‘রাক্ষসী দরিয়ার কথা পরাই তো নঅ যার’

‘রাক্ষসী দরিয়ার কথা পরাই তো নঅ যার’
কাজী সাইফুল হক

২৯ এপ্রিল ১৯৯১। থেকে থেকে মুর্ছা যাওয়ার মতোন একটি দিন। ভয়াল ও ভয়ালতর প্রকৃতিদানব বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অগণিত মানুষের প্রাণ বধ করে। একটেমাত্র রাতের ব্যবধানে উপকূলবাসী মুহূর্তে লানসান। প্রলংঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের নির্মম উচ্ছ্বাসে মানুষ অসহায়-নিঃস্বতার বশ্যতা স্বীকার করে। মানুষের বসবাসের জা’গা তখন বিরানভূমি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নিজের রূপ-রঙ-জৌলুস হারিয়ে বিবর্ণ, বিশুষ্ক, ফিকে এবং ন্যাড়া। ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙায় লাশের দুর্গন্ধ। পানির রঙ হয়ে ওঠে ধূসর। এখানে দিনেরবেলায়ও মানুষের যে সুন্দর বসতি ছিল, কোলাহলমুখর পরিবেশ ছিল, পরদিন এ কথা কারো জন্য বিশ্বাস্য ছিল না! কোথাও বাড়ি-ঘরের কোন চিহ্ন নেই। জনবসতির কোথাও কোন নিদর্শন নেই। সবটে যেন ভেঙেচুরে বিচার দিবসের মাঠ।
ভয়াল-ভয়ঙ্কর কালো রাত ২৯ এপ্রিলের ধ্বংসস্তুপে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মানুষের প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা সাহায্য ও সাহারা হয়ে আসে। উপকূলীয় ও দূর্বল আশ্রয়ের এসব মানুষের করুণ চিত্রের কাছে দারুণ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সংগীতে দিকপাল সিরাজুল ইসলাম আজাদ কণ্ঠে এগিয়ে আসেন। সেইদিন সর্বহারা মানুষের মনোবেদনার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন তিনি।

সিরাজুল ইসলাম আজাদ ২৯ এপ্রিল ১৯৯১-এর হপ্তান্তের মধ্যে তুফানের গান নিয়ে ঝড়ো বেগে দেশবাসীর সামনে আসেন। ‘পাষাণ দরিয়া’ নামে ৫৪৩ মডেলের একটে টেপ রেকর্ডারে নিজের লেখা গানগুলো রেকর্ড করে বিনা পারিশ্রমিকে বাজারে ছাড়েন তিনি। আস্তিনে লুকিয়ে রাখা সেইসব গানের কথা ও সুরে তিনি গেয়ে ওঠেন-
‘পাষাণঅ দরিয়ার পানি নিদয়া বাতাস
দেশ গেরাম ভাসাইয়া নিল গইল্য সর্বনাশ।’

আজ থেকে ২৮ বছর আগের সর্বনাশা ছোবলের ভয়াবহতা তাঁর গানে নির্ণিত হতে দেখি এভাবে-
‘ভাসাই নিল ঘর-বাড়ি যা আছে সম্বল
হাজার হাজার মানুষ নিল গরু আর ছাগল
ছিন্ন ভিন্ন গরি দিল, মাইনষর সুখর বসবাস।’

নির্দয় বাতাস আর পাষাণ দরিয়ার এমন তা-বলীলায় শিল্পীর গানের ভাষা ও কণ্ঠ যেন মূক হয়ে আসে। এমতই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে কিছুতেই তিনি সনাক্ত করতে পারছিলেন না বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি।
‘সিরাজে কয় অরে ভাইয়ান চগই এনা যাই
আঁই যিয়ান দেখি আইলাম, কইবল্যাই ভাষা নাই
বাপর ভিড়া নত চিনলাম বহুত গইল্যাম তালাশ।’

২৯ এপ্রিলের ভয়াবহতার জন্য রাক্ষুসী দরিয়াকে দায়ি করেন গুণী এই শিল্পী। তাঁর সমস্ত বেদন-ছেদন রাক্ষুসী দরিয়াকে ঘিরে। সন্তান-সন্ততি, গোলাভরা ধান, শস্যক্ষেত আর গোয়ালভরা গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির সুখের সংসারে ‘লোভে পাপ’ এথিক্স ভুলে রাক্ষুসী দরিয়া ঢুকে পড়ে মানুষের সংসারে। এমত দৃশ্য শিল্পীর বর্ণনায় ভাষা পায় এভাবে-
‘অরে রাক্ষসীরে দরিয়া
সোনার সংসার গল্লিরে ছারখার নিলিরে ভাসাইয়া
সুখর স্বপ্ন ভাঙ্গি দিলি, আশার বুকত দিলি ছালি
এত ক্যানে অইত পাইল্যি তুই নিমাইয়া।’

রাক্ষুসী দরিয়ার হিংস্রতা-ক্ষিপ্রতা এতটে ভয়াল হবে জানলে মানুষ কূলঘেষে বসত করতে গরগিজ রাজি হতো না, এমতই বলেন তিনিÑ
‘আগে তো নঅ জাইনতাম দরিয়া তুই যে সর্বনাশা
জাইনলে কি আর তোর কূলত বাঁধিতাম বাসা
পাহারত যাই বানাইতাম ঘর
যদিও থাকে বাঘের ডর
তোর মত বিয়াগ্যিন নইনতো কারিয়া।’

বেদনার কথাই কেবল বর্ণিত হয়নি, সান্ত¦না ও শান্তির বাণীও শুনিয়েছেন এই শিল্পী-
‘সিরাজে কয় হুইন্য কথা সর্বহারা ভাই
দইজ্যার লগে কইজ্যা গরি কনঅ লাভ তো নাই
বেয়াগ্যিন তো আল্লাহর খেলা
যার হুকুমে দুনিয়াইত আইলা
তার কাছে শান্তি চ’গই কাঁন্দিয়া।’
অথবা-
‘তোঁয়ারা বই ন’থাইক্য এন গরি
চল আঁরা দুখি জনরে সাহায্য গরি
ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসে যারার গেয়্যি ঘর-বাড়ি।’
দাতার দান কখনো বৃথা যায় না, জানিয়ে গানের কথায় গেয়ে ওঠেন-
‘মানুষল্যাই মানুষ আইস্যে এই দুনিয়ায়
একজনে যেন আরেকজনরে অসময়ে পায়
দানির দানতো কেয়ামতে ছায়া অইব কইত পারি।’

সত্যিই মুসিবতের পর কখনো মুসিবত আসে না। মুসকিল আসানের ব্যবস্থা হয়। এ জন্য প্রয়োজন নিজেদের আন্তরিক চেষ্টা। মুসিবত থেকে পরিত্রাণের জন্য নিজেদের প্রচেষ্টাই হতে পারে সমাধান।
‘চল, ভুলি যাই তুয়ানর কথা, স্বজনহারা মনর ব্যথা
ঘর-বাড়ি গেল এইসব চিন্তা, কিল্যাই গইত্যা অকারণ
আবার ঘর বানাই সংসার সাজাই, সাজাইরে জীবন।’

মানুষের জীবনকে অংকে অংকে আঁকেন তিনি। সিরাজ আজাদ মানুষের জীবনকে গণিতের মৌলসূত্রে দেখাতে গিয়ে বলেন-
‘ভাঙি গেলে বাধন পরে নঅ গইজ্য আফসোস
ত্যাগি যারা এই দুনিয়াইত তারাইতো মানুষ
জীবন অইয়ে অংকের মত, যোগ-বিয়োগ-ভাগ-পুরণ।’

জীবনে শুধু যোগ থাকবে এমন নয়; কিছু বিয়োগ হবে, কিছু ভাগ হবে, এক সময় তা পুরণ হবে।
২৮ বছরে স্বজন-সম্বলহারা মানুষের জীবনে অনেক কিছুর যোগ ঘটেছে। জীবনের অনেক স্বপ্ন অনেক আশা হয়তো পুরণও হয়েছে। কিন্তু ২৯ এপ্রিলের বিয়োগান্তক বিয়োগব্যথার সমাধান যে হয়নি- দিনটি ফি বছর সেই কথায় বলে। তাই ২৯ এপ্রিল এলে মানুষ সিরাজ আক্রান্ত হন। তাঁর গানে সান্ত¦না খোঁজে শান্তি পান।

লেখক: কাজী সাইফুল হক, প্রাবন্ধিক

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *