BanshkhaliTimes

ভীতিহীন ও আনন্দঘন পরিবেশে হোক কোমলমতি শিশুদের পাঠদান

BanshkhaliTimes

ভীতিহীন ও আনন্দঘন পরিবেশে হোক কোমলমতি শিশুদের পাঠদান

সুনিশ্চিত ভবিষ্যত বিনির্মাণের মূল সম্পদ শিশু। শিশুরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও ভবিষ্যত কর্ণধার। আজকের বেড়ে ওঠা শিশু জন্ম দেবে ঐতিহ্যপুর্ণ গৌরবময় অধ্যায়। তাই শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিশুবান্ধব শিখন পরিবেশ। প্রয়োজন আনন্দঘন পরিবেশ; যেখানে শিশু নিজেকে নিজের মতো করে তৈরি করার সুযোগ পায়।
অতীতের কথিত প্রবাদে আছে – “স্যার আমার ছেলে/মেয়ের গোস্ত মাংস লাগবেনা শুধু চোখ আর হাড্ডি থাকলে চলবে।“ অভিভাবকের আবেগঘন এ আবেদনে তদ্রুপ ব্যবস্থা নিতে গেলে ফলাফল দেখা যায় হতাশাজনক। তন্মধ্যে উল্লখযোগ্য হলো- শিক্ষক অভিভাবক সম্পর্কের দুরত্ব তৈরি, শিক্ষার ও শিখন-শেখানো কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ের প্রতি ভীতি জন্মানো, বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়া, সর্বোপরি দেশের ক্রমবর্ধমান শিক্ষার হার আনুপাতিক হারে কমে যাওয়া।
পূর্বে শিক্ষা বলতে বোঝানো হতো শিশুকে নিয়ন্ত্রণ করা বা শাসন করা। শিশুকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে বিদ্যা দান করার যে পদ্ধতি আমাদের দেশ তথা এতদঅঞ্চলে প্রচলিত ছিল, তাকেই শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদরা এ ধরনের শিক্ষাকে সংকীর্ণ শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁরা মনে করেন, শিশুর ওপর জোর করে বিদ্যা চাপিয়ে দেয়ার নাম শিক্ষা নয়। শিশুর গ্রহণোপযোগী আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদানই হলো প্রকৃত শিক্ষা।
রুশো প্রচলিত শিক্ষাকে তীব্র নিন্দা করেছেন। এই শিক্ষা নিতান্ত কৃত্রিম পুস্তক ভারে জর্জরিত, আনন্দহীন, কৌতূহলের উন্মেষ বা ব্যক্তিত্ব বিকাশের কোনো চেষ্টাই করে না। তিনি বলেছিলেন-“শিশুর শিক্ষা হবে তার প্রকৃতি অনুযায়ী। তাকে মুক্ত স্বাধীন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিজের প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি অনুযায়ী বেড়ে উঠতে দিতে হবে। “ তাঁর মতে ‘শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। “
গতানুগতিক পদ্ধতির কালোদেয়াল ভেঙে প্রবর্তন হয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল। তৈরি হয়েছে শিশু শাস্তি অপরাধ আইন যদিও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কদাচিৎ গতানুগতিক প্রাকটিস লক্ষনীয়। নৈতিক সুশিক্ষার মাধ্যমে শিশু গড়তে পারে সোনালী সুন্দর ভবিষ্যৎ। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণের জন্য একটি শিশুর জীবন সাফল্যের দ্যুতি ছড়াতে পারে। আবার আমাদের দায়িত্বহীন আচরণ বা অজ্ঞতার কারণে একটি শিশুর সারাটা জীবন গহিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।
তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর লাল সবুজের জাতীয় পতাকা খঁচিত সোনার বাংলার সাফল্য গাঁথা বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করতে প্রয়োজন শিশু সম্পদ তৈরি। যার পুরো দায়িত্ব বর্তায় আমাদের শিক্ষক সমাজের উপর অর্থাৎ একজন শিক্ষকই পারেন ভীতিহীন শিশুবান্ধব ও আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দর আগামীর শুভ সুচনা করতে।
প্রতিটি শিশুর মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। তার শেখার ধরন বুঝে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তাকে শিক্ষা দিতে হবে। শিশুর শেখার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সে শিশু একদিন কালজয়ী বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। ভীতিহীন পরিবেশে, আনন্দের মাঝেই সকল শিশু শিখতে চায়। কঠোর শাসন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়।

শিখন পরিবেশ ও ভীতিহীন পরিবেশ সৃষ্টিতে অতি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো যেমন –
⬛ আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান নিশ্চিতকল্পে শিক্ষককে হতে হবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ এবং বিষয় জ্ঞানসম্পন্ন।
⬛ আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক পদ্ধতিগুলো জানতে হবে এবং সেগুলো শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে হবে।
⬛ শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে।
⬛ প্রান্তিকশিশু এবং টোকাই, সুবিধাবঞ্চিত ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা শিখন সামগ্রীসহ বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
⬛ শিক্ষকরা পিতৃ-মাতৃ স্নেহে আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের শিক্ষা এবং দীক্ষা নিশ্চিত করবেন।
⬛ সব শিশু এক রকম নয়- তাই শিশুর রুচি ও মানসিক চাহিদা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
⬛ শিশুর মাঝে মুক্ত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
⬛ শিক্ষককে শেখার পরিবেশে নতুনত্ব আনতে হবে।
⬛ গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে বৈচিত্র্যময় শিক্ষার ধারা প্রবর্তন করতে হবে।
⬛ আনন্দময় ও শিশুবান্ধব শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ।
⬛ শিখন-শেখানো কার্যাবলি অবশ্যই হতে হবে শিশুকেন্দ্রিক।
⬛ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিশুদেরকে নাম ধরে সম্বোধন করতে হবে।
⬛ সঠিক উত্তরদান বা সুষ্ঠুভাবে শ্রেণির কাজ সম্পাদনের জন্য শিশুদেরকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
⬛ ভুল উত্তরদান বা সঠিকভাবে কার্য সম্পাদন না করতে পারলেও চেষ্টা করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।
⬛ পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, সম্পূরক পঠন সামগ্রী, শিশুতোষ সাহিত্য ও লাইব্রেরি নিশ্চিত করতে হবে।
⬛ লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীর প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের।
⬛ চারু-কারু, সংগীতের মতো নান্দনিক কাজেও শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে।

শিশুর শিখন নিশ্চিত ও আগামী সম্ভাবনার সোনালী দ্বার উম্মোচনে ভীতিহীন পরিবেশের বিকল্প নেই। স্কুল হতে হবে শিশুর জন্য স্বর্গসম। হতে হবে মায়াবী স্বপ্নের ঠিকানা। শিক্ষককে হতে হবে হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো যাঁর কাছে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ভোরের প্রতীক্ষার প্রহর গুণবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

লেখক
মোহাম্মদ কচির উদ্দিন
প্রধান শিক্ষক
দক্ষিণ নাপোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *