জলকদর সমাচার: লোকজ সংস্কৃতির বাহন
পর্ব-০২
মুহাম্মদ মোখতার হোছাইন সিকদার
প্রথমেই বলে নিতে হয় যে, জলকদর নামটা কেন রাখা হলো তা আমার জানা নেই। কারও থেকে চেষ্টা করেও জানতে পারলাম না। যদি কোনো দিন জানার সুযোগ হয় জ্ঞানসম্ভারে আরও একটি নতুন তথ্য যোগ হবে।আসল কথায় আসি। যে জলকদর নিয়ে আজ লিখতে বসলাম তা অন্তত বাঁশখালীর কারও অপরিচিত কিছু নয়। বরং অতি পরিচিত একটি নাম ‘জলকদর’। এই জলকদর খাল আমাদের প্রিয় জম্মভূমি বাঁশখালী উপজেলার উত্তর-দক্ষিণের বুকচিরে ধেয়ে চলা একটি খাল আর একটু ভিন্নভাবে যদি বলি তাহলে এভাবেই বলতে হয় যে, বাংলদেশের দক্ষিণের প্রাচীনকালের বিখ্যাত খাটখালী নৌ-ঘাট বা নৌ-বন্দর হয়ে শেখেরখীলের ফাঁড়ির মুখ হয়ে উত্তর দিকে বয়ে যাওয়া এবং বাঁশখালীর উত্তরের আরেক নৌঘাট ঈশ্বরবাবুর হাট হয়ে সাঙ্গুনদীতে মিশে যাওয়া জোয়ার-ভাটার এ খালটির জনশ্রুতি মোতাবেক নাম ‘জলকদর’। যদিও এ খালটির উত্তর দিকে অনেকাংশে আজ ভরাট খালে রুপান্তরিত প্রায়। এই জলকদরের দু’পাশে আছে অনেক সরু খাল বা পাহাড়ি ছড়ার সংযোগ। এই খালটি কি শুধু একটি খাল? না তার আরও অনেক পরিচয় আছে? এই খালটি আজ থেকে কয়েক যুগ আগেও বাঁশখালীর শুধু নয় দেশের সর্ব দক্ষিণের জনপদ কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া-পেকুয়াসহ নানা লোকালয়ের ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানাবিধ প্রয়োজনে যোগাযোগমাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হতো এই জলকদর। আমাদের পূর্বের জনপদ সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার লোকজনও চট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসাবে এ জলকদরকে ব্যবহার করতেন।
জনশ্রুতি মোতাবেক আরও একটু দূর অতিতের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয়, আমাদের এই জলকদরকে যোগাযোগের নিরাপদ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতেন আমাদের পার্শবর্তী দেশ র্বামা বা আজকের মিয়ানমার। বার্মা বা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য, রেঙ্গুন ও মন্ডু শহরের বণিকরাও এশিয়ার বিখ্যাত বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধি ও অব্যাহত রাখতে আমাদের এ প্রিয় জনপদের ভিতর দিয়ে বহমান খাল জলকদরকে ব্যবহার করতেন। জলকদরের দু-পাশে জনবহুল ঘনবসতি থাকায় সেকালের নাইয়্যা-মাঝিরা এটাকে সমধিক নিরাপদ নৌ-রোড মনে করতেন। নিরাপত্তার জন্য এ খালের ব্যবহার ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
এ জলকদর খাল বহু ঘটন-অঘটনের নীরব সাক্ষী। জলকদর তার বুকে ধারণ করে রেখেছে বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার রিক্ত-সিক্ত-তিক্ত ইতিহাস। আমাদের ছোটবেলায়ও দেখতাম এই জলকদরের দু’পাশের বউ-ঝিয়েরা খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে নাইয়্যা মাঝিদের সুরেলা কন্ঠে গেয়ে যাওয়া গানের আওয়াজে মুগ্ধ হতে। কত বরযাত্রী বড় বড় সাম্পান ও বোটে করে লহরী সাজে সজ্জিত হয়ে এ জলকদর দিয়ে যেত তার কোনো ইয়াত্তা ছিল না। সে বরযাত্রী সমেত সাম্পান-বোটগুলো যখন যেত নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবা, তরুণ-তরুণীরা জলকদরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সে বরযাত্রা অবলোকন করতেন। আমাদের নিজেদের জীবনের প্রভাত বেলায়ও অর্থাৎ পচিঁশ-ত্রিশ বছর আগেও দেখলাম কতশত বরযাত্রা ইস্টিমারে চড়ে এই জলকদর দিয়ে কনেবাড়ি গিয়ে নতুন বউ নিয়ে এসে ঘরে তুলতে। কত যুবতীকে রাতের আঁধারে বোট-সাম্পানে করে এ খাল দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিতেন সেকালের উশৃংখল যুবকরা। আজকের দিনের মত দূর-অতীতে ইঞ্জিন চালিত-বোট ট্রলার ছিল না বললেই চলে। তখন ছোট বড় সাম্পান ও ডিঙ্গি নৌকার ব্যবহারের প্রাধান্য ছিল বেশি। সাম্পানসমূহে ছিল লৈঁয়-পৈঁয়, লগি-বৈঠা, নোঙ্গর, সিঁড়ি, সোয়ান/সোপান, পাল, স্বর ইত্যাদির সাহায্যে নৌকা সাম্পান দ্রুত চালাতেন।
এই খাল এক সময় লোকাল বা লোকজ সংস্কৃতির আদান প্রদানেও ভূমিকা রাখতো। বহুমাতৃক ভাষা ও সাংস্কৃতিক মানুষের মিলন-চলন গঠিয়ে এই খাল আশ পাশের এলাকাসমূহে মিশ্র-সাংস্কৃতিক বলয় তৈরী করে। আজও সেই নমুনা সচেতন মহল লক্ষ্য করলে অনায়াসে বুঝতে পারবেন। জলপথ যেহেতু সেকালের প্রধান যেগাযোগ মাধ্যম ছিল তাই সাংস্কৃতিক আদান-প্রধানের কাজও এই পথে হতো। আজকের দিনে অবশ্যই স্থল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও হাওয়ায়ী পথের যোগাযোগ ব্যবস্থাও কম যায়নি। এখন আর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে সেই সেকেলে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে না । আকাশপথে ও হাওয়ায়ী পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার আজ শুধু উন্নতিই হয়নি চরম উন্নতি বলতে হবে। সবকিছুকে ছাড়িয়ে এখন ভাষা ও সাংস্কৃতির বাহন হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে বৈদ্যুতিক-হাওয়ায়ী মাধ্যম ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমু স্কাইপি ও ইমেইল, জি-মেইল ইত্যাদি। এই ইন্টারনেট আজ দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। এখন শুধু আঞ্চলিক ভাষা ও সাংস্কৃতিক বহুমাতৃকতা নয় আপনাকে আর্ন্তজাতিক বহুমাতৃকতাকেও মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতিতে যায় না এমন অনেক প্রাচ্য-প্রাশ্চত্য সংস্কৃতির হামলা অনায়াসে মোকাবেলা করে নিজস্ব সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত থাকা কম কষ্টসাধ্য নয়। তাই সাধু-সাবধান। অনেকের মাঝে যেন আমি নিজেকে না হারাই। পথহারা শিশু যেমন যেই ডাকে তার কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ঠিক তেমনি আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষার কথা যদি ভুলে গিয়ে নিজেকে অনেকের মাঝে হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমি নিজ বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে শত্রুর বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্যও হতে পারি। এমনটা হলে সকলের জন্য সর্বনাশের কারণ হতে পারে। তাই আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক পরিচয় আমাদেরই সমৃদ্ধ করতে হবে। জলকদরের ঘাটে ঘাটে নৌকা সাম্পানের মাঝি-মল্লারা যেখানে নোঙ্গর করতেন সেখানেই র্দীঘ দিনের আসা যাওয়ার সূত্রে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে হতে দেখা যেত এক সময় আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরী হয়ে যেত। এভাবেই এক জায়গার মানুষের সাথে অন্য জায়গার মানুষের ভাষা-ভাব ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটে যেত।
এ খালের দুই পাশে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির প্রধান অংশ হলো খেটে খাওয়া মানুষেরা আমন-বোরোর মৌসুমী চাষাবাদ করে গোলার ধান, খোলার চাল, পুকুর-ডোবায় ভরা হরেক রকম মাছের ঘের, মাঠে উৎপাদিত তরী-তরকারি চাষাবাদ করে পরিবারের উন্নতির জন্য রাত দিন জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন। আবার মাঝি-মল্লার সারিতেও দেখা যেত আমাদের গ্রাম্য খেটে খাওয়া মানুষদের । লবণ চাষ করা বাঁশখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষদের বহুকালের প্রাচীন পেশা। আর এসব লবণ চট্টগ্রাম বা পটিয়ায় চালান করে বাজারজাত করতেন এতদাঞ্চলের লোকেরা এই জলকদর দিয়ে। এসব দেশে উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে ব্যবহার হতো ডিঙ্গিনৌকা, গদু নৌকা, ছোট বড় সাম্পান, ইঞ্জিন বোট ইত্যাদি। আবার মানুষদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার হতেন লঞ্চ, ইস্টিমার ও স্পিট বোট ইত্যাদি। তবে জমিদার শ্রেণীর মানুষজন ছোট ডিঙ্গিনৌকা করে আয়েশী সফর করতেন দূর থেকে দূরান্তরে।
(চলবে…)