বিটি ডেস্ক: শবে বরাতকী? কোথায় আছে? এ রাতের ফজিলত কী? আমাদের করণীয় এবং বর্জনীয় আমল কী? আসুন এ সব প্রশ্নের উত্তর দলীল সহ জেনে নিই।
________________________________________________
“শব” শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত্রি এবং “বারাআত” (براءة) শব্দের অর্থ হচ্ছে মুক্তি বা নাজাত। অর্থাৎ “শবে বারাআত” শব্দের অর্থ হচ্ছে “মুক্তি বা নাজাতের রাত্রি”। শবে বারাআত একটি ফারসী শব্দ। কাজেই কোরআন হাদিসে শবে বারাআত শব্দখানা পাওয়া যাবে না। হাদিস শরীফে এই রাত্রিখানাকে উল্লেখ করা হয়েছে “লাইলাতুন নিসফে মিনাশ শাবান” (ليلة النصف من الشعبان) বা “শাবান মাসের মধ্যা রাত্রি” নামে। শবে বারাআত (মুক্তির রজনী) কে আমরা শবে বারাআত বলি এজন্য যে, যারা এই রাত্রিতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের কাছে একনিষ্ঠার সাথে ক্ষমা চায় ও ইবাদাত বন্দেগী করে , আল্লাহ পাক তাদেরকে ক্ষমা করে দেন একমাত্র মুশরিক এবং হিংসাপোষনকারী লোক ব্যতীত। এ সম্পর্কিত দলিলসমুহ বিস্তারিত নিম্নে দেয়া হলো:
সহিহ হাদিস নং : ১
———————
ﻋﻦ ﺍﺑﻰ ﻣﻮﺳﻰ ﺍﻻﺷﻌﺎﺭﻯ ﻋﻦ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻟﻴﻄﻠﻊ ﻓﻰ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﺠﻤﻴﻊ ﺧﻠﻘﻪ ﺍﻻ ﻟﻤﺸﺮﻙ ﺍﻭ ﻣﺸﺎﺣﻦ ,ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﻪ
অর্থ : হযরত আবূ মূসা আশয়ারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ ফরমান- মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ পাক রহমতের তাজাল্লী ফরমান এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তি ব্যতীত।
(তথ্য সূত্র: (১).ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা-১০০, হাদীস নং-১৩৮৯, মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১১৫। (২). ইমাম বায়হাকী,শুয়াবুল ঈমান, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা- ৩৮২। (৩).ফাজায়েলুল আওকাত, পৃষ্ঠা-১৩৩, হাদীস নং-২৯। (৪).মিসবাহুজ জুজাযাহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৪২, হাদীস নং-৪৮৭। (৫).আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খণ্ড-৩য়, হাদীস নং-২৭১৮। )
দলীল নং-২
————–
أما رواية الطبراني وابن حبان عن معاذ فقد قال فيها المنذري في الترغيب والترهيب إسناده لا بأس به، وهي: “يطلع الله في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن”
অর্থ : হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মধ্য শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ পাক রহমতের তাজাল্লী ফরমান এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, মুশরিক বা শত্রুতাপোষণকারী ব্যক্তি ব্যতীত।
(তথ্য সূত্র: (১). ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৮৩৩। (২).সহীহ ইবন হিব্বান, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-৩৫৫, হাদীস নং ১৯৮০। (৩) মুজামুল কাবীর, খণ্ড-১৫, পৃষ্ঠা-২২১। (৫).ফাজায়েলুল আওকাত, পৃষ্ঠা-১১৯, হাদীস নং-২২। (৬).আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪১।)
দলিল নং-০৩
————
روى الترمذي عن عائِشَةَ قالَتْ فَقَدْتُ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فإِذا هُوَ بالبَقِيعِ، فقالَ “أَكُنْتِ تَخَافينَ أَنْ يحيفَ الله عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ؟ قلت: يا رسولَ الله ظَننْتُ أنكَ أتَيْتَ بَعْض نِسَائِكَ،…… فقالَ: إنّ الله عزّ وجلّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إلى السَمَاءِ الدّنْيَا فَيَغْفِرُ لأكْثَرَ مِنْ عَدِدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ” .
হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা) হতে বর্ণিত; এক রাত্রিতে আমি হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে না পেযে খুজতে খুজতে জান্নাতুল বাকীতে পেলাম, …এবং হুযুর ফরমালেন-আয়েশা তুমি কি জানো.? আজ ১৫ই শাবান এর রাত্রি এবং এই রাত্রিতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি আহবান করতে থাকেন যে, কেউ কি আছো যে আমার থেকে কিছু আশা কর, আমি আজকে তা প্রদান করিব । …এবং হুযুর আরো বলিলেন যে, নিশ্চই আল্লাহ শাবানের মধ্যরাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন, “এই রাত্রিতে আল্লাহ বানু কালব গোত্রের বকরির লোম এর চেয়ে বেশি পরিমান গুনাহগার লোক কে ক্ষমা করে থাকেন।”
(তিরমিজি শরিফ,খন্ড:-০২,হাদিস-৭
#শবে বরাতে নির্ধারিত আমল কি.?
সেসব হাদীস শরীফ থেকে শবে বরাতের যেসব আমল পাওয়া যায় সেগুলো হলোঃ-
________________________________________________
১। ইস্তিগফার তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা।
২। কবর যিয়ারত করা।
৩। নফল ইবাদত করা, যেমন নামাজ পড়া, কুরআন
তেলাওয়াত করা, জিকির আজকার করা।
৪। পরদিন রোযা রাখা।
৫। এ রাত উপলক্ষ্যে ফকীর মিসকিনকে দান-খয়রাত
করা অতি উত্তম। কেননা দান-খয়রাতের কথা পবিত্র
কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ
রাত যেহেতু মহিমান্বিত, এ রাতের দান-খয়রাত বিনা
দলীলে পূণ্যময় কাজ।
#শবে বরাতে বর্জনীয় কাজ:
____________________________
১। আতশবাজি।
২। ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক সব কিছু
বর্জনীয়। যেমন গান-বাজনা, নাচ ইত্যাদি।
মা জননী হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন: আমি হুজুর ﷺ কে বলতে
শুনেছি, এমন চারটি রাত রয়েছে, যাতে আল্লাহ
তাআলা সকল মানুষের উপর নেকীর দরজা খুলে
দেন। এগুলো হচ্ছে- ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদ্বহা,
শাবানের মধ্যবর্তী রাত ও আরাফাতের রাত্
এগুলোতে আল্লাহ তাআলা মানুষের বয়স, রিযিক ও
হজ্জ্বের ব্যাপারে নির্দেশনাদি লিপিবদ্ধ করে
দেন।
(গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃষ্ঠা: ৩৬২)।
হযরত আয়েশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) থেকে
বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এক রাতে মহানবী
( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ঔয়া সাল্লাম )-কে বিছানায় পেলাম
না। তাই আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে খোঁজাখুঁজি
আরম্ভ করলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, তিনি জান্নাতুল
বাকীর মধ্যে মহান আল্লাহর প্রার্থনায় মগ্ন। তখন
তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা!
আমার নিকট হযরত জিবরাইল ( আলাইহি ওয়া সাল্লাম )
উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আজ রাত হল
নিসফে শাবান ( অর্থাৎ, লাইলাতুল বারাআত )। এ রাতে
আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে জাহান্নামবাসী
লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।
এমনকি কালব বংশের বকরীগুলোর লোম
সমপরিমাণ ( কালব বংশের বকরীগুলোর শরীরে,
অন্য বকরীর তুলনাই লোম বেশী ) গুনাহগার বান্দা
হলেও। – ( তিরমীযি শরীফ , হাদীস নং- ৭৩৯ )
বিখ্যাত আলেমগণের মতে শাব এ বারাত
# ইমাম শাফেয়ী বলেন-
ﻭ ﺑﻠﻐﻨﺎ ﺃﻧﻪ ﻛﺎﻥ ﻳﻘﺎﻝ ﺇﻥ ﺍﻟﺮﻋﺎﺀ ﻳﺴﺘﺠﺎﺏ ﻓﻲ ﺧﻤﺲ ﻓﻲ
ﻟﻴﺎﻝ ﻓﻲ ﻟﻴﻠﺔ ﺟﻤﻌﺔ ﻭ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻷﺿﺤﻰ ﻭ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻔﻄﺮ ﻭ ﺍﻭﻝ
ﻟﻴﻠﺔ ﻣﻦ ﺭﺟﺐ ﻭ ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ
আর আমাদের নিকট এরূপ বর্ণনা এসেছে যে,
নিশ্চই পাঁচটি রাতে বান্দার দুআ’র জবাব দেয়া হয় অর্থাৎ
দু’আ কবুল করা হয়, জুমার রাত, ঈদুল ফিতর, ঈদুল
আযহার রাত, রজবের প্রথম রাত এবং শাবানের মধ্য
রাত (শবে বরাত)।
[আল উম্ম, ১:২৩১/২:৪৮৫, ইবনে রজব লাতায়িফুল
মা’আরিফ ১:১৩৭]
# খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহঃ বসরায় তার
গভর্নরকে লিখেন-
ﻋﻠﻴﻚ ﺑﺄﺭﺑﻊ ﻟﻴﺎﻝ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﻓﺈﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻳﻔﺮﻍ ﻓﻴﻬﻦ ﺍﻟﺮﺣﻤﺔ
ﺇﻓﺮﺍﻏﺎ ﺃﻭﻝ ﻟﻴﻠﺔ ﻣﻦ ﺭﺟﺐ ﻭﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ
ﻭﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻔﻄﺮ ﻭﻟﻴﻠﺔ ﺍﻷﺿﺤﻰ
বছরে চার রাতের ব্যাপারে তোমার সতর্ক থাকা
প্রয়োজন, কেননা আল্লাহ্ তা’আলা ঐ
রাতগুলোতে তার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে
দেন। তা হল, রজবের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রাত
এবং ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত।
[ইবনে রজব লাতায়িফুল মা’আরিফ ১:১৩৭]
# ইবনে তাইয়িমাহ তার স্বীয় ফতোয়া গ্রন্থে
লিখেছেন-
ﺇﺫَﺍ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟْﺈِﻧْﺴَﺎﻥُ ﻟَﻴْﻠَﺔَ ﺍﻟﻨِّﺼْﻒِ ﻭَﺣْﺪَﻩُ ﺃَﻭْ ﻓِﻲ ﺟَﻤَﺎﻋَﺔٍ
ﺧَﺎﺻَّﺔٍ ﻛَﻤَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻳَﻔْﻌَﻞُ ﻃَﻮَﺍﺋِﻒُ ﻣِﻦْ ﺍﻟﺴَّﻠَﻒِ ﻓَﻬُﻮَ ﺃَﺣْﺴَﻦُ
যদি কোন ব্যক্তি একাকী অথবা নির্দিষ্ট জামাতের
সাথে শা’বানের মধ্য রাতে ইবাদত করে যেমনটা
সালফে সালেহীনগণ করতেন অবশ্যই তা অধিক
উত্তম হবে।
[মাজমাউ’ল ফতওয়া ফতোয়ায়ে তাইয়িমাহ, ২৩তম খণ্ড,
১৩১ পৃষ্ঠা]
ﻭَﺃَﻣَّﺎ ﻟَﻴْﻠَﺔُ ﺍﻟﻨِّﺼْﻒِ ﻓَﻘَﺪْ ﺭُﻭِﻱَ ﻓِﻲ ﻓَﻀْﻠِﻬَﺎ ﺃَﺣَﺎﺩِﻳﺚُ ﻭَﺁﺛَﺎﺭٌ
ﻭَﻧُﻘِﻞَ ﻋَﻦْ ﻃَﺎﺋِﻔَﺔٍ ﻣِﻦْ ﺍﻟﺴَّﻠَﻒِ ﺃَﻧَّﻬُﻢْ ﻛَﺎﻧُﻮﺍ ﻳُﺼَﻠُّﻮﻥَ ﻓِﻴﻬَﺎ
ﻓَﺼَﻠَﺎﺓُ ﺍﻟﺮَّﺟُﻞِ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻭَﺣْﺪَﻩُ ﻗَﺪْ ﺗَﻘَﺪَّﻣَﻪُ ﻓِﻴﻪِ ﺳَﻠَﻒٌ ﻭَﻟَﻪُ ﻓِﻴﻪِ
ﺣُﺠَّﺔٌ ﻓَﻠَﺎ ﻳُﻨْﻜَﺮُ ﻣِﺜْﻞُ ﻫَﺬَﺍ
শাবানের মধ্য রাতের ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদীস
এসেছে, আছার তথা সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা,
তাবে তাবেঈগন সালফে সালহীগনের বক্তব্য
রয়েছে আর তারা এই রাতে ইবাদত করতেন।
সালফে সালেহীনদের মধ্যে এ রাতে ইবাদতের
ব্যাপারে আন্তরিকতা ও একাগ্রতা পাওয়া যায় এবং এ
ব্যাপারে (শবে বরাত) কোন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়
নি।
[মাজমাউ’ল ফতওয়া ফতোয়ায়ে তাইয়িমাহ, ২৩তম খণ্ড,
১৩২ পৃষ্ঠা]
# এমনিভাবে ফিক্বহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব
আদ্দুররুল মুখতারে শবে বরাতের সম্পর্কে বলা
হয়েছে।
[১ম খণ্ড,২৪-২৫ পৃষ্ঠা]
মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের সবাইকে এ রাতে বেশি বেশি আমল করার তাওফিক দান করুন। আমার জন্য বেশী করে দোয়া করবেন। আমিও সকলের জন্য দোয়া করব ইনশাআল্লাহু তাআলা আজ্জা ওয়াজাল্লা। আমিন।