BanshkhaliTimes

ভিন্ন পথে অভিন্ন লক্ষ্যে ছুটে চলছেন চাঁটগার তিন তারকা

BanshkhaliTimes

তাফহীমুল ইসলাম: পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশও আজ স্মরণকালের ভয়াবহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চারিদিকে আজ আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। করোনা ভাইরাসের আক্রমনে ইতালি, চীন, স্পেনসহ বিশ্বের বহু শক্তিধর রাষ্ট্র আজ মৃত্যুপুরী। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমাদের দেশে এখন চলছে অঘোষিত লকডাউন। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস সাময়িক বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান ব্যতীত অনন্যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। গণপরিবহন বন্ধ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ।

বিদেশ ফেরত মানুষকে রাখা হয়েছে হুম কোয়ারেন্টাইনে। জনসমাগম ঠেকাতে মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনীকে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে ভয়াবহ এক সময় পার করছে বাংলাদেশ। এই কঠিন সময়ে মানুষ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দিকে চেয়ে আছে। দেশকে ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে তারা কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তা জানতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দেশের কয়েকজন মন্ত্রীর লাগামহীন বেঁফাস কথাবার্তায় জনগণ আশাহত হয়েছে।

সম্প্রতি দুই বৃদ্ধকে মাস্ক না পরায় কান ধরিয়ে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার এসিল্যান্ড সাইয়েমা হাসান। পরে সমালোচনার মুখে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। নিজেদের অস্তিত্ব সংকটকালীন এই সময়েও এরকম কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছেই। তা যেন কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। যাই হোক- আমি আজ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের তিনজন দায়িত্বশীল মানুষ সম্পর্কে লিখতে চাই। যাদেরকে শিরোনামে ‘তারকা’ সম্বোধন করেছি। চাঁদ যদি একটি না হতো তাহলে সময়ের প্রেক্ষিতে চাঁদই বলতাম!

রুহুল আমিন

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। হাটহাজারী উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন বহুদিন। একটি উপজেলায় কাজ করলেও তার পরিচিতি আজ দেশব্যাপী। চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ ছাড়া কর্মগুণে তিনি সবার মাঝে সমাদৃত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্রিকায় তিনি নিয়মিত আলোচনার বস্তু। দেশে করোনা ভাইরাস প্রবেশের খবর পেয়েই নিজের পরিচালিত উপজেলায় জীবাণুনাশক পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেন। এরপর অসহায়, দিনমজুরের ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেন খাদ্য সামগ্রী। কয়েকটি এলাকায় জনসমাগম এড়াতে ব্যক্তি উদ্যোগে গ্রামীণ সড়ক বন্ধ করে দেয়া হলে সেখানে হাজির হন ইউএনও রুহুল আমিন।

রোগী এবং প্রয়োজনীয় চলাচলকারীদের কথা বিবেচনা করে সেই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেন। চাইলেই তিনি এই ছোট্ট কাজটির দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদকে দিতে পারতেন বা পুলিশ পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সরাসরি নিজেই হাজির হয়েছেন। একেই বলে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। এছাড়াও নিয়মিত বাজার মনিটরিং এর কাজও অব্যাহত রেখেছেন তিনি। শুধু করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করেই এই তৎপরতা নয়; হাটহাজারী উপজেলার এই চিত্র বারো মাসের। প্রতিদিনই হাটহাজারীর কোথাও না কোথাও পরিচালিত হচ্ছে ইউএনওর অভিযান। ফেসবুকে ম্যাসেজ কিংবা কল দেয়াসহ কোনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই অন্যায় প্রতিরোধে ঘটনাস্থলে ইউএনও হাজির।

আমাদের উপজেলার ইউএনওকে এলাকার সমস্যা নিয়ে ফেসবুকে তিনবার ম্যাসেজ দিয়েছিলাম। প্রথম দুইবার জবাব দিয়েছেন, তৃতীয়বার আমার আইডি ব্লক করে দিয়েছেন! বর্তমান সময়ে কাজের প্রতি বেশিরভাগ দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়বদ্ধতা এতটুকুই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ও হোটেলের বাড়তি ভাড়া প্রতিরোধ করার মতো ছোট্ট বিষয়েও হাটহাজারীর এই ইউএনওকে তৎপর থাকতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘নির্দয় হবে না, কিন্তু কর্তব্যের বেলায় নির্মম হতে হবে’। ইউএনও রুহুল আমিন যেন কবিগুরুর এই উক্তির বাস্তব উদাহরণ। কাজের স্মীকৃতি হিসেবে ইউএনও রুহুল আমিন ‘জনপ্রশাসন পদক-২০১৯’সহ বিভিন্ন সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছেন।

ওসি মুহাম্মদ মহসিন

চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার কর্মকর্তা। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই কাজের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। পুলিশ নিয়ে মানুষের মনে যে কুধারণা ছিল তা ইতিবাচক কাজ দিয়ে তিনি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের এই পরিস্থিতিতে খাতুনগঞ্জসহ কোতোয়ালী এলাকার বাজারকে মনিটরিংয়ের আওতায় রেখেছেন। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের বাড়িতে বাড়িতে উপহার হিসেবে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন ফলমূল। খাদ্যের প্রয়োজন হলে কেউ ফোন দিলে ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে হাজির হচ্ছেন ক্রেতার বাড়িতে। তবুও মানুষকে বাড়িতে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছেন।

গত শুক্রবারে জুমার নামাজ শেষে মুসল্লিদেরকে বাড়িতে চলে যাবার অনুরোধ জানিয়ে নিজেই মাইকিং করেন। এছাড়া নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন বহু আগেই। অনেকেই ঘোষণা দিয়ে থমকে গেলেও তিনি পুরোদমে কাজ করছেন। মানুষের মন থেকে পুলিশ ভীতি দূর করতে চালু করেন ‘হ্যালো ওসি’ সেবা। এই সেবার মাধ্যমে জনগণের কাছে গিয়ে শুনেন অভিযোগ। মাদক বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দেন নিজেই। মাদক প্রতিরোধে যেমন ছুটেন মসজিদ-মন্দিরে তেমনি গ্যাং কালচার রোধে ছুটেন স্কুল, কলেজেও। ওসি মহসিন দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে কোতোয়ালী থানা এলাকা ছিল অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার। থানার সীমানা প্রাচীরের আড়ালে মানুষ মলমূত্রত্যাগ করতো, ময়লা ফেলতো।

সেই সীমানা প্রাচীরে এখন শোভা পাচ্ছে নান্দনিক চিত্রকর্ম ও অপরাধ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক লেখা। পাশে পথচারীদের বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। রাত হলে আলোকসজ্জায় দৃষ্টিনন্দন রূপ ধারণ করে কোতোয়ালী থানা। এভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে থানার বাহির এবং ভিতর থেকে ময়লা, আবর্জনা সরিয়ে কোতোয়ালী থানাকে রূপান্তর করেন ফুলের বাগানে। এই কাজের স্মীকৃতি হিসেবে তিনি ‘মেডেল ফর প্রমোশন অব জেন্ডার সেনসিটিভিটি’ ও ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’সহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন।

শৈবাল দাশ সুমন

চট্টগ্রামের অভিজাত জামালখান ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর। পাঁচ বছরের দায়িত্ব পেয়ে জামালখানকে সাজিয়েছেন ইচ্ছেমতো। এই ওয়ার্ডে কেউ একবার ঘুরতে গেলে মনে হবে মালয়েশিয়ার মতো কোন উন্নত রাষ্ট্রে ঘুরছে। বিষয়টা পার্শ্ববর্তী চকবাজার, আন্দরকিল্লার পরিবেশের সাথে তুলনা করলে সহজেই বুঝা যাবে। জামালখানের রাস্তাঘাট সবসময় পরিষ্কার থাকে। নগরীর অন্য ওয়ার্ডগুলোর মতো এখানে পথের ধারে আবর্জনার স্তুপ পড়ে থাকে না।

জামালখানের যে জিনিসটি সবার চোখ জুড়ায় তা হলো- দেয়ালে খচিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি ও কথা। এতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুফিয়া কামাল, বিদ্যাসাগর, মধুসূদনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে আমাদের প্রজন্ম সহজে পরিচিত হতে পারছে। লেখাপড়া না জানা মানুষও জানতে পারছে বিখ্যাত এই মানুষদের সম্পর্কে। জামালখান মোড়ে রয়েছে বিশাল পর্দা। সন্ধ্যা হলে সেই পর্দায় পথশিশু থেকে শুরু করে সবাই বিনামূল্যে টিভি দেখতে পারে। দাঁড়িয়ে দেখতে হয় না, ফুটপাতের পাশে রয়েছে বিশ্রামাগার। সেখানে বসেই দেখা যায়।

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব, খাস্তগির স্কুল, বাতিঘরসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সমাহার এই জামালখানে। করোনা ভাইরাসের কারণে স্থগিত হওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি জামালখান ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। এই নির্বাচনে পোস্টারবিহীন নির্বাচন করার ব্যতিক্রমী ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। দেশে করোনা প্রবেশের খবর পেয়ে জামালখানবাসীকে সচেতন করতে এই কাউন্সিলর সিএনজিযোগে নিজে মাইকিং করেন। কয়েকদিন ধরে তিনি রাতের আঁধারে খাবার নিয়ে ছুটছেন মানুষের দরজায় দরজায়। জর্জ বার্নাড শ বলেছিলেন- ‘আমার পিতার ছিল মদের নেশা; আমার নেশা কাজ’। শৈবাল দাশ সুমনের পিতার নেশা কি ছিল জানি না কিন্তু তার নেশা যে কাজ তার সাক্ষী জামালখান ওয়ার্ড। তাঁর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়।

তিন ইউনিটের তিনজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং তাদের কাজ নিয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে। একজন ইউএনও, একজন ওসি, একজন কাউন্সিলর। তিনজনই বসে থাকেন টাকার স্তুপে। সেই টাকা জনগণ, সরকারের। এই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা চাইলে তা মেরে দিতে পারে। এরকম ঘটনা কোথায় ঘটছে তা বলবো না। কোথায় ঘটছে না তা জানতে চাই।

পুলিশ বলতেই যে শব্দটির কথা চলে আসে তা হলো ‘ঘুষ’! এই শব্দটি পুলিশ এর প্রতিশব্দের মতো হয়ে গেছে। ইউএনওদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। জনপ্রতিনিধি মানেই দুর্নীতি। মেগা প্রকল্পের নাম দিয়ে চলে মেগা লুটপাট। যা এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি কর্তৃক চাল চুরির ঘটনার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত। এক্ষেত্রে হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমিন, কোতোয়ালী থানার ওসি মহসিন, জামালখানের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ব্যতিক্রম। তাদের কাছে টাকার চেয়ে মানুষের ভালবাসাটা গুরুত্বপূর্ণ।

টাকা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। কাজ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে যুগ-যুগান্তর। এই দায়িত্বশীল মানুষগুলো তাদের কর্মগুণে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয় মন্দিরে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সংকল্পবদ্ধ হলে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব।

লেখক: তরুণ সাংবাদিক

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *