BanshkhaliTimes

‘ব্রা মুক্ত’ দিবসের আদ্যোপান্ত

আজ ব্রা মুক্ত দিবস
———————-
‘নো ব্রা ডে’ মানে ব্রা খুলে অশ্লীলতা প্রদর্শন করা? কিংবা ‘নো ব্রা ডে’ কি ব্রা না পরে পালন করতে হবে? এটা একটা FAQ (Frequently asked question) উত্তর হচ্ছে— না। ‘নো ব্রা ডে’-তে ব্রা খুলে মিছিল করার মতো ব্যাপার নাই। প্লিজ, ভুল বুঝবেন না।

যাই হোক, প্রথমত এর উৎপত্তি এবং নামকরণ সম্পর্কে কিছু তথ্য নিয়ে নিই– বক্ষবন্ধনীর ইংরেজি “brassiere” (ইউকে /ˈbræzɪər/ বা ইউএস /brəˈzɪər/) শব্দটি সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে। সংক্ষেপে ও সাধারণত এটি ব্রা /ˈbrɑː/ নামেই উল্লেখিত। যদিও ফরাসী ব্রেসিয়ার শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল বাহুরক্ষক বা arm protector। প্রতিদিন সারা বিশ্বের কোটি কোটি মহিলা যে অন্তর্বাসটি পরিধান করে থাকেন, ইংরিজিতে যার নাম ব্রাসিয়ের কিংবা ব্রা, সেই বক্ষবন্ধনীর পেটেন্ট নথিভুক্ত করা হয় আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৪ তারিখে৷

স্বাস্থ্যগত বিষয় বলতে গেলে বলতে হয়- ব্রা এর স্বাস্থ্যগত সমস্যা বলতে তেমন কিছু নেই। তবে কেউ কেউ মত প্রদান করে থাকেন যে ঘুমানোর সময় ব্রা পরা অনুচিত। বেশি সময় ধরে ব্রা পরে থাকলে ঘামের কারণে চুলকানি জাতীয় সমস্যা হতে পারে। সঠিক মাপের বক্ষবন্ধনী ব্যবহার না করলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, প্রায় ৮০% মহিলাদের দেখা যায় ভুল মাপের বক্ষবন্ধনী পরতে; হয় খুব আটো (টাইট) কিংবা ঢিলেঢালা গড়নের বক্ষবন্ধনী পরে যা কিনা পরবর্তীতে শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মেরুদণ্ডে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, মানসিক অস্বস্তি খুবই সাধারণ যা প্রায়ই দেখা যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, ভুল মাপের বক্ষবন্ধনী ব্যবহারে স্তন ঠিক জায়গায় না থেকে বরং নিচের দিকে ঝুলে পরার প্রবণতাকে বৃদ্ধি করে।

মূলত, প্রথম No bra day ইভেন্টটি একটি বেনামী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দ্বারা ৯ জুলাই ২০১১ তে স্বনামধন্য “আনাস্টাসিয়া ডোনাটস” তৈরি করেছিল এবং সেটা ২০১৩ সাল ও ২০১৪ সালের মধ্যে ২০১৩ সালের ৯ জুলাই এবং ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি ব্রা ডে হিসাবে ঘোষিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছিল এবং প্রচারিত হয়েছে।

এই ঘোষণার পরে ফেসবুক পেজে অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দেওয়া হয়। অক্টোবর জাতীয় স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস, এবং ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিক দিন ঘোষনা করা হয়, এ সময় মহিলাদের একটি ব্রা পরাস্ত করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

২০১২ সালে ফেসবুকে প্রায় ৪,০০,০০০ ব্যক্তি অংশ নেয়। ২০১৭ সাল নাগাদ নিউজিল্যান্ড, রোমানিয়া, মালয়েশিয়া, স্কটল্যান্ড, ভারত এবং ঘানা সহ ৩০ টি দেশের নারীরা এই দিনটি পালন করেছিলেন। স্তন পরীক্ষা দিতে তাদের ব্রা না পরার জন্য মহিলাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার উপর, নারীদের braless যেতে এবং #nobraday হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ছবি পোস্ট করার জন্য উৎহিত করা হয়।

২০১২ সালে টুইটারে এবং ইনস্টাগগ্রামে ৮২,০০০ হাজারও বেশি নারী ছবি পোস্ট করেছেন। কিছু সাইট অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা স্তন ক্যান্সার দাতব্য দানে সুপারিশ করেছিলো। একজন রোমানিয়ান ফটোগ্রাফারের ধারণার উপর মূলধন এবং braless মহিলাদের চিত্রাবলী একটি অ্যালবাম প্রকাশ পায়।

আজ ১৩ অক্টোবর। অক্টোবর মাস ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতার মাস। ১৩ই অক্টোবর “No bra day”। এই একটা দিন অন্তত ব্রা খুলে নিজের স্তন দুটোকে পরীক্ষা করুন। এই ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। সাধারণত ৫০-৭০ বছর বয়সী মহিলারা ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার অধিক ঝুঁকিতে থাকে। এই রোগ কেন হয়? এর লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় এখনই জেনে নিন গুগল ঘেঁটে।

জনপ্রিয় মার্কিন অভিনেত্রী এ্যঞ্জেলিনা জোলির নাম হয়তো আপনারা অনেকেই শুনেছেন । অ্যাঞ্জেলিনা জোলির ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য তাঁর উভয় স্তন অপসারণ ও কৃত্রিম ভাবে পুনরায় স্থাপনের খবরটি এখন আমরা কমবেশি সবাই জানি।এতে করে তিনি তার ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুকি ৮৭% থেকে ৫% এ কমিয়ে এনেছেন ।
.
এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া জোলির পক্ষে মোটেও সহজ কোনো বিষয় ছিল না। দেহে জন্মসুত্রে পাওয়া জরায়ু এবং স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ি বিপদজনক BRCA1 জিন ধরা পরার পরই তিনি এই কঠিন কিন্তু দরকারি সিদ্ধান্তটি নেন। তার মা মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এই একই জিনের কারনে স্তন ক্যন্সারে মারা যান। স্তন ক্যান্সার নিয়ে যারা গবেষনা করছে তাদের অনেকেই বলছেন, জোলির এ উদ্যোগ আজকের নারীসমাজের চিন্তা-চেতনায় যোগ করবে নতুন মাত্রা। জোলির এমন মহতী পদক্ষেপকে প্রশংসা করেছে বিশ্বগণমাধ্যমও।

ষাটের দশকে র‌্যাডিক্যাল নারীবাদীরা বলেছিল “আমরা ব্রা পড়বো কেন? কার জন্য?” একই রকমভাবে অনেকেই লিপস্টিক দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল; তারা বলেছিল-“কার জন্য আমরা মুখে লাল-নীল রঙ মেখে সং সাজবো?”, তারা আরও অনেক কথা বলেছিল, “আমরা হাই-হিল পড়বো না; কেন পড়বো? হাইহিল পড়লে আমার বক্ষ এবং নিতম্ব উন্নত দেখাবে? কার কাছে উন্নত দেখাবে? পুরুষের কাছে? পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য আমাদের আর কি কি করতে হবে?” এখনকার অনেক র‌্যাডিক্যাল নারীবাদীরা ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের ঘোরতর বিরোধী।

অনেকের কাছে আচমকা লাগতে পারে। কিন্তু তাদের কথার যুক্তি আছে কি না? আপনি কি মনে করেন? আমি নিজেও হাইহিল জুতার বিপক্ষে; কারণ এতে অনেক হেলথ রিস্ক আছে। শরীরে নানা রকম সমস্যা হয়। পশ্চিমা দেশের মেয়েরা যারা রিসেপশনে কাজ করে, তারা আরামদায়ক জুতা পরে। কারণ হাইহিল পরে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক সমস্যা শুরু হয়ে গেছে; ফ্রান্সের একটি কোম্পানি ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের সামগ্রী বানাতো, তারা এখন জরিমানা গুনতে গুনতে দেউলিয়া।

১৯৮৫ সালে হলিউডের হার্টথ্রব অভিনেতা রক হাডসন এইডসে মারা যান । অথচ তিনি ছিলেন এমন দেশের বাসিন্দা, ধারণা করা হতো যে কোনো রোগ সহজেই প্রতিরোধ করতে সক্ষম সেই দেশ।
.
কিন্তু রোগ মানে না কোনো দেশ বা সেলিব্রেটি। এটা ভালো করেই বুঝেছিলেন জোলি। তাইতো সৌন্দর্যহানির চিন্তাকে বড় করে দেখেননি। জোলির এই সাহসী পদেক্ষেপ সবাইকে জানানোর মাধ্যমে বিশ্বের সকল নারীকে স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সার রোধে প্রতিষেধকের চাইতে প্রতিরোমূলক সুযোগ গ্রহনের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। জেনেটিক টেস্টিংকে নিয়ে এসেছে আলোচনার টেবিলে।

আইভিএফ হচ্ছে আরেকটি ইস্যু। যদি কোনো নারী কিংবা পুরুষ এর ফারটিলিটি সমস্যা হয়; কিংবা বাচ্চা নিতে সমস্যা হয় তাহলে এই ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। ফার্টিলিটি সমস্যা অনেক রকম হতে পারে; তারমধ্যে (১) স্বামীর সমস্যা (২) স্ত্রী’র সমস্যা। পুরুষের ক্ষেত্রে স্পার্ম কোয়ালিটি (স্পার্ম কাউন্ট, ঘনত্ব ইত্যাদি); আর মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্যতম জটিল সমস্যা হচ্ছে “আরলি ম্যানুপজ” কিংবা স্থায়ীভাবে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন রকম সমস্যা আছে। যেমন ওভারিয়ান ফেইলর (গর্ভপাত, টিউবে কন্সিভ করা ইত্যাদি)। আমি এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা “আরলি ম্যানুপজ” নিয়ে আলাপ করবো। এই সমস্যায় একজন নারীর দেহ ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন মা হতে হলে অন্য কারো কাছ “ডিম” গ্রহণ করতে হয়। ডিম গ্রহণ করার পদ্ধতিটি ল্যাবরেটরি নির্ভর। এই ব্যবস্থায় ল্যাবরেটরিতে “ডিম্বাণু”র মধ্যে স্পার্ম প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এতে করে এম্ব্রো (ভ্রূণ) জন্ম লাভ করে। সেই ভ্রূণ পরবর্তীতে মানব দেহে প্রবেশ করানো হয়। এই ব্যবস্থাকে বলে “ইনভেট্রো ফার্টিলিটি” কিংবা আইভিএফ।

আমি কেন এই আইভিএফ প্রসঙ্গ টেনে আনলাম? কারণ এখনকার যুগে অনেক পরিবার সন্তানহীনতা সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যায় অতীতে নারীদের তালাক প্রাপ্তা হতে হতো; অথবা সতীনের ঘর করতে হতো। এমন কি কেউ জানতেও পারতো না, সমস্যাটি কার? স্ত্রী’র না স্বামীর? সব দোষ নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হতো। অনেক সময় পীরের পানিপড়া খেলে সন্তান হবার কথা জানা যেত। কিন্তু আজকাল ডিএনএ টেস্ট আসার পর পীরেরা এখন আর আগের মতো পাইকারি দরে “বাবা” হতে পারছেন না।

আমি বেশ কিছু বাঙালি পরিবারের কথা জানি, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা “স্বামী’র”। এক্ষেত্রে তাদের কারো না কারো কাছ থেকে স্পার্ম ডোনেশন নিতে হবে। কিন্তু স্বামী মহাশয় রাজী হচ্ছেন না। পক্ষান্তরে অনেক বাঙালি পুরুষ কিন্তু তাদের স্ত্রী’র সমস্যা হলে আরেকজন নারীর কাছ থেকে “ডিম” নিতে সমস্যা বোধ করেন না। কেন? সমস্যাটি কি পুরুষতান্ত্রিক?

বাংলাদেশের নারীরা হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের নারীদের মুক্তির উপায় কি? অনেকেই এক কথায় বলবেন, “শিক্ষা”। আমিও আপনাদের সাথে একমত। শিক্ষায় মুক্তি এনে দিবে। তবে সেই শিক্ষা হতে হবে জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনমুখী। কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা উল্টোদিকে নিয়ে যেতে পারে। সেদিকে নজর দিতে হবে।

ইদানিংকালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষার অগ্রগতি বেশ লক্ষণীয়, এসএসসি, এইএসসি তে মেয়েদের ফলাফল রীতিমত ঈর্ষনীয়। কিন্তু একটু ভেবে দেখেছেন? কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো ছেলেদের আবাসিক হলের তুলনায় মেয়েদের হলের সংখ্যা কত কম? কারণ কি? স্কুল পর্যায়ে আমাদের দেশে নারী শিক্ষা ব্যাপকভাবে উন্নতি করেছে কিন্তু তারপরেই শুরু হয় ঝরে পড়ার মিছিল। কেন হচ্ছে? অনেকেই এখনো বলেন, ‘মেয়েদের পড়ানো অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। মেয়েদের অনেক কিছু লাগে।‘ অন্যদিকে মেয়ে সন্তানদেরকে এখনও আমাদের সমাজ অর্থকরী মনে করে না। মেয়েদের পিছনে শিক্ষার বিনিয়োগকে অলাভজনক মনে করে। এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের পরিবর্তন ছাড়া নারীদের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সর্বশেষ ঘুরেফিরে সেই জোলির কাছেই আসছি। জোলির মতে, তার এই সাহসী উদ্যোগ কোনো একসময়ে স্তন ক্যান্সার হবে এমন ১২ শতাংশ এবং স্তন ক্যান্সার নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন এমন ১০০ শতাংশ নারীর জীবনে আশার আলো জ্বালাবে। নিউইয়র্ক টাইমস এর সাথে এক সাতক্ষাৎকারে জোলি বলেন, আমি আশা করি আমার অভিজ্ঞতা থেকে অন্য নারীরাও উপকৃত হবেন। কারণ, ক্যান্সার এখনও এমন একটি শব্দ, যা কি-না আতঙ্ক তৈরি করে মানুষের হৃৎপিণ্ডে। এক ব্যক্তিগত নোটে জোলি লিখেছেন, ‘নিজেকে একজন নারীর চেয়ে কম কিছু ভাবি না আমি। তা সত্ত্বেও আমি এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা আমার নারীত্বকেই খর্ব করেছে ।

তথ্যসূত্র: অনলাইন ও উইকিপিডিয়া।

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *