এ, আর মানিক ঃঃ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী মলকা বানু মসজিদ। মলকা বানুর-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ইতিমধ্যে লোকগাথা, যাত্রাপালা ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ৭০ এর দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা ও অভিনেতা জাবেদ প্রমুখ অভিনীত “মলকা বানু” চলচিত্র অনেকেই দেখেছেন অথবা শুনেছেন। এই প্রেমকাহিনী তখন সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই চলচিত্রটি। তাদের এই প্রেম উপাখ্যান অনেকের কাছে কল্পকাহিনী বা রূপকথা মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা নয়। এই প্রেম উপাখ্যান ছিল বাস্তবভিত্তিক প্রেমকাহিনী। পরবর্তীতে ৮০ দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী চম্পা ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ অভিনীত “মলকা বানু” চলচিত্রটি আবার জনপ্রিয়তা পায়।
ইতিহাসখ্যাত মলকা বান-মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যানের অন্যতম সাক্ষী বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নে অবস্থিত মলকা বানুর মসজিদ ও দীঘি। মলকা বানুর পিতার নাম আমির মোহাম্মদ চৌধুরী। বাঁশখালীর সরল গ্রামে ছিল তাদের বসতি। সরল গ্রামে মলকা বানুর নামে রয়েছে একটি প্রাচীনতম মসজিদ ও বিলুপ্ত প্রায় একটি দীঘি। আনোয়ারার শোলকাটা গ্রামের জমিদারপুত্র মনু মিয়ার সাথে মালেকা বানুর বিয়ে ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মলকা বানু-মনু মিয়ার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার জীবন শুরু করেন। বিবাহকালীন সময়ে সারাদেশে অনেক মুখরোচক গল্প রয়েছে। ‘বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আলোড়ন’র সূত্র ধরে জানা যায়, আমির মোহাম্মদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি সরলে বসবাস করতেন এবং তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ও জমিদার। তার ঔরশে একমাত্র কন্যা ও সাত সন্তানের জন্ম হয়। আর একমাত্র কন্যাটি ছিল ইতিহাসখ্যাত মলকা বানু চৌধুরী।
মনু মিয়া একদিন তাঁর পাইক-পেয়াদাদের সাথে নিয়ে জমিদারি তদারকি করতে বাশখালির সরল গ্রামে যান। পথে ক্লান্ত হয়ে পরলে তারা সওদাগরের বাড়িতে গিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম করেন। ঠিক সেই সময় মনু মিয়ার নজরে পড়েন অনিন্দ্য সুন্দরী সওদাগর কন্যা মলকা বানু। তখন মলকা কাজির মক্তবে অধ্যয়ন করছিলেন। সেখানেই মনু মিয়া ও মলকা বানুর আঁখির মিলন ঘটে। তখন থেকেই মলকা বানুর প্রেমে পড়েন মনু মিয়া। প্রেমের টানে মনু বারবার ছুটে যেতেন মলকা বানুর সরল গ্রামে। মনু মিয়া কাজির মাধ্যমে মলকার বাবার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সওদাগর রাজি হলে ও মলকা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কারণ হিশেবে মলকা মনুকে বলেছিলেন সাম্পান যোগে নদী পার হতে তাঁর ভই লাগে। কারণ মনু মিয়ার বাড়ি ছিল শঙ্খ নদীর ওপারে। কাজেই বধূ সেজে মনু মিয়ার বাড়ি যেতে হলে উত্তাল শঙ্খ নদী পার হতে হবে। মলকা বানু শর্ত দেন শঙ্খ নদীতে বাঁধ দিতে হবে। সাম্পানযোগে নদী পার হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন না। এই কথা শুনে মনু মিয়া স্থির করলেন যেভাবেই হোক শঙ্খর বুকে বাঁধ নির্মাণ করবেন। যেই চিন্তা সেই কাজ। মনু মিয়া নির্মাণ করলেন বিশাল এক বাঁধ। অতঃপর বর বেশে মনু মিয়া হাজির হন সরল গ্রামে মলকা বানুর পৈতৃক বাড়ি। প্রিয়তমা মলকাকে বধূ সাজিয়ে সড়ক যোগে মনুর রাজপ্রসাদে এনে তুললেন। জনশ্রুতি আছে মলকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিলো খুব ঝাঁকজমক পূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিল তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। আর বিয়েতে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেন। তার মধ্যে ” ‘মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।’ গানটি অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তখন। গ্রামের বিয়ে অনুষ্ঠানে এখনো এই গানটি শোনা যায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মলকা বানু ও মনু মিয়ার, তাদের কোন সন্তানাদি ছিল না। মলকা বানু ছিলেন মনু মিয়ার দ্বিতীয় স্ত্রী। মনু মিয়া প্রথমা স্ত্রী খোরশা বানু। খোরশা বানুর গর্ভেও কোন সন্তানাদি ছিল না। জমিদার মনু মিয়ার মৃত্যুর পর মলকা বানু সরল গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে চলে যান। অনেকে বলেন তাদের সংসারে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হলে মলকা বানু স্বামীর সাথে অভিমান করে পিতৃবাড়ী বাঁশখালীর সরলে চলে আসেন।
সরলে বর্তমানে যে মসজিদ আছে তা মলকা বানুর পিতা আমির মোহাম্মদ নির্মাণ করে বলে দাবি করেন। একমাত্র আদুরে মেয়ের বিয়ের পর মলকার বাবা খুব একা হয়ে যান। নিরসঙ্গ পিতা কন্যার স্মরণে নির্মাণ করেন একটি মসজিদ ও দীঘি। যা ইতিহাসে মলকা বানুর মসজিদ ও দীঘি নামে পরিচিত। মসজিদে ফরাসী ভাষায় একটি শিলালিপি ছিল, যা পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগে বিলীন হয়ে যায়। শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিবহ মসজিদটির প্রকৃত তথ্য জানা এখনো সম্ভব হয়নি।