রবীন্দ্রনজরুলের শেষকৃত্য ও খ্যাতির বিড়ম্বনা
জসিম উদ্দিন তুহিন
রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হলেন। কী অসুখ, কেন-কিভাবে আমার বয়ানের উদ্দেশ্য নয়।
আমার বিষয় হলো মৃত্যুপরবর্তী রবীন্দ্রনাথের লাশ ও শোক মিছিল আর নজরুলের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ।
ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় রবিঠাকুরের অপারেশন হয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কবিরাজি চিকিৎসা। দূর্ভাগ্যক্রমে অপারেশন রবিঠাকুরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। অস্ত্রপচারের চারদিন পর রবীন্দ্রনাথ মারা যান। মৃত্যুর খবর শোনামাত্র শোকে জর্জরিত উন্মত্ত জনতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির কলাপসিবল গেট ভেঙে ভক্তির নামে কবিগুরুর লাশ একরকম ছিনতাই করে টেনে হিচঁড়ে দেহ নিয়ে গেল উন্মাদ জনস্রোতের মাঝখানে।
থেকেথেকে শোক মিছিল এগিয়ে চলছে। মিছিলের মুখে মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি জয়, বন্দেমাতরম ইত্যাদি স্লোগান । যেখানে রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় পুত্র রথীন্দ্রনাথকে সুস্পষ্ট নসিহত করে গিয়েছিলেন, আমার মৃত্যুর পর যেন শোক মিছিলে কোনো উদ্দামতা না হয়। আমার নামে কোন জয়ধ্বনি যেন না দেয়া হয়। কার কথা কে শুনে উল্টো দেখা যায় চিরশান্তি প্রেমিক রবিবাবু নিমীলিতলোচনে মিছিলের মাথায় কেবল অজানা গর্দান আর হাত বদলাচ্ছে। যে পারছে সে টেনেহেঁচড়ে নিজের মাথায় তুলে ফেলছে। এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন অজানার উদ্দেশ্যে। নিচে পড়ে পদদলিত হয়ে রাস্তায় সমাধিস্থ হয়নি ঠিক কিন্তু মাথায়মাথায় যে টানাহেঁচড়া হয়েছিল তাতে এই অশীতিপর বুড়া তুলোপেঁজা মেঘের মতো খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়নি এই হলো মন্দের ভাগ্য।
অবাক করা তথ্য হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখবার জন্য যে যেভাবে পারছে উপড়ে ফেলছে রবিবাবুর শুভ্র চুল, কেশ, দাড়ি এমনকি গোঁফও। মিছিল আরো দীর্ঘায়ু পেলে রবীন্দ্রনাথের আর কী কী উপড়ে ফেলতো ভাবলেই গা শিউরে উঠছে। আরো করুণ তথ্য হলো একমাত্র পুত্র রথীন্দ্রনাথ মুখাগ্নি পর্যন্ত করতে পারেননি। তিনি বাড়িতেই হতভম্ব এবং মুহ্যমান হয়ে শুয়ে ছিল। সম্পর্কিত এক নাতি শোক মিছিলের ঢেউয়ে কলকাতার দিকে নিমতলার ঘাটে যেতে না পেরে হাওড়ায় গিয়ে ওপার থেকে নৌকা করে এপারের ঘাটে আসে এবং কোনমতে মুখাগ্নি করেন। যখন মুখাগ্নি করা হয়, তখন রবীন্দ্রনাথের মুখ বিকৃতির শেষ দশায় একেবারে চেনায় যাচ্ছে না। এই হলো খ্যাতির বিড়ম্বনা আর অতি ভক্তির নামে অমর্যাদা ও অসংজ্ঞায়িত লাঞ্ছনা।
এবার নজরুলের শেষ ইচ্ছে পূরণে আসি।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা হয়। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবি নজরুল অসুস্থ হয়ে লন্ডন আর ইউরোপ ঘুরে এসেও কবি সুস্থ হননি-
১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”:- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।
তার জানাজার নামাজে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। জানাজার নামায আদায়ের পরে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকামণ্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে কবি নজরুল পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাতে হয়নি কোন উন্মত্ত ভক্তের টানাহ্যাঁচড়া ও শুভ্রকেশ উপড়ে ফেলার অঘোষিত প্রতিযোগিতা।
মোদ্দাকথা: এই দুটো ঘটনা উল্লেখ করে আমি কী বার্তা দিতে চাচ্ছি?
বার্তা হলো অতিভক্তি বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। বললে অতুক্তি হবে না রবীন্দ্রনাথের নোবেলপুরস্কারটা যিনি ( অজানা) চুরি করছেন তিনিও সম্ভবত রবিবাবুর অতিভক্ত। তাই অতিভক্তি দেখাতে যাবেন না। খ্যাতির যতটা সুখ সামনে ততটা অসুখ পেছনে।
লেখক: তরুণ প্রাবন্ধিক
তথ্যসূত্র : নজরুলের জন্মশতবার্ষিকী স্মারক ও রবীন্দ্রনজরুল জীবনী প্রাসঙ্গিক নানান প্রবন্ধ