মানবতার দিকপাল বাঁশখালীর মুরাল ভাই
ফারুক আবদুল্লাহ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপীঠ এক পবিত্র তীর্থভূমি। যেখানে প্রতিনিয়ত মানবতার জয়গান হয়। এ তীর্থভূমি অনাথ-এতিম হাজার হাজার শিশুর নিরাপদ ঠিকানা। সেখানেই শত শত প্রতিবন্ধী, অন্ধ, হাত-পা বিহীন ও মা-বাবা বিহীন বঞ্চিত নারী, শিশুর বেড়ে উঠা। ‘মানুষ যে মানুষের জন্য’ তা আদ্যাপীঠের অনাথ আশ্রমে না গেলে বুঝা মুশকিল হয়ে যাবে। এ মহান মানবতাবাদী কর্মযজ্ঞের পিছনে নিরলসভাবে নিরবে নির্ভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি এক আলোকবর্তিকা ও মানবতার দিকপাল চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর সন্তান। তিনি এক মানবতাবাদী মানুষের নাম। তাঁর কর্মে, জ্ঞানে শুধুই মানবতার জয়গান। মানবসেবাই তাঁর কাছে বড় ধর্ম। সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিতদের নিয়েই তাঁর যত আয়োজন। তাঁর অনাথ আশ্রমের অনাথ নারী, শিশুকে নিজের সন্তান মনে করে লালন পালন করছেন। তার দিন শেষে রাত কেটে যায় বালক-বালিকা, বৃদ্ধাশ্রমের সেবায়। ছোট ছোট কোমলমতি অনাথ শিশু বাচ্চাদের আদর যত্ন, লেখাপড়ায় সর্বদা মনোনিবেশ করেন তিনি। তার ঠিকানা আদ্যাপীঠে গিয়ে কেউ না খেয়ে ফিরে না। হাজার হাজার নারী ও পুরুষ বিনামূল্যে প্রতিদিন প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন এখানে। অজস্র মানুষের মাঝে মানবতাবাদী, সহজ-সরল, সৎ ও অনাথ শিশুদের আলোর দিশারী পরিব্রাজক ব্রহ্মচারী সদা মুচকি হাসেন। সত্যিকার অর্থে পূর্ববঙ্গের অঙ্কুর পশ্চিমবঙ্গে মহীরূহ এমন শতাধিক কর্মবীরের নাম ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত আছে। এই সবগুলি ইতিহাস বিবেচনা করলে পূর্ববঙ্গে জন্মগ্রহণ কৃত মনীষীগুলো পশ্চিমবঙ্গে আলোর প্রদীপ জ্বালানো মনীষীদের মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তি রূপে আজও আলো ছড়াচ্ছেন ব্রহ্মচারী মুরাল ভাই।
যেভাবে বেড়ে উঠা মুরাল ভাইয়ের: অখন্ড ভারতবর্ষের অখন্ড বঙ্গের তৎকালীন অন্তর্গত (বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ চট্টগ্রামের) চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার ঐতিহ্যবাহী কালীপুর গ্রামে মানবচিত্র ১৯৪৫ সালের ৩ জানুয়ারি মুরাল ভাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্বর্গীয় অক্রুর চৌধুরী এবং মাতার নাম স্বর্গীয়া স্বর্ণলতা চৌধুরী। মুরাল ভাই এর পূর্বাশ্রমে নাম ছিল মুরাল চৌধুরী। দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপীঠের অন্যতম কর্তা তিনি। তিনি মানব সেবার এক অনন্য নাম ও ত্যাগী মহান পুরুষ। মুরাল ভাইয়ের পিতারা চার ভাই ছিলেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে অতুল চৌধুরী, অক্রুর চৌধুরী, নকুল চৌধুরী এবং সুখেন্দু বিকাশ চৌধুরী। মুরাল ভাইয়েরা ছিলেন দুই ভাই এক বোন। মুরাল ভাই এর অগ্রজের নাম দুলাল কান্তি চৌধুরী। দুলাল বাবু বাঁশখালী থানার স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন। আদরের বোন খুকুরানী বর্তমানে স্বর্গবাসী। মুরাল ভাইয়ের বয়স যখন মাত্র ছয়, তখন তিনি তাঁর পিতাকে হারান। দশ বছর বয়স যখন তাঁর, তখন তাঁর গর্ভধারিনী জননীও ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে নিজের সন্তান-সন্ততিদের অকূল সাগরে নিক্ষেপ করে পরলোকগমন করেন। পিতৃ মাতৃহীন মুরাল ভাইকে তাঁর বড়োভাই দুলাল কান্তি চৌধুরী পিতামাতার সমান আদর ভালবাসা দিয়ে প্রতিপালন করেন। মুরাল ভাই বাঁশখালী থানার কালীপুর এজহারুল হক স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করেন। সাতকানিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে আই.এস.সি, কানুনগোপাড়ার স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স সহ বি.এসসি পাশ করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর দাদা দুলাল কান্তি চৌধুরী পিতৃমাতৃহীন ভাইকে প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসতেন। কিন্তু অদৃষ্টের এমনই নির্মম পরিহাস যে অগ্রজের মায়া মমতা ও ভালবাসায় তাঁকে কিছুতেই স্বপরিবারের ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ করে রাখতে পারলো না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করার পর তাঁর মনে হলো আর পাঁচ জনের মতো গৃহসুখে সুখী পরিতৃপ্ত দশটা পাঁচটা জীবন তাঁর জন্য নয়। এই জগতে এর থেকে বৃহত্তর, এর থেকে মহত্তর কোন কিছু করার রয়েছে। সুতরাং এ মায়াবন্ধন ছিন্ন করে তাঁকে অবশ্যই অজানার পথে, অচেনার পথে পাড়ি দিতেই হবে। এই বৃহত্তর, মহত্তরের সুতীব্র আকর্ষণেই তিনি নিজ গৃহের ক্ষুদ্র গ-ী ছেড়ে সারাবিশ্বকে আপন গৃহ করে তোলার তাগিদে ঘর থেকে পথে পা বাড়ালেন। ‘অত্র বিশ্ব ভবতি এক নীড়ম’Ñএই সমগ্র বিশাল বিশ্ব একটি মাত্র নীড়ে পরিণত হোক এই মহাবাণী যেন তাঁর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকলো তাঁর জীবনে। আশৈশব বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত মুরাল ভাই বর্তমানে সেবার এক অনন্য নাম। যিনি জীবনের ৭৫ বছর কাটিয়ে দিলেন মানবের কল্যাণে, বিশ্বমানবের সেবায়। কিন্তু মা-বাবাকে শৈশবে হারানোর ব্যথা বেদনা কোনো দিনই ভুলতে পারেননি মুরাল ভাই। যদিও তাঁর অগ্রজ দুলাল কান্তি চৌধুরীর মায়া মমতা ভালোবাসার অন্ত ছিল না তাঁর প্রতি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর বড়দা না থাকলে মুরাল ভাইয়ের জীবন চলার পথ হয়ত এ ভাবে হত না। তিনি বড়ো হয়েছেন, তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেÑএ সবই সম্ভবপর হয়েছে তাঁর বড়দার উদারতার গুণে। তিনি তাঁকে এমএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। তাঁর পড়াশোনার যাতে কোন ব্যাঘাত না হয়, তার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। তাঁকে মা-বাবার অভাব কোনোদিন বুঝতে দেননি তিনি। যেহেতু তাঁর মা-বাবা অকালেই চলে গেছিলেন তাই বড় ভাইকেই মা-বাবা বলে মনে করতেন মুরাল ভাই। এমএসসি পাশ করার পর একটি ভাবনা মুরাল ভাইয়ের মনে জাগল যে এই সংসারটা সত্যিই মায়াময় কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউই এই পৃথিবীতে চিরদিন থাকবে না। তাঁর মা-বাবাও চলে গেছেন অকালে। তাঁকে একদিন চলে যেতে হবে। সুতরাং তাঁর দ্বারা এই মায়াময় সংসারে আবদ্ধ থেকে কোনো মহৎ কার্য সিদ্ধ হবে না। তাঁকে এই মায়াডোর ছিন্ন করে বৃহত্তর জগতে পাড়ি দিতে হবে। বৃহৎ জগৎ সংসার যাঁকে ডাকে, সে কী কখনো ক্ষুদ্রতর গ-ীতে আবদ্ধ থাকতে পারেন? না পারেন না। তাই তো বড়দার মায়া মমতার গ-ী পেরিয়ে ঘর থেকে পথে পা বাড়িয়ে আজ প্রায় ৪৭ বছর ধরে সমাজের অগণিত মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন সারাবিশ্বে। তিনি এমন একজন অসাধারণ মানুষ যিনি মুক্তকণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন যে, তাঁর শুধু একটাই ধর্ম এবং সেটা হলো মানব ধর্ম। তাঁর শুধু একটাই জাতি, সেটা হলো মানব জাতি। তাঁর গর্বিত উচ্চারণ, “আমি বাংলার সন্তান। বাংলাদেশ আমার প্রাণের দেশ।” কলকাতার দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপীঠে রামকৃষ্ণ সংঘে যখন প্রথম গিয়ে দেখলেন শত শত অনাথ ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সংঘের আশ্রমে প্রতিপালিত হচ্ছে, তখন তাঁদের দেখে মুরাল ভাইয়ের হৃদয় বিগলিত হলো। তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। তাঁদের সেবায়, তাঁদের যতেœ, তাঁদের শিক্ষাদীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।
মুরালী চৌধুরী থেকে মুরাল ভাই: ১৯৭০ সালেই মুরালভাই চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় চলে যান। তাঁর কিছুদিন পরেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। আট দশ বাঙালির মতো সেদিন মুরাল ভাইও স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মায়ের বন্ধন দশা দেখে ব্যথিত চিত্তে দেশমাতৃকার বন্ধন মোচনের জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন দেশমাতৃকার চরণ তলে। তবে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করার জন্য ওসব আর মনে ঠাঁই দিতে চান না মুরাল ভাই। যেহেতু তিনি বর্তমানে সন্ন্যাস জীবনযাপন করছেন সুতরাং সব ভাইই তো তাঁর ভাই। সবাইকে ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করাই সন্ন্যাসীর ধর্ম। মুরাল ভাই সবসময়ই শ্রী শ্রী সারদা মায়ের সরল মনের সহজ কথা ভাবেন। সারদা মা বলতেন, “যদি শান্তি চাও তাহলে কারো দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের আর সকলকে আপন করতে শেখো।” এই কারণেই মুরাল ভাই পূর্ব জীবনের ঐ ভাবধারাটা মন থেকে একেবারেই মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন এবং তিনি সদাসর্বদাই চেষ্টা করে চলেছেন আগের জীবনের সবকিছু ভুলে থাকতে। মুরাল ভাই এর আদ্যাপীঠ আশ্রমে পাকাপাকি থাকার যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, এবার প্রয়োজন হলো দীক্ষা নেবার। বেলুড়মঠের দশম সভাপতি শ্রী শ্রী স্বামী বীরেশ্বানন্দ মহারাজজীর কাছে মুরাল ভাই দীক্ষা নিলেন। দীক্ষা শেষে মুরালী চৌধুরী হলেন মুরাল ভাই। সবার প্রিয় মুরাল ভাই। অন্নদা ঠাকুর বলতেন, “সকলের নামের পাশে যেন ‘ভাই’ কথাটি থাকে।” মুরালী চৌধুরী শ্রী শ্রী অন্নদা ঠাকুরের আদর্শ অনুসরণ করে তার পূর্বনাম পরিবর্তন করে মুরাল ভাই-এ রূপান্তরিত হলেন। এইভাবেই তাঁর ব্রহ্মচারী সাধন জীবনের প্রায় ৪৭টা বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে এবং তাঁর সমগ্র জীবনের প্রায় সত্তরটা বছর তিনি অতিবাহিত করলেন মানব সেবা ও নানাবিধ মানব কল্যাণমুখী কর্মের মাধ্যমে। মুরাল ভাইয়ের দীক্ষাগুরু স্বামী বীরেশ্বানন্দ মহারাজ স্বয়ং সারদ মায়ের দীক্ষিত সন্তান ছিলেন। সহজেই অনুমেয় তাঁর মতো এক সদগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার।
মুরাল ভাই তাঁর সমগ্র জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদামা-স্বামী বিবেকানন্দ-অন্নদা ঠাকুরের স্বপ্ন সার্থক করার আপ্রাণ প্রয়াসে উৎসর্গীকৃত। সত্তরোর্ধ জীবনে তিনি অধ্যাত্ম জীবনযাপনের পাশাপাশি আপামর জনসাধারণের কল্যাণের জন্য, মঙ্গলের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বালকাশ্রমের সার্বিক কল্যাণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। আহার নিদ্রা বিশ্রাম ভুলে গেছেন। আদ্যাপীঠের জন্য তাঁর সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন। বালকাশ্রম, বালিকাশ্রম যদি তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, প্রেম হয় কিন্তু আধ্যাপীঠের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য ততোধিক। তাঁর ওপর আরোপিত সমস্ত দায়িত্ব তিনি নীরবে, এবং অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছেন। কেউ জানতে পারেন না একই সঙ্গে তিনি এতোগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ কেমন করে পরিচালনা করছেন। ঐশ্বরিক ক্ষমতা না থাকলে এইসব কাজ প্রায় একা হাতে সামলানো সহজ ব্যাপার না।
মুরাল ভাইয়ের দীর্ঘ কর্মময় জীবন। তাঁর চেয়েও দীর্ঘ স্মরণীয় তাঁর কর্মময় ব্যক্তিত্ব। কিসে মানুষের কল্যাণ হবে, মঙ্গল হবে, কীভাবে দুঃখীর চোখের জল মোছানো যাবে এই হলো তাঁর জীবন সাধনা। কী করে একজন দুর্গত মানুষকে সামান্য শান্তি ও আশ্বাস দেওয়া যাবে এই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠতেন তিনি। সন্ন্যাসীর নির্মোহ জীবনযাপন তিনি করেন, তা সত্ত্বেও মানুষের কল্যাণে তিনি জীবনভর সেবাব্রত পালন করে চলেছেন গভীর নিষ্ঠায়, তাঁর কর্ম উদ্যোগ অপরকে প্রাণিত করছে। সকলের কাছে তাঁর প্রিয় পরিচয় মুরাল ভাই। শুধু ভারতবর্ষের নয়, দেশে বিদেশেও তিনি পরিভ্রমণ করেছেন অনেকবার। তাঁর একটি মাত্র লক্ষ্য সারা পৃথিবীতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের, সারদা মায়ের, স্বামী বিবেকানন্দের তথা শ্রী শ্রী অন্নদা ঠাকুরের জীবনাদর্শ প্রচার করা।
আদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা : মুরাল ভাই জীবিত এক মানবতাবাদী মানুষের নাম। তাঁর কর্মে, জ্ঞানে শুধুই মানবতার জয়গান। মানবসেবাই তাঁর কাছে বড় ধর্ম। সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিতদের নিয়েই তাঁর যত কাজ। তাঁর অনাথ আশ্রমের শত শত প্রতিবন্ধী, অন্ধ, হাত-পাবিহীন ও মা-বাবাবিহীন বঞ্চিত নারী, শিশুকে তিনি মনে করেন নিজের সন্তান।
১৯১৫ সালে কলকাতায় অন্নদা ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বঞ্চিতদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম। ১৯৭১ সালে ওই আশ্রমে ছিল পিতা-মাতাহীন ১২-১৩টি অনাথ শিশু। ১৯৭১ সালে ঘটনাচক্রে জন্মস্থান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার পালেগ্রাম থেকে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন মুরাল ভাই। সেখানে দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠে গিয়ে অন্নদা ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ও মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর সান্নিধ্য লাভ করেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই আশ্রমে অনাথ শিশুর মুখের দিকে থাকিয়ে সেখানে মুরাল ভাই থেকে যান। সেখানে অন্নদা ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত আশ্রম, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, মায়েদের আশ্রমের দায়িত্ব পান তিনি। এটাকে ঘিরে অন্নদা ঠাকুরের নানা স্বপ্ন ছিল। অন্নদা ঠাকুর মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্নকে মুরাল ভাই ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। এরপর মুরাল ভাই সেখানে বিএড কলেজ, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, হাই স্কুল, কালীমন্দির, বিশাল অনাথ আশ্রম, প্রাইমারি স্কুল, চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ৮টি মোবাইল টিমের মাধ্যমে ১৭টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মোবাইল চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় গ্রামে গ্রামে গিয়ে। এখন আশ্রমে শত শত শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধী আশ্রিত রয়েছেন। বিশাল কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ভবন। একেকটি ভবন ৬ তলা, ৫ তলা। রয়েছে ৬টি লিফটসহ একাধিক ভবন। এখানে প্রতিদিন আড়াই হাজার ছেলে-মেয়ে শিক্ষা লাভ করে। মাদার তেরেসাকে দিয়ে যে ভবন উদ্বোধন করা হয় সেখানে একসঙ্গে বসতে পারে দেড় হাজার লোক। এখানে প্রতিদিন ৫ শ গরিব খাবার খায়। অন্নদা ঠাকুর বলতেন, ‘কেউ যেন আমার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিমুখ না হয়।’ তাঁর সেই বাণীকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মুরাল ভাই। এর পাশাপাশি মুরাল ভাই এখন কানাডা, ফ্রান্স, আমেরিকা, চীন, জাপানসহ ১৭টি দেশে অনাথদের নিয়ে কাজ করছে।
মুরাল ভাই প্রতিদিন আড়াই-তিনঘণ্টা সাধনা করেন। ভক্তরা তার সাধনাকে অনুভব করে। অন্নদা ঠাকুর তাঁর মন্দিরে মুসলিমদের চাঁদতারা, ক্রিস্টানদের ক্রস, হিন্দুদের সেন, বৌদ্ধদের বিহারের চিহ্ন রেখেছিলেন। তাঁর কাছে ধর্ম, জাত মুখ্য ছিল না। মানবতাই মুখ্য ছিল। মুসলমানদের সম্মান মাজারে, খ্রিস্টানদের গির্জায়, বৌদ্ধদের মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করব। হিন্দুদের সাথে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকব। এটাই ছিল মুরাল ভাইয়ের দর্শন। অন্নদা ঠাকুর বলতেন, যাঁরা জীবনে নিজের জন্য কাজ করে, তাঁরা বেঁচে থাকে মৃত মানুষ হয়ে। তাঁরাই বেঁচে থাকে, যাঁরা পরের জন্য করেন। ‘আমি চলে গেলেও আমার সবকিছু তোমাদের সঙ্গে কাজ করবে।’
‘অন্নদা ঠাকুরের এই মন্ত্রে মুরাল ভাই কাজ করছেন। ধর্ম পার্থক্য নেই মুরাল ভাইয়ের কাছে। প্রত্যক ধর্মের মানুষের সেবা করা তার কাজ। অন্নদা ঠাকুরের জন্মস্থান উত্তর গুজরা আদ্যাপীঠ সবার জন্য বড় পবিত্র ভূমি। মুরাল ভাইয়ের কাছে বাংলাদেশের মতো ভক্তি পৃথিবীর আর কোনো দেশ নেই। কলকাতার দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সংঘ আদ্যাপীঠ সকল ধর্মের মানুষের জন্য খোলা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় দেড়শ মুসলমানকে বাইপাস সার্জারি করে রক্ত দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠিছেন মুরাল ভাই। চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ কলকাতায় গিয়ে মুরাল ভাইয়ের কাছে উঠেন। বাংলাদেশের মানুষকে কাছে পেলে প্রচ- রকমের ভালো লাগে তার। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষের প্রতি আলাদা একটা টান রয়েছে মুরাল ভাইয়ের। বাংলাদেশকে নিয়ে মুরাল ভাইয়ের রয়েছে ভবিষ্যত নানা পরিকল্পনা। বাংলাদেশে একটি কলেজ, একটি হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম করার চিন্তা আছে তার। তিনি সেই স্বপ্নটা জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন করে যেতে চান। এছাড়া কলকাতায় একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল করার ইচ্ছা আছে তার।
আমাদের প্রার্থনা: আমাদের সবার একটাই প্রার্থনা বাঁশখালীর কৃতি সন্তান, মানবতার মহান সেবক, আমাদের সবার প্রিয় মুরাল ভাই মানুষের কল্যাণে জয়ী হোক। সারা পৃথিবীর অসহায়, লাঞ্চিত, বঞ্চিত এবং নিপীড়িত মানুষগুলো তার মানবতার চাঁদরে ঠাঁই পাক। মানুষের কল্যাণে তিনি আরো এগিয়ে যাক। আর কোন অনাথ, এতিম শিশুরা যেন একবারও না খেয়ে থাকতে না হয়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মুরাল ভাইয়েল মতো অজ¯্র মানবতাবাদী মানুষের জন্ম হোক মানুষের কল্যাণে এ প্রত্যাশা। জয় হোক মানবতার, মুক্তি হোক মানুষের।###