নভেরা ডেস্ক: মাদিহা মৌ, একাধারে শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক এবং একজন উদ্যোক্তা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, পরিশ্রমী, দৃঢ়চেতা এই নারীর জীবনের গল্প অনেক মেয়ের অনুপ্রেরণা হতে পারে। তার ভাষায়ই তার কাজ সম্পর্কে জানা যাক।
“আম্মু যখন মারা যান, তখন আমি পড়ি ক্লাস টেনে। আম্মু খুব গুণবতী ছিলেন, অনেক হাতের কাজ জানতেন। কিন্তু আমাকে তেমন কিছুই শেখাননি। আম্মু ভেবেছিলেন অন্য কাজ করতে গিয়ে আমার পড়াশোনার খুব ক্ষতি হবে। তাই আম্মু নিজে যেসব কাজ পারতেন, তার কিছুই আমাকে শেখাননি। এমনকি রান্নাটাও না।
আম্মু মারা যাওয়ার পর আমি অথৈজলে পড়লাম। নরমাল একটা সালোয়ার সেলাই করার জন্যও এই চাচী, সেই চাচীর কাছে দৌড়াতে হলো। সেই সেলাইয়ের মজুরী তো আছেই৷ আগে আম্মুই সব জামা ডিজাইন করে দিতো। হাল ফ্যাশনের জামা বানিয়ে দিত৷ আমার পরনের ফ্রক দেখলে লোকে জিজ্ঞেস করতো, “কোত্থেকে কিনেছ ড্রেসটা? খুব সুন্দর!”
ঠ্যাকায় পড়লে মানুষ অনেক কিছু শেখে। ওই বয়সে টাকা তো নেই হাতে। কাপড় বানাব কেমন করে? একদিন আম্মুর সেলাই মেশিনটা নিয়ে বসে পড়লাম। আনাড়ি হাতে মেশিন ঘুরাই, মেশিন যায় উল্টা দিকে। এভাবে একদিন দুইদিন করে শিখে ফেললাম সেলাই। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই। নিজের কাপড় নিজেই ডিজাইন করি। লোকে দেখলে বলে, “বেশ সুন্দর হয়েছে তো! কোত্থেকে কিনেছ ড্রেসটা?”
২০১০ সাল থেকে টিউশনি করে টাকা উপার্জন করতে শুরু করি। তখন বান্ধবীরা আমার ডিজাইন দেখে পছন্দ করে। ওরাও চায়, আমি ওদের ড্রেস ডিজাইন করে বানিয়ে দিই। দিতাম।
তখন থেকেই একটু একটু করে ভাবতে শুরু করেছিলাম, একসময় আমি বুটিক হাউজ করব। ড্রেস, শাড়ি বানিয়ে বিক্রি করব। আমার হাউজের নাম হবে “গাঙ্গেয়া”। নদীর পাড়ের মেয়ে, তাই গাঙ্গেয়া।
তখনো ফেইসবুক কমার্স চালু হয়নি। অফলাইনে ব্যবসা করার জন্য টাকাপয়সা অনেক লাগবে বলে বুটিক হাউজের আইডিয়া মাথাতেই রইলো। শুরু আর করা হলো না।
২০১৭ সাল থেকেই তাসমিয়ার সাথে প্ল্যান করেছিলাম বুটিক হাউজ করার। ভেবেছিলাম, পেইজ খুলে ফেলি ফেইসবুকে। কিন্তু খোলা হয়নি। কারণ, তখন ভরসা দেওয়ার মতো প্লাটফর্ম ছিলো না। ঢাকার বাইরে থেকে যে ব্যবসা করা সম্ভব, সেই সিচুয়েশনই ছিলো না। ব্লকের রং, ডাইজ ইত্যাদি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম চাঁদপুরে, কিন্তু কাজ এগোতে পারিনি।
তারপর তো চাকরিবাকরি, জায়গা সংকট, মূলধনের অভাব ইত্যাদি মিলিয়ে এত সংকীর্ণতা চেপে ধরলো, তখনো করা হলো না।
তারপর মনে হলো, এতদিন ধরে নিজের স্বপ্নকে দমিয়ে রাখা ঠিক নয়। ততোদিনে কিছু টাকাও জমেছে। দিলাম জেলখানার চাকরি ছেড়ে। শুরু করলাম আমার স্বপ্নডাঙার কাজ।
এখন কেবল ভাবি, সেই ২০১৭ তে যদি কোনো প্লাটফর্ম পেতাম, যদি একজন ভালো মেন্টর পেতাম, এতদিনে আমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হতো না।
একটা সময়ে ভাবতাম,
“আমাকে দিয়ে কিসসু হবে না!”
আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখতাম, সবার এত গুণ! কেউ পড়াশোনায় খুব ভালো, কেউ তার পাশাপাশি রান্না করতে জানে দারুণ! কেউ হাতের কাজ জানে। আমি কিছুই পারি না। ছাত্রী হিসেবে ছিলাম মিডলবেঞ্চার। মাঝামাঝি লেভেলের। সব দিক দিয়েই বিশেষত্বহীন।
আম্মু ভাবতো, আমি কিছুই পারি না। আমার বয়সী অন্য কারোর এচিভমেন্ট শুনলে সেসব আমাকে শুনিয়ে ধিক্কার দিতো। আমার খুব খারাপ লাগতো। আমি কিছুই পারতাম না। শুধু বই পড়তাম নেশা করে। আমার বই পড়ার স্বভাব আম্মু একদমই পছন্দ করতো না। কত বই ছিঁড়ে ফেলেছে আম্মু!
আমি কিছুই পারতাম না, কিন্তু কখনোই অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইনি। বাবার পরিচয়ে, কিংবা বরের পরিচয়ে। ছোটো থেকেই ভাবতাম, আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবো। আমার একান্ত নিজের একটা বাড়ি থাকবে। বাবার বা স্বামীর বাড়ি নয়। নিজের বাড়ি।
একটা নিজের নাম।
নিজের বাড়ি।
যা শুধু আমার, শুধুই আমার।
এখন গুগলে নিজের নামটা লিখে সার্চ দিলে পুরো দুই পাতা জুড়ে আমার কাজের লিংক চলে আসে। শুধুমাত্র ফেইসবুক আইডি লিংক আসে, তা নয় কিন্তু। রকমারির সাইট আসে, যেখানে আমার লেখা ও অনুবাদকৃত বইগুলোর তালিকা দেওয়া আছে। আমার নিজের সাইটের লিংক ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিখ্যাত সাইটের লিংক আসে যেখানে আমার প্রোফাইল আছে। যেসব সাইটে আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আর্টিকেল লিখেছি।
এমনকি নামের অর্থ জানায় যে সাইটগুলো, সেগুলোতে “মাদিহা” নামের অর্থ লিখে উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই আসে আমার নাম, “মাদিহা মৌ”।
আমাকে অন্যের নামে পরিচিত হতে হয় না।
আমি জানি, আমি আল্লাহর রহমতে পরিশ্রম করতে পারি। একসময় আমার উদ্যোগ স্বপ্নডাঙার মাধ্যমেও আমার নাম অনেকেই জানবে৷ কিন্তু আফসোস একটাই, আমার মাকে এসবের কিছুই দেখাতে পারিনি। তার মেয়েটা “কিচ্ছু পারে না” এই ধারণা দূর করার সুযোগ আমি পাইনি। ওপার থেকে তিনি কি দেখতে পাচ্ছেন আমার কাজ?”
“ছোটো থেকেই আমি একটু আঁতেল হিসেবে পরিচিত ছিলাম। পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস।
নীতি নৈতিকতা মেনে চলার ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস।
দেশকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস।
বান্ধবীরা বেশিরভাগই ছিল, স্যারদের দৃষ্টির পিছনে একটু উল্টাপাল্টা কাজ করার পক্ষে। স্যার ম্যাডামদের নেগেটিভ দিক বের করে হাসাহাসি করা, হাই বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো, বই মাড়িয়ে দেওয়া – এসব তাদের করতে ভীষণ ভালো লাগতো। সেটাই খুব বেশি স্বাভাবিক। স্কুল লাইফের মজাই তো এরকম ধরনের কাজের মাধ্যমে উপভোগ করা। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি এসব খুব মন্দ চোখে দেখতাম। আমার এগুলো করতে ভালো লাগতো না। নীতিবাগীশ ধার্মিক হওয়ায় বান্ধবীদের এসব করতে বারণ করতাম। আর ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।
সেই ছোটো থেকে দেশটাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। অন্য সবার মতো আমার দেশের বাইরে গিয়ে সেটল হওয়ার ইচ্ছে আমার কোনোকালেই ছিল না। আমি স্বপ্ন দেখতাম পাইলট হবো। অন্যদেশ ঘুরে টুরে দিন শেষে নিজের দেশেই ফিরব। যদিও সেটা আর হয়নি।
তখন থেকেই ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান দুই দেশকেই ভীষণভাবে ঘৃণা করতাম। দাদুবাড়ির লোকজন পাকিফিলিয়া রোগে আক্রান্ত ছিল। পাকিস্তানি সবকিছুই তাদের কাছে ভীষণ প্রিয়। পাকিস্তানি ক্রিকেট, পাকিস্তানি পোশাক।
মার্কেটে তখন পাকিস্তানি আর ইন্ডিয়ান পোশাকের দৌরাত্ম খুব বেশি (এখনো যে খুব কম, তাই বা বলি কেমন করে?)। আমার সেসব ভালো লাগতো না। দোকানদার যদি বলতো, “খাঁটি ইন্ডিয়ান কাপড়”; আমি বলতাম খাঁটি দেশি কাপড় নেই?
দোকানদার আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো। হয়তো মনে মনে ভাবতো, এতো সব ইন্ডিয়া পাকিস্তানপ্রেমীদের মধ্যে এই পাগল এলো কোত্থেকে?
তখন থেকেই আমি ভাবতাম, আমি একটা বুটিক শপ করব। যেখানে সব দেশি কাপড় থাকবে৷ দেশীয় চাল চলনে, দেশীয় ডিজাইনে করা শাড়ি, থ্রিপিস থাকবে। যেহেতু গাঙের পাড়ে বাড়ি (চাঁদপুর), তাই আমার দোকানের নাম হবে গাঙেয়া (আফসোস লাগে, এই নামেই আমার বর্তমান উদ্যোগের নাম করতে পারিনি বলে)।
স্বপ্ন কিছুটা বাস্তবায়ন করার পথে। দেশি পোশাকে আমি আমার উদ্যোগটিকে নিয়ে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু এই কথা আমি হাজারবার ভাবি, একজন দেশপ্রেমিক “মাদিহা মৌ” এর পক্ষে পুরো বাংলাদেশের মানুষের মনে কি দেশি পণ্যের প্রসার করা সম্ভব হতো? আমি যদি খুব সফলও হই, একা আমি কতটুকু কী করতে পারতাম?
এই জায়গায় এসে আমার মন থেকে শ্রদ্ধা জাগে ই-ক্যাবের ফরমার প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদের প্রতি। আমি আমার দেশপ্রেম নিজের কাজের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আর একজন রাজিব আহমেদ “Women’s and e-commerce foram” এর মতো প্লাটফর্মের মাধ্যমে নিজের দেশপ্রেমকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুরো দেশ জুড়ে। চিন্তায় চেতনায় মিল আছে, এমন লাখ দেড়েক মানুষকে একটা প্লাটফর্মে একত্রিত করেছেন। দেশের স্বার্থে কাজ করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারার যে সামর্থ্য তিনি দেখিয়েছেন, তার জন্য সারাজীবন মনে রাখব আমি।”