বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা ও করণীয়
সালসাবিলা নকি
বারো বছরের জান্নাত। ছোটবেলা থেকেই সে খুব হাসিখুশি ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। আবার অভিমানীও। বাবা-মা অল্প একটু বকলেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কান্নাকাটি করে। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। কেউ ওর মান ভাঙানোর চেষ্টা করে না। কারণ, সবাই জানে এটা নিত্যদিনের ঘটনা। প্রশ্রয় দিলে সে আরও বেশি করবে। তারচেয়ে ইগনোর করা হলে সে নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে। সে যদি বুঝতে পারে তার মান-অভিমানকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না তাহলে সে এরকম আর করবে না।
প্যারেন্টিং এর গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রশংসিত একটা দিক এটা। আমি নিজেও এটাকে এপ্রিশিয়েট করি। এবং আমার কন্যার ক্ষেত্রেও এপ্লাই করি। কিন্তু সব রোগের ঔষুধ যেমন প্যারাসিটেমল না, তেমনই সন্তানের প্যারেন্টিং পদ্ধতিও কিন্তু শুধু এই একটাই না। সন্তানের মানসিকতা বুঝে সেভাবে প্যারেন্টিং সিস্টেম গ্রহণ করতে হয়। যাক জান্নাতের কাছে ফিরে যাই।
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর মেয়েটা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। সবাই ভাবে ঠিকই তো আছে, বড় হচ্ছে, বুঝদার হচ্ছে, আগের মতো বাচ্চামি করছে না, এটাই তো হওয়া উচিত।
রবীন্দ্রনাথ এর বলাই গল্পে আমরা পড়েছিলাম, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা।’
এই বয়সের মেয়েদের অবস্থা কিন্তু এর থেকে ভালো না। বরং এরচেয়েও খারাপ। চোখে পড়ার মতো এমন কিছু পরিবর্তন তাদের মধ্যে আসে যেগুলোর সাথে এডজাস্ট করতে বা মেনে নিতে মেয়েদের অনেক সময় লাগে, মেনে নিতে মানসিকভাবে যুদ্ধও করতে হয়।
জান্নাতও এই পরিবর্তন গুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফ্রক পরতে পছন্দ করা বাচ্চাটাকে হুট করেই ওড়না কামিজ পরতে হচ্ছে। ওড়না সরে গেলে বা নিতে না জানলে বকা দেয়া হচ্ছে, ‘এত্তো বড় মেয়ে ওড়নাটা ঠিক মতো পরতে পারে না।’ কথায় কথায় এত্তোবড় শব্দটা খুব কানে লাগে জান্নাতের। মনে হয় কেন বড় হচ্ছি? বড় হওয়াটাকে অভিশাপ মনে হয়।
মুসলিম পরিবার, কনজারভেটিভ পরিবার হিসেবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পর্দা করতে হয়, শালীনভাবে চলতে হয়। আর এর জন্য কিছু আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সেই প্রস্তুতিটা নিতে হবে ধৈর্যের সাথে, ভালোবাসার সাথে।
জান্নাতের মনে হতে থাকে তাকে বাবা ছোটখাটো সব বিষয়ে বকা দেয়। মেয়েরা বাবাভক্ত হলেও বয়ঃসন্ধির সময় তারা মায়ের দিকে ঝুকে যায়। মাকে বলার অনেক কথা থাকে। জান্নাত মায়ের কাছে কথার ঝুড়ি নিয়ে গেলে তার মায়ের কাছ থেকেও বকা শোনে, কারণ মা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত। জান্নাতের মনে হতে থাকে, তার জন্য কারো কাছে সময় নেই, অথবা তাকে আগের মতো কেউ ভালোবাসে না।
জান্নাত একদম একা হয়ে যায়। কতো কথা জমে যায় তার! কাকে বলবে? কে সময় নিয়ে তার কথা শুনবে? এভাবে একা একা এই সময়টা পার করতে গিয়ে একসময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
জান্নাতের মতো এমন আরও অনেক মেয়ে আছে যারা বয়ঃসন্ধিকালের মতো এই কঠিন সময়ে একরকম একা একা কাটায়। অথচ এই সময় তাদের মানসিক সাপোর্টের খুব প্রয়োজন।
বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জগৎ। জন্মের পর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত তারা থাকে শিশু। এরপর ১১ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়ঃসন্ধিকাল। মেয়েদের ক্ষেত্রে ১১ থেকে ১৩ বছর। এসময় তাদের শরীরের হরমোনগুলোর বিকাশ ও পরিবর্তন হয়।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এই সময়টা আসে, এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। এ সময় ছেলেমেয়েদের মন মেজাজ খুব ওঠানামা করে। এই সবকিছু ভালো লাগে, পরক্ষণেই আবার সবকিছু খুব খারাপ লাগে। এক্ষুণি কোনো সিদ্ধান্ত নিলো তো পরক্ষণেই সেটা পরিবর্তন করে ফেলল। এক মুহূর্তেই দারুণ খুশি, কিন্তু একটু পরেই ঘন বিষাদে ছেয়ে যায় মন।
এ সময় শরীরের নিঃসৃত যৌন হরমোনগুলোই এই মন-মেজাজ পরিবর্তনের কারণ। কাউকে না মানার মনোভাব তাদের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে কাজ করে। এ সময় অনেকেই আবার নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
অনেকক্ষেত্রে জন্ম নেয় বিষাদগ্রস্ততা। ফলে তারা নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে নিদ্রাহীনতা বাসা বাধে, ক্ষুধামন্দা থাকে, মাথায় যন্ত্রণা হয়, শরীরে অজানা ব্যথায় ছটফট করে, দূর্বলতা অনুভব করে, নিজেকে সবার কাছ থেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। স্কুল যেতে চায় না, অনেক সময় পরীক্ষায় খারাপ করে। এভাবেই একটি সম্ভাবনাময় জীবনের অপমৃত্যু ঘটতে থাকে।
আমাদের করণীয় কী?
প্রথমেই আমাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ছোট্ট শিশুকে আমরা যেভাবে যত্ন নিয়ে বড় করি, একটু বড় হলেই সেটা কমে যায়। যুক্তি দেখাই, ও তো বড় হচ্ছে এখন। বড় হওয়ার সাথে সাথে এই যত্নের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু বাদ দেয়া যাবে না। ওদের বন্ধু হয়ে যেতে হবে আমাদের। যেন সব কথা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারে। তাহলে তারা কথা গোপন করবে না, বিপদগামী হবে না, সর্বোপরী কথা চেপে রেখে অসুস্থ হয়ে পড়বে না
বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে অসচেতনতার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, এটা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয় না। আলোচনার মাধ্যমে সবাইকে এই বিষয়ে জানানো উচিত।
কিন্তু এই আলোচনা কোথায় হওয়া উচিত, কাদের মধ্যে হওয়া উচিত, কীভাবে হওয়া উচিত এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি পরিবারে বাবা-মা নিজেদের মধ্যে, কাছের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে, বন্ধু-বান্ধব পরিমণ্ডলে প্যারেন্টিং নিয়ে আলোচনা করা যায়। যেহেতু প্যারেন্টিং একদিনে আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব না, আর বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের মানসিক ও শারীরিক যত্নের বিষয়টা প্যারেন্টিং এর একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাই সবসময়ই আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারি।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোন গেট টুগেদারে একত্র হলে, পুরুষ অভিভাবকরা চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি ইত্যাদি আলাপ-আলোচনায় মশগুল থাকেন, অন্যদিকে মহিলাদের আলোচনা রান্না-ঘর, শপিংমল ও পাশের বাসার ভাবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের সন্তানদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার জন্য আমাদের এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, নিজেদের চিন্তা-ভাবনাকে পরিবর্তন করতে হবে। প্যারেন্টিং নিয়ে আজকাল ভালো ভালো লেখকের ভালো ভালো বই পাওয়া যায়। সেসব বই কিনে নিজেদের পড়তে হবে, অন্যদেরকে উপহার দিতে হবে।
আমাদের পরিবারগুলো এখনো কুসংস্কার আর অন্ধ শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট। অভিভাবকদের অসতর্কতা অথবা অতি শাসনে সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে ভুল পথে চলে যায়। তাই এসব নিয়ে জানার ও জানানোর কোন বিকল্প নেই।
বর্তমানে যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে। আগে দাদা-দাদী আর পরিবারের বড়দের স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠতো বাচ্চারা। বাবা-মা শাসন করলে অন্যরা আদর করে বুকে টেনে নিত। কিন্তু আজকাল একক পরিবারের সন্তানেরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই বলা চলে একক পরিবারকাঠামোও সন্তানদের বিপথগামিতার একটি কারণ।
এক্ষেত্রে ছোট পরিবারগুলোতে বাবা-মায়ের সন্তানদের বন্ধু হওয়ার বিকল্প নেই। অনেক বাবা-মা সন্তানদের যথাযথ সময় না দিয়ে শুধু শাসন করতে পছন্দ করেন। আবার চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে কাছেই পায় না। কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানকে অতি আধুনিক হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে যায়। আবার কড়াকড়ি করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই সন্তানদের মনে ভয়, আতঙ্ক, একাকীত্বের অনুভূতি তৈরি করে।
অর্থাৎ সন্তানের মূল অভিভাবক, আশ্রয়স্থল, ভরসার জায়গা হচ্ছে পরিবার। পরিবার থেকে যদি সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া, ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেয়া, নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ দেয়ার পাশাপাশি একজন আন্তরিক বন্ধু উপহার দেয়া হয় তাহলে বয়ঃসন্ধিকালে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের শারীরিক পরিবর্তনটাই বেশি চোখে পড়ে। তাই অভিভাবকগণ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হন। হ্যাঁ, এ সময় পুষ্টিকর খাবারের খুবই প্রয়োজন আছে। খেয়াল রাখতে হবে, সন্তানদের খাবারে যেন ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস সহ সবকিছুই যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হয়।
শারীরিক বৃদ্ধির জন্য যেমন সুষম খাবার দরকার, তেমনি এ সময় সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য দরকার পিতামাতার কোয়ালিটি টাইম নিশ্চিত করা। আপনি যতই ব্যস্ত হোন আপনার সন্তানকে আপনার সময় দিতেই হবে। সেটা দিনের যে কোন একটা সময় না। সে যখনই আপনার কাছে ছুটে আসবে, আপনার তাকে এ্যাটেনশন দিতে হবে। সেটা ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড মাত্র। শুধু তার দিকে তাকিয়ে তার কথাটা শুনবেন, চোখে চোখ রাখবেন, তার কথাটার উত্তর দিবেন। ব্যস, এটাই যথেষ্ট তার জন্য। সে এটাই চায় আপনার কাছ থেকে। এক্ষেত্রে আপনি ব্যস্ততার অজুহাত দিলে আপনার সন্তানের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
পরিশেষে, যেকোন পরিবারে যদি ধর্মীয় পরিবেশ বজায় থাকে এবং সন্তানদের ধর্মীয় আচার-বিধি চর্চায় অভ্যস্ত করা হয় তাহলে সে পরিবারের সন্তান অবশ্যই ভালো হবে। আর পাশাপাশি সন্তানের মনের খবর জানার জন্য তার সার্বক্ষনিক বন্ধু, যাকে আমরা বলি বেস্ট ফ্রেন্ড হতে হবে। এক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধির সময় বাবা ছেলে সন্তানের বেস্টফ্রেন্ড আর মা হতে পারে মেয়ে সন্তানের বেস্টফ্রেন্ড।
সালসাবিলা নকি (রিভিউ এন্ড কন্টেন্ট রাইটার, গল্পকার)