BanshkhaliTimes

যে কথাগুলো কখনো কোন দিন বলা হয় না

  • BanshkhaliTimes
  • যে কথাগুলো কখনো কোন দিন বলা হয় না
    মৌলী আখন্দ

আমি যখন এম পি এইচ কোর্সে ভর্তি হই, ক্লাসে একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর কথা বলে আফসোস করতেন যে, এখন নাকি মেয়েরা ফিগার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ব্রেস্ট ফিডিং করায় না বলে বাংলাদেশে ব্রেস্ট ফিডিং করানোর হার কমে গেছে। যতবার উনি আমাদের সবাইকে এই কথা বলতেন, আমি মনে মনে দাঁতে দাঁত ঘষে বলতাম, “ষ্টুপিড, ইডিয়ট! ”
কেন বলতাম? আমাদের এক কোর্সমেট ছিলো, যে নিজের দুধের বাচ্চা রেখে ক্লাসে আসতো। সে নীরবে চোখের জলে ভেসে ব্রেস্টের ব্যথা অনুভব করে সহ্য করে যেতো, বাসায় তার বাচ্চা ফর্মুলা খেতো। সেই মেয়েটি কি তার ফিগার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ব্রেস্ট ফিডিং করাতো না? না সুযোগের অভাবে? ডে কেয়ার সেন্টারের অভাবে?
৩৯ তম বি সি এস পোস্টিং নিয়ে আসা অনেক নারী ডক্টর তাদের দুধের বাচ্চা রেখে বহুদূরে চাকরিতে যোগদান করেছেন। তাদের কর্মস্থলে বাচ্চা রেখে দুই ঘন্টা সময় পর পর ব্রেস্ট ফিডিং করানোর জন্য একটা জায়গা আছে কি? কিংবা সুযোগ?
জ্বি, আমরা আমাদের নারী শিক্ষার হার বাড়িয়েছি কিন্তু তার সাথে সাথে সেটার আফটার ইফেক্ট চিন্তা করে দেখিনি। (এখন আমাকে বলতে পারেন, মেয়েদের কাজ করার দরকার নেই। এই কথা বলে লাভ হবে না। কারণ আগে চিন্তা করে দেখুন, যে নারীরা বাইরে কাজ করতে না গিয়ে ঘরের কাজে নিজের সবটুকু ক্ষয় করে দিচ্ছে তাদের জন্য কি পরিপূর্ণ সম্মান দেখাতে শিখেছি আমরা? বুকে হাত রেখে বলুন, তাদের কি কখনো না কখনো শুনতে হয় না, “সারা দিন বাসায় থেকে করটা কী?” কিংবা “কামাই তো কর না, করলে বুঝতে! ” আজকের দিনে নারীশিক্ষা সহজলভ্য, সুতরাং তাঁরা কর্মক্ষেত্রে যেতে আগ্রহী হবেন এটাই স্বাভাবিক।)
শুরু করেছিলাম এম পি এইচ কোর্স দিয়ে। আবারও সেখানেই ফিরে যাই। আমার কোর্সের বিষয়বস্তু ছিল মা ও শিশু স্বাস্থ্য। তো তার মধ্যে যখন পড়লাম পরিবার পরিকল্পনা ও হাসপাতালে ডেলিভারির গুরুত্ব, সেটা আমার প্রোফাইলে জনস্বার্থে শেয়ার করেছিলাম। সেখানে মন্তব্যের ঘরে মন্তব্য করেছেন এক মহান ব্যক্তি, “এসব সিজারের ধান্দা! আমাদের নানি দাদীরা বাসায় আট নয়টা বাচ্চা ডেলিভারি করতো, কিচ্ছু হতো না!”
হে অকৃতজ্ঞ মূর্খ! কখনো কোন দিন আপনার নানি দাদীকে একবার প্রশ্ন করে দেখেছেন কি, সমস্যা হয়েছে কি হয়নি! বার বার অপটু হাতে বাসায় ডেলিভারির ফলে তাদের কতোজনের জরায়ু নিচে নেমে আসতো, দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক প্রসবের আশায় বাচ্চা জরায়ুমুখে আটকে থেকে কতোজনের মূত্রনালি ছিড়েখুঁড়ে যেতো, অনবরত পেশাব ঝরে পড়ার কারণে সংসার ভেঙে যায় কতো নারীর, খবর রাখেন?
একটা সময় বিয়ের আগে সংসার, আসন্ন শারীরিক সম্পর্কের জন্য ন্যূনতম মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি নিতে সময় না দিয়েই বাল্যবিবাহের শিকার হতে হতো নারীকে। বিয়ের পরে বৈধ শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতি অসম্মতির প্রশ্ন অবান্তর মনে করে অপ্রস্তুত, অপরিণত, অপরিপক্ব বালিকা বধূর সাজে সজ্জিত হয়ে থাকা নারীর সঙ্গে তার স্বামীর আচরণ তার কাছে নির্যাতন মনে হতো কিনা, তার একাকীত্ব কেমন ছিল, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে কল্পনাও করতে পারি না। একটা সময় গৃহকর্মীর সঙ্গে অবৈধভাবে মিলিত হওয়া ছিলো পুরুষের অধিকার। এ নিয়ে অভিযোগ তুলে লাভ কী, শুধু শুধু নিজেকেই ছোট করা। ঠিক এমনই ভাবতেন সেই সময়ের নারীরা, এমনই ভাবতে শেখানো হয়েছিলো তাদের।
এ তো গেল সত্তর আশি নব্বই দশকের কথা। আজও রোজার দিনে কতো নারী প্রাকৃতিক কারণে রোজা রাখার অবস্থা না থাকলেও সারা দিন ধরে না খেয়ে থাকতে বাধ্য হন, তা কি জানেন? পুরুষ ক্লাসমেট কিংবা সহকর্মীরা যে দেঁতো হাসি হেসে প্রশ্ন করেন, “কি, রোজা আছেন/ আছো/আছিস?” তখন নারীরা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে না কেন, “কেন, রোজা আছি কি নেই, তা আপনার /তোমার /তোর জানা লাগবে কেন? “কেন মাসের এই সময়টা যখন তার পানি বেশি করে খাওয়া দরকার, নারী পুরুষ সহকর্মী বন্ধুদের ভয়ে সারা দিন ধরে না খেয়ে মিথ্যে রোজার অভিনয় করে যায়? কেন এমন দেঁতো হাসি দেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয় না থাপ্পড়, কেন শুনিয়ে দেয় না জবাব?
কারণ, যুগের পর যুগ ধরে তাদের মুখ চেপে ধরে রাখা হয়েছে, বলা হয়েছে, ” চুপ চুপ কাউকে বলো না। ” তাই আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে চুপ করে দোকানীর দেঁতো হাসি সহ্য করে যাই।
আজকের দিনে নারীরা শিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারাটাই যথেষ্ট প্রাপ্তি বলে মনে করলেও নারীর প্রকৃত অবস্থান বুঝতে পারা যায় এখনো তার সাথে ঘটে যাওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ধর্ষণ কিংবা নিপীড়নের বিচার চাইলেও আঙুল তুলে তাকেই বলা হয়, “দোষ তোমারই!”
এই যে কথাগুলো, যা কখনো কোন দিন বলা হয় না, বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে গেলে নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে চুপ করে যাই কিংবা আমাদের চুপ করানো হয়, এই কথাগুলো বলার জন্যই এই গল্পটা।
এখন আমাকে বলতে পারেন, যে দেশে থাকা নারী ধর্ষিত হয়ে খুন হয়ে যায়, সেই দেশে থাকা নারীর একাকীত্ব নিয়ে কথা বলে লাভ কী, যেখানে আমাদের জীবন নিয়ে টানাটানি? হ্যাঁ, তবুও এসব নিয়ে কথা বলা জরুরি, কারণ জীবন রক্ষা করা যেমন অধিকার, তেমনি যাপন করাও মানুষের জন্য অধিকার। এগুলো তো রাষ্ট্রের আইন পাস করে আদায় করা যাবে না। বেঁচে থাকতে হবে, জীবন যাপন নিয়েও ভাবতে হবে।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *