঘ্রই যেন এই দেশ নারীশূন্য হয়ে যায়। হে সৃষ্টিকর্তা, এই দেশে আর কোন মেয়ে শিশুর জন্ম যেন নাহয়।স্বাধীনতার এত বছর পরেও মেয়েদেরকে সামান্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ আমার সোনার বাংলা।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *