BanshkhaliTimes

মুফতি ইজহার সাহেবের দেখানো পথেই কি অন্যরা হাঁটছে?

BanshkhaliTimesমুফতি ইজহার সাহেবের দেখানো ও শেখানো পথেই কি আজকে অন্যরা হাঁটছে?

তারেকুল ইসলাম

মাওলানা হাফেজ কাসেম, যিনি একসময় হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা পরিচালক ও সহকারী মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তাঁর একটি ভিডিও বক্তব্য ভাইরাল হয়। উনি ভিডিওতে আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগের ১০ লক্ষ টাকার একটি চেক জালিয়াতিতে মুহতামিম আল্লামা শফী সাহেবের ‘সংশ্লিষ্টতা’র (স্বাক্ষর থাকা অর্থে) ব্যাপারে কথা বলেন।

আমরা আলেমদের মধ্যে এমন বিবাদ ও বাদানুবাদ আশা না করলেও দুঃখজনকভাবে কাসেম সাহেবের ভিডিও’র জবাবে হাটহাজারী মাদ্রাসার পেইজ থেকে পাল্টা ভিডিও বক্তব্যও দেওয়া হয়। যার ফলে চেক জালিয়াতির ঘটনাটি যে সত্য ছিল, তা নিয়ে আর সংশয় থাকলো না। আমরা আলেমদের অত্যন্ত ভালোবাসি। কিন্তু যখন তাদের বিবাদ ও বাদানুবাদগুলো পাবলিকলি চলে আসে, তখন কথা না বলে উপায় থাকে না।

যাই হোক, হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম বা প্রিন্সিপাল হিসেবে চেক জালিয়াতিতে আল্লামা শফী সাহেবের স্বাক্ষর থাকার কারণে ঘটনার প্রেক্ষাপটে কতটুকু তিনি দায়ী কিংবা দায়ী ছিলেন কিনা- সে বিষয়ে আমার এই পোস্ট নয়। যদিও আমার প্রবল ধারণা, শফী সাহেবকে হিসাবরক্ষকই ধোঁকা দিয়েছিল।

আমার আগ্রহ বরং ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবরে এই ইস্যুতে মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর দেওয়া একটি বিবৃতিতে। সেটি গতকাল আমার নজরে আসে। বিবৃতিটি যে ওনার দেওয়া, সেটি আমার সোর্স থেকে নিশ্চিত করেছি।

ওনার বিবৃতিটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আজকে ওনার দেখানো ও শেখানো পথেই অন্যরা হাঁটছে। আল্লামা শফী ওনার ওস্তাদ। দেড় দশক আগের চেক জালিয়াতির ঘটনায় ওস্তাদের সম্মান বাঁচানো ওনার কর্তব্য ছিল। কিন্তু তাই বলে সেসময় তার নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে শূরা কমিটিকে ঠেকিয়ে দিয়ে ওস্তাদের সম্মান রক্ষার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল বলে মনে করি না।

কেননা উক্ত ঘটনায় ওস্তাদের সম্মানটা ওনার ব্যক্তিগত বিষয়। শূরা কমিটিও ওনার ওস্তাদের সম্মানের কথা চিন্তা করেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসন দিয়ে শূরা কমিটিকে হটিয়ে দিয়ে ওস্তাদের সম্মান রক্ষা করলেন। যার খেসারত আজকে মুফতি ইজহার সাহেবকে দিতে হচ্ছে বলেই মনে হলো। শুধু তা-ই নয়, আজকে ওনার দেখানো ও শেখানো পথে, অর্থাৎ, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করার পথে যারা হাঁটছে, সময়ের পরিক্রমায় তাদেরকেও পরবর্তীতে খেসারত দিতে হতে পারে।

যাই হোক, মুফতি ইজহার সাহেবের বিবৃতি থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। আংশিক নিচে তুলে ধরছি:

“আজ থেকে ১৩ বৎসর পূর্বে ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় যখন আমি ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় মহাসচিব তখন হাটহাজারী মাদ্রাসার হিসাবরক্ষক একটি ওপেন চেক লিখে হযরত মওলানা আহমদ শফীর নিকট আসেন। চেক লেখার নমুনা ছিল এই রকম ১,০০,০০০ । পাঠক ও দর্শক মহোদয়গণ খুব ভালোভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন যে, কোন প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের নিকট তার হিসাবরক্ষক এরকম একটি ওপেন চেক লিখে আনেন যার নিচে অক্ষরে কিছু লিখা নাই এবং দুই পার্শ্বে অংক বর্ধিত করার অবকাশ না থাকার জন্য কোন রেখা নেই যাতে অংক বৃদ্ধি করার সুযোগ থেকে যায়।

প্রিন্সিপাল মহোদয় এ অবৈধ ও বেআইনী ওপেন চেকের ওপর দস্তখত করার পর তার হিসাবরক্ষক একটি শূন্য বৃদ্ধি করে দুপাশে দুটি টান দিয়ে নিচে অক্ষরে লিখে দিলেন দশ লক্ষ টাকা মাত্র। এবং তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে দশ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে একলক্ষ টাকা মাদ্রাসায় জমা দিয়ে বাকী ৯ লক্ষ টাকা যোগসাজশ করে মেরে দেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সচেতন নাগরিক এই মর্মে অবশ্যই অবগত আছেন যে শরীয়ত ও প্রচলিত আইনের নজরে প্রিন্সিপাল ও হিসাবরক্ষক উভয়ই সমান অপরাধী। প্রিন্সিপালের অপরাধ তার অযোগ্যতা ও গাফিলতী অথবা হিসাবরক্ষককে তহবিল তছরুপের সুযোগ প্রদান। অপরদিকে হিসাবরক্ষক তো অপরাধী বটেই।

এ অবস্থায় এ ঘটনায় যদি ফৌজদারী মামলা হয় তাহলে প্রিন্সিপাল ও হিসাব রক্ষক উভয়ই সমান সাজা ভোগ করবেন। কিন্তু মজলিশে শুরার প্রভাবশালী বিচক্ষণ সদস্যগণ প্রিন্সিপাল ও হিসাবরক্ষকের বিরূদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করে তাদেরকে জাতির সামনে চোর প্রমাণিত না করার জন্য মজলিশে শুরাভিত্তিক একটি পদক্ষেপ গ্রহন করেন। তা হচ্ছে- একজন প্রিন্সিপাল যদি চেক লেখার নিয়ম সম্পর্কে এতই অজ্ঞ ও গাফেল থাকেন তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মত এতবড় জাতীয় দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের পদে বহাল রাখা কোন দিনই যুক্তিসংগত নয়।

তাই তারা মজলিশের শূরার তারিখ নির্ধারণ করে হযরত মাওলানা আহমদ শফীকে প্রিন্সিপালের পদ থেকে অপসারণের প্রস্তুতি গ্রহন করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত মাওলানা আহমদ শফী আমি মুফতি মুহাম্মদ ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী মহাসচিব ইসলামী ঐক্যজোটের নিকট লালখান বাজার মাদ্রাসায় তশরীফ আনলেন। তিনি বিধ্বস্ত বদনে আমাকে বললেন, তুমি আমাকে রক্ষা কর কারণ তুমি জান যে আমি টাকা চুরি করি নাই। আমি একজন সম্মানিত উস্তাদ হিসেবে তাকে বিশ্বাস করে বললাম, হুজুর আপনি চিন্তা করবেন না। বিষয়টি আমি দেখব।

তৎকালীন চলমান ৪ দলীয় জোট সরকারের ৪ মহাসচিবের এক মহাসচিবের কথা ডিসি-এসপি, পুলিশ-বিডিআর সমীহ করাটা ছিল স্বাভাবিক। তার ছেলে মওলানা আনাছ ও অন্যান্য শিক্ষকগণও লালখান বাজার মাদ্রাসায় এসে হযরত মাওলানা আহমদ শফীকে রক্ষা করার অনুরোধ জানালেন।

জ্ঞাতব্য যে, প্রভাবশালী শুরা সদস্যগণের মধ্যে ছিলেন হযরত মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী (মুহতামিম বাবুনগর মাদ্রাসা), হযরত মাওলানা তৈয়ব (মুহতামিম জিরি মাদ্রাসা), হযরত মাওলানা দেলোয়ার (অন্যতম শুরা সদস্য, লাভলেইন তবলীগ মারকাজ), অন্যতম শিল্পপতি চট্টলার কিংবদন্তী দানবীর চাঁনমিঞা সওদাগর মরহুমের নাতি হযরত মাওলানা ওসমান ও হযরত মাওলানা হাফেজ কাসেম।

আমি হযরত মাওলানা আহমদ শফী ও হাটহাজারী মাদ্রাসার অন্যান্য শিক্ষকগণের সম্মানে হযরত মাওলানা আহমদ শফীর পদরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহন করলাম এইভাবে যে, আমার মেঝ ছেলে মওলানা মুসা বিন ইজহারের শাদী হচ্ছিল হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) ছোট সাহেবজাদা হযরত মওলানা হাফেজ ক্বারী আতাউল্লাহর কন্যার সঙ্গে। আক্বদ হওয়ার পরিকল্পনা করেছি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। আমি আমার নোহা মাইক্রোতে করে হযরত মওলানা আহমদ শফীকে হাটহাজারী থেকে বায়তুল মোকররম মসজিদে এনে হযরত মওলানা উবায়দুল হক খতিব বায়তুল মোকাররম (রহঃ) কে অনুরোধ করে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তার খুৎবা ইমামত ও আমার ছেলের আক্বদের ব্যবস্থা করি। পরে সন্ধ্যায় হযরত মওলানা উবায়দুল হক খতিব মরহুমের বাসায় বসে তাকে বুঝিয়ে বললাম- হযরত মওলানা আহমদ শফী একজন সরল মানুষ (তখন আমি সেরকম বিশ্বাস করতাম)। চেকের ঘাপলায় তিনি জড়িত নন। তার হিসাবরক্ষক জড়িত। অথচ মজলিশে শুরার প্রভাবশালী সদস্যগণ তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে বের করতে চাচ্ছে, আপনি উক্ত শুরার একজন প্রভাবশালী সদস্য তাই আপনাকে উক্ত শুরার বৈঠকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। আমি আপনার জন্য বিমানের ব্যবস্থা, গাড়ীর ব্যবস্থা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার গেট পর্যন্ত বন্দর থানা, ডবলমুরিং থানা, পাঁচলাইশ থানা ও হাটহাজারী থানার পুলিশ বাহিনীর এসকর্ট দিয়ে আপনাকে নিরাপদে পৌঁছাব।

খিলগাঁও মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মওলানা নুরুল ইসলামকে দায়িত্ব দিলাম তিনি যেন তার মাদানী নগরের বাসা থেকে এসে খতীব সাহেব হুজুরকে ঢাকা বিমান বন্দরে নিয়ে যান। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য রাত্রে মওলানা নুরুল ইসলামকে ফোন করলে তিনি আমাকে বললেন, রাত্রে টেলিফোনে আমার নিকট অনেক হুমকি এসেছে, আমি খতিব সাহেব হুজুরের বাসা ও বিমান বন্দর পর্যন্ত যেতে পারবনা। আমি উত্তরে বললাম কোনো বাপের ব্যাটার সাধ্য নাই আপনার গায়ে হাত তোলার এবং হযরত খতিব সাহেব হুজুরের সাথে বেয়াদবী করার।

মজলিশে শুরার বৈঠকের দিন আমি নিজে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সকাল ৯/১০ টায় হযরত খতিব সাহেব হুজুরকে রিসিভ করলাম। সাথে ছিলেন ফরিদাবাদ মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম বেফাকের মহাসচিব, আমি অধমের ইফতা বিভাগের ছাত্র (প্রাইভেট) মওলানা আবদুল কুদ্দুসসহ অনেকে। আমরা পুলিশের বিশাল বহর নিয়ে হযরত খতিব সাহেব হুজুরকে নিরাপদে হাটহাজারী মাদ্রাসার গেটে পৌঁছাই।

আগের দিন বিজিবি (তৎকালিন বিডিআর) দিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসার চতুর্পাশ্বে পাহারা বসাই। মজলিশে শুরার বৈঠক শুরু হলে হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউ.এন.ও) ও হাটহাজারী থানার ওসি কে আমি টেলিফোনে ডেকে হযরত মওলানা আহমদ শফীর কামরায় নিয়ে আসি।

শুরার বৈঠক শুরু হওয়ার প্রাক্কালে মাদ্রাসার সমস্ত গেইট বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র সদর গেইট খোলা রেখে সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহাব (রহঃ) সুযোগ্য সাহেবজাদা সাহসী বীরপূরূষ হযরত মওলানা বেদার (রহঃ) ও সাহসী সাংবাদিক জনাব মিজান চৌধুরীসহ আরও অনেককে দায়িত্ব দেই।

তারা মাদ্রাসার প্রধান ফটকে উপস্থিত থেকে হযরত মাওলানা আহমদ শফীর বিরোধী শুরা সদস্যগণসহ সকলকে একে একে বের করে দেন। মজলিশে শুরার সিদ্ধান্ত মতে হযরত মওলানা হাফেজ কাসেম সাহেবকে নোটিশ দিয়ে কয়েকমাসের জন্য বিরতি দেয়া হয় ও বিরোধী শুরা সদস্যগণকে বাদ দিয়ে নতুন মজলিশে শুরা গঠন করা হয়। প্রিয় পাঠক মহোদয়গণ এ লেখার প্রত্যেকটি অক্ষর মহান আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে লিখছি।………”

লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *