‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ : প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ

রায়হান আজাদ: ভাষা মহান আল্লাহর দান। আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। ভাষা, বিবেক এবং জ্ঞান ও বুদ্ধির জোরেই মানুষ তামাম মাখলুকাতের মাঝে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করেছে। স্থান ও কালের প্রবাহে ভাষার ভিন্নতা বিদ্যমান। ধর্ম,বয়স ও বসতি আবিস্কারের জন্য ভৌগোলিকতার চেয়ে ভাষার গুরুত্ব¡ কোন অংশে কম নয়। তেমনিভাবে ভাষা শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতহাস-ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিত্বেরও বহি:প্রকাশ। মাতৃভাষা বেড়ে ঊঠার ভাষা। মায়ের মত তার গুরুত্ব। দুনিয়ার সাথে ব্যক্তির যোগসূত্র স্থাপিত হয় এ ভাষার মাধ্যমে। মাতৃগর্ভে জন্মবিহীন যেভাবে পৃথিবীতে আগমন সম্ভব নয় তেমনি কেউ মাতৃভাষা জানে না,ভালবাসে না-সেটা কল্পনা করাও অবান্তর। তাই মাতৃভাষা বাংলা মায়ের মতো বিরাজমান ও অতীব প্রিয়। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন দেশবাসীর জন্যে গৌরবময় ঐতিহ্য ।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন
————————-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা অনুসারে ব্যক্তি থেকে সমাজ আর সমাজ থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি । ব্যক্তির ভাষা মাতৃভাষা । সমাজের ভাষা মাতৃভাষা। তাহলে সমাজ থেকে রাষ্ট্র গঠিত হলে রাষ্ট্রের ভাষা কেন মাতৃভাষা হবে না-সেটা বোধগম্য নয়। এ সহজ যুক্তি, স্বভাবত: ও শাশ্বত দাবী মেনে না নেয়ায় পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের অবতারনা । কোন সংগঠন – সংগ্রাম শুরু না হলেও বাংলা ভাষার দাবী এরও অনেক আগের। যারা দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অদূরদর্শী চিন্তাপ্রসূত ‘মুসলমানদের একটি মাত্র ভাষা উর্দু চেতনা’ বস্তুতপক্ষে এ সমস্যার জন্ম দেয় এবং উপমাহদেশের রাজনীতিতে সূদুর প্রসারী প্রভাব ফেলে। অনুরূপভাবে ১৯২৯ সালের নেহেরু রিপোর্টে জহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেন যে, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দিকে বেছে নেয়ার মূল কারণ এই যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের মাধ্যম হল হিন্দি। এভাবে ভাষার প্রশ্নে দেশ বিভক্তির আগে থেকেই বিতর্কের ঝড় বইতে থাকে। পাকিস্তানের মুসলিম নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে,উর্দু ভাষা অন্যতম ইসলামী ভাষা। এ ভাষায় আরবী ও ফারসী শব্দের আধিক্য থাকায় তারা উপমহাদেশের সকল মুসলমানের উপর এ ভাষা চাপিয়ে দেয়ার জন্য যুক্তি খাড়া করে । তারা এও বলে যে, হিন্দুদের মত মুসলমানদের ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যম হিসেবে সমগ্র পাকিস্তানে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সাথে এ ভাষার কিংবা মুসলমান হওয়ার জন্য মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে উর্দু কিংবা আরবী ভাষা শিখতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তারা সম্পূর্ণ এককেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় তাড়িত হয়ে ভারতের দেখাদেখি পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বছরের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উপেক্ষা করে,গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বাধীন দেশের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা হওয়া সত্বেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করতে উদ্যত হয়। তাদের ভাবখানা বুঝতে পেরে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্টে দেশবিভক্তির পূর্বেই এদেশের সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকগণ খোলামেলাভাবে মতামত পেশ করেছেন পত্র-পত্রিকায়। ১৯৪৩ সালে মোহাম্মদী পত্রিকায় খ্যাতনামা সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন “উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করিয়া আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক,সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পকে রূপায়নে হাত দিতে পারবো। জাতির যে অর্থ, শক্তি, সময় ও উদ্যম উর্দু প্রবর্তনে অপব্যয় হইবে তাহা যদি আমরা শিক্ষা সাহিত্যে নিয়োজিত করি তবে পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা শুধু ভারতে নয়, সমগ্র জগতের একটি শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারিবো। (মাসিক মোহাম্মদী কার্তিক-১৩৫০) এ সময়ে কবি ফররুখ আহমদ “পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য” প্রবন্ধে লিখেন,“ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তিত করিলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হইবে এই তাহাদের অভিমত। কী কুৎসিত পরাজয়ী মনেবৃত্তি এর পেছনে কাজ করিয়াছে এ কথা ভাবিয়া আমি বিষ্মিত হইয়াছি”। (মাসিক সওগাত আশ্বিন- ১৩৫৪) তাছাড়া ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, চৌধুরী খালেকুজ্জমান, আবদুল হক, মাওলানা আকরাম খাঁ, আবুল কালাম সামসুদ্দিন, মুজীবুর রহমান প্রমুখ বুদ্ধিজীবি বক্তব্য ও প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন।

তমদ্দুন মজলিশ
——————–
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৫ দিনের মাথায় ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সাল এ দাবি আদায়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদগণের সমন্বয়ে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। মূলত: ভাষা আন্দোলনের একক রূপকার ও কৃতিত্বের দাবীদার এ তমদ্দুন মজলিশই। এ সংগঠনের উদ্যোগে সর্ব প্রথম ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’? শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এ পুিস্তকায় অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, এবং অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার আহবান সম্বলিত তিনটি নিবন্ধ ছাপানো হয়। তমদ্দুন মজলিশ ও ভাষা আন্দোলনের অভিযাত্রা সম্পর্কে ভাষা সৈনিক সাংবাদিক সানাউল্লাহ নুরী এক সাক্ষাতকারে বলেন, “ ঢাকার আরমানিটোলার ‘নূরপুর ভিলায়’ ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সাল তমদ্দুন মজলিশের এক মিটিংয়ে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এ মিটিংয়ের সভাপতি ছিলেন ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে লিখিত আবুল মনসুর আহমদের প্রবন্ধ পঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন, কাজী আকরাম হোসেন, কবি জসিম উদ্দিন, প্রিন্সিপ্যাল ইবরাহীম খাঁ অধ্যাপক শাহেদ আলী, আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম। পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ ছিল আদর্শবাদী কর্মীদের বৈজ্ঞানিক সংগঠন। চিন্তা-বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবন মারফত সর্ব মানবীয় কল্যাণদর্শী আদর্শ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমই এর লক্ষ্য। নভেম্বর মাসে সফররত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের পক্ষ হতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপিটি পাঠ করে শুনান তৎকালীন ডাকসুর জিএস পরবর্তী কালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম।

একই সময় করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। ৫-৬ ডিসেম্বর এ সুপারিশের প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র-শিক্ষক জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ মাসেই তমদ্দুন মজলিসের নুরুল হক ভুঁইয়াকে আহবায়ক করে প্রথম রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাজার হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারকে স্মারকলিপি দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১১-১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘটে আহত হয় বহু সংখ্যক, গ্রেপ্তার করা হয় ৬৯জনকে। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে আপনাদের বলে দিতে চায় যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ অন্য কোন ভাষা নয়”। একই কথা তিনি কার্জন হলের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও বলেন। প্রতিবারেই ছাত্র জনতা নো নো বলে প্রতিবাদ জানায়।

২১ফেব্রুয়ারির শাহাদাত
——————————-
এমনিভাবে কয়েক বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম অতিবাহিত হয়। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকায় পাকিস্তান মুসলিগের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন বলেন,“পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হয়ে উঠছে”। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার ফুঁসে উঠে। কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ঢাকা বার লাইব্রেরীতে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ও পরিষদের উদ্যোগে ৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। আন্দোলন দিন দিন তীব্রতর হলে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার এক মাসের জন্য সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করে জনসভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করে। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশ মারমুখো একশান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে অবস্থান করে। ছাত্ররা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ জনের একেকটি দল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো মাত্র পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালায়। গুলিতে ২১ জন হতাহত হয়। আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় অসংখ্য মেধাবী ছাত্রকে। শহাদাত বরণ করে এম.এ শেষপর্বের ছাত্র আবুল বারাকাত, আবদুল জব্বার, রফিক উদ্দিন এবং গুরুতর আহত হয় আবদুস সালাম;পরবর্তীতে মারা যায়। এ খবর শুনে আইনসভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ প্রতিবাদী বক্তৃতা দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করেন। সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকা শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। পর দিন ৩০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় আগত জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে আবার ঢাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পুলিশের পাশাপাশি ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে জনতার উপর হামলা চালায়। বন্দুকের গুলিতে ঘটনাস্থলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শফিউর রহমান, রিক্সা চালক আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ সহ আরো অনেকে। এদিকে সরকার ১৪৪ ধারার পাশাপাশি রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে। একইভাবে ২৩ ফেব্রুয়ারিও ১৪৪ ধারা উপেক্ষা উত্তপ্ত জনতা ঢাকা নগরীতে হরতাল পালন করে । ছাত্র শিক্ষক সকলে কালো ব্যাজ ধারন করে আর বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিকেলে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষনা করেন। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ আন্দোলনকারীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। কিছুতেই বাঙ্গালীর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম দমাতে না পেরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার নমনীয় হয়ে পড়ে। তারা যৌথভাবে ঘোষনা দেয়, “বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রাদেশিক প্রস্তাব গণ পরিষদে গৃহিত হওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক দোষীদের শাস্তি বিধান এবং নিহতদের পরিবারকে ক্ষতি পূরণ দেয়া হবে”। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় এবং সরকারিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রথম শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষনা করা হয়। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য যে আন্দোলন-সংগ্রাম ও আত্ম ত্যাগ মাথা পেতে নেয়া হয়েছে তার নজীর পৃথিবীতে বিরল। ভাষার জন্য আঘাত- শাহাদাত,জেল-জুলুম,বহিষ্কার ও অনশন সত্যিই আর কোথাও নেই। এই অতুলনীয় কুরবানি ও অসীম দরদের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে জাতি সংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষনা করেছে। ফলে একুশের তাৎপর্য এবং বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা বিশ্বব্যাপী আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছে।

আজকের বাংলাদেশ
————————–
বহু শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা ভাষা বাংলা অর্জিত হয়েছে। একটি ভাষার নিরংকুশ রাষ্ট্রীয় ব্যবহারের জন্য যে স্বাধীনতাটুকু প্রয়োজন ছিল তাও আমরা লাভ করেছি। কিন্তু বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার কতখানি কদর করতে পেরেছি। ভাষাভিত্তিক জাতি সত্তার বিকাশ কতদূরইবা এগিয়ে গেল? ব্যাপক গবেষণা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য কিরূপ সমৃদ্ধ হল ? ২১ ফেব্রুয়ারির কোরবানি কাজে লাগানো গেছে কি? ভাষা আন্দোলনের চেতনা সম্পর্কে কাজী গোলাম মাহবুব বলেছেন,“আমাদের একটা স্বাধীন সত্ত্বা আছে। মূল বিষয়টা হচেছ,ভাষা আন্দোলনের চেতনা যা ছিল তা হল আমরা একটা স্বাধীন জাতি, স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে আমাদের বিকাশ। আমাদের বিকাশের পক্ষে যে কোন রকম বাধা হোক না কেন, যে কোন রকম ষড়যন্ত্র হোক না কেন তার বিরুদ্ধে পরাভূত না হওয়া ”। বর্তমানে আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার পরও আমরা এর গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলদ্ধি করছি না। এখনও শাসন-প্রশাসন,শিক্ষা-দীক্ষা ও আইন- আদালতের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন হয় না। ইংরেজী বলতে পারলেই মনে করা হয় উচ্চ শিক্ষিত ও স্মার্ট।

দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হয় ১০০% ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজে। বড় হলে তারা পাড়ি জমায় ইংল্যান্ড,আমেরিকা, কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়ায়। ফলে তারা মায়ের মুখের আঞ্চলিক ভাষা জানলেও শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে জানে না। বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজি নয়, বাংলার সাথে ইংরেজী শিখলেই যথার্থ অর্থে সাফল্য অর্জন সম্ভব হতে পারে। ভাষা সৈনিক মরহুম সানাউল্ল¬াহ নুরী ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার বিষয় আলোকপাত করে বলেন,“বাংলায় এখনও আমাদের উচ্চ শিক্ষা স্তরের পাঠ্য রচিত হয়নি। হাইকোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়-সকল স্তরে বাংলা ভাষা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বইগুলো অভিজ্ঞ লোক দিয়ে বাংলা করাতে পারলে জাপান ও চীনের মতো মাতৃভাষা আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো। শহীদের আত্মত্যাগের ফল এখনও আমরা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এটা আমাদের বড় ব্যর্থতা।” ভাষা আন্দোলন আমাদের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য-অনুপ্রেরণা। এ সংগ্রামী ঐতিহ্য ও অমিত প্রেরণার যথাযথ মূল্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমুন্নত রাখা আজকের সময়ের দাবী। বাংলায় জন্ম গ্রহণ করে বাংলাকে অবজ্ঞা করা মারাত্মক অপরাধ। কথাবার্তা ও অফিস-আদালতে বাংলা এড়িয়ে চলা জন্মদাত্রী মাতাকে অস্বীকার করার শামিল। তাইতো মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম বলেছেন,“ যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবানী / সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” ইসলামে মাতৃভাষাকে ভালবাসা ও চর্চা করার জন্য সীমাহীন গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুলে আকরাম সা. নিজের মাতৃভাষা আরবিকে ভালবাসতেন। তিনি বলেছেন,“ আরবী ভাষা আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। কারণ এ ভাষা কুরআনের ভাষা,জান্নাতের ভাষা এবং আমার মাতৃভাষা”। অত:এব মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা করার কোন অবকাশ নেই। যারা মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু কিংবা ফার্সী শেখার জন্য উঠে পড়ে লেগে আছেন তারা সত্যিকার অর্থে ইসলামের ক্ষতিই করছেন। একজন মুসলমানের উচিত মাতৃভাষাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া। এরপর কুরআন-সুন্নাহর ভাষা হিসেবে আরবি এবং জাগতিক কল্যাণের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিক্ষা করা । আমাদের দেশে অনেকে বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা বলে মনে করে তা,শেখা ও চর্চা থেকে দূরে থাকেন। তারাও জঘন্য ভুলের মধ্যে বসবাস করছেন। বস্তুত:পক্ষে মাতৃভাষা বাংলা মুসলমানদের ভাষা । যে কোন অজুহাতে এ ভাষাকে হিংসা করলে তা হবে নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের সমতুল্য। মাতৃভাষার উন্নতি -অগ্রগতি মাতৃভূমির উন্নতির জন্য সহায়ক। পৃথিবীর যে সকল ভাষা সমৃদ্ধ ও গতিশীল সে সব রাষ্ট্রও দুনিয়ার বুকে উন্নত বিশ্ব হিসেবে পরিচিত। তাই আসুন,সমাজ ও দেশের সর্বস্তরে বাংলা চর্চা করে একুশের ফেব্রুয়ারির শহীদদের আত্মাকে সান্ত¦না দেই। #

লেখক: বহু গ্রন্থ প্রণেতা, লেকচারার ও কলামিস্ট।
সেক্রেটারী, সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড পলিসি স্টাডিজ
ই-মেইল : [email protected]

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *