একাত্তর একটি বিশ্বাস, একটি ভয়ংকর ও মহৎ অভিজ্ঞতা, একটি দূর্মর স্মৃতি, চেতনার জলসানো বিভাজনরেখা।
একাত্তরের ন’টি মাসে পুরো জাতির সাথে ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে আছে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, বিভীষিকা, মুক্তিসেনাদের অভিযান, ব্যর্থতা, সাফল্য, আত্মত্যাগ, গোষ্ঠী বিশেষের বিশ্বাসঘাতকতা। এ সবই আমাদের জীবনকে কতটুকু পুড়িয়েছে, কতটুকু খাঁটি সোনা করেছে, আজ এই প্রশ্ন উঠেছে। আজও এর কোন উত্তর মেলে না। যে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তারই একটি নাম সার্জেন্ট মহি আলম।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটির জন্ম বরিশালের মেহেদিগঞ্জ থানার উলুনিয়া গ্রামে।
পটিয়া থানার গৈড়লার টেক এলাকায় একটা খাল ও পটিয়ায় একটা রাস্তা উনার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বাঁশখালীর বাণীগ্রাম এলাকায় উনার নামে একটা রাস্তা আছে যদিও নামফলকটা এখন বিলীন। আর পাহাড়ের নাম আলমের টিলা হিসেবেই এলাকায় পরিচিত।
৭১ এ উত্তাল দিনগুলোতে বাঁশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেতৃত্বদান করে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া অকুতোভয় এক যোদ্ধার নাম শহীদ সার্জেন্ট মহি আলম।
স্বাধীনতার মাত্র ২৮ দিন আগে বাঁশখালীর সাধনপুর সাহেবের হাটের পূর্বে বোর্ড অফিসে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটি। তখন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা তার লাশ কাঁধে করে প্রায় ৫ কিঃমিঃ দুর্গম পাহাড় লাম্বাকাডা নামক স্থানে সমাহিত করেন। তার স্বজনরা অনেকদিন জানতোও না তাদের প্রিয় মানুষটি বাঁশখালীর দূর্গম পাহাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আমার ছোটকালে প্রায় ৩৫ বছর আগে পাহাড়ে গিয়ে দেখেছিলাম কবরে কিছু ইট দাঁড়িয়ে আছে, সংরক্ষণের অভাবে পুরোটা বিলীন প্রায়। আর গত মাসে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা চেনার কোন উপায় নাই পাহাড়ধ্বসে পুরো কবরটাও বিলীন হয়ে গেছে।।
গত কিছুদিন থেকে মনে একপ্রকার জেদ করেছিলাম যেভাবেই হোক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সার্জেন্ট মহি আলম এর বিলীন হয়ে যাওয়া কবরটা খুঁজে বের করব। হঠাৎ বিগত ৩০/৩/২০১৮ইং সকালে – আমি, স্নেহভাজন হুমায়ুন , অনুপ কুমার, শিমুল দেব ও বঙ্কিমকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম দূর্গম পাহাড় লাম্বাকাডার (প্রকাশ উতরের চেউঙ্গা) উদ্দেশ্যে।
চলতিপথে শুধু অজানা একটা ভয় ছিল কখন বন্য হাতির পাল এসে আক্রমণ করে তাই সতর্কতার সহিত এগোতে এগোতে একসময় পৌঁছেও গেলাম। প্রথমেই পুরো টিম হতবিহ্বল হয়ে গেলাম প্রকৃতি তার রুপ কতটা পরিবর্তন করতে পারে, না দেখে বিশ্বাস করা যাবেনা, পাহাড় ধ্বসে একেবারে বিলীন, তারপরও আমরা একসাথে খোঁজা শুরু করে দিলাম আমাদের পুরো টিমে তখন সবার মাঝে একপ্রকার টানটান উত্তেজনা। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য কবর হয়ত খু্ঁজে পাওয়া যাবেনা অন্তত একটা ইট যদি খুঁজে বের করতে পারি তাহলে আমরা সফল মনে করব, প্রায় ৩ ঘন্টা খুঁজাখুঁজির পরও কোন আশার মুখ না দেখে একসময় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরই মধ্যে আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলো পাহাড়ে লাকড়ি আনতে যাওয়া আমাদের পাড়ার লুলু দা ও বাণীগ্রাম এলাকার একজন মহিলা। তারা আমাদেরকে সহযোগিতা করাতে একসময় খুঁজে পেলাম জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ মহি আলমের বিলুপ্ত কবরস্থানটি যা মূল জায়গা থেকে প্রায় ২৫, ৩০ ফুট নীচে। লুলুদা জানাল বছর দুয়েক আগেও মাথার খুলিটা নাকি দেখেছে। আমি একটা ইটকে কাঠি দিয়ে পরিস্কার করতে গিয়ে দেখলাম ইটের গায়ে লিখা M. 71 পুরো টিম তখন একপ্রকার নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। জানতে পারলাম দেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময়ে বাণীগ্রাম সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্ররা নিজেরা ইট বহন করে নিয়ে ওখানে কবরস্থানটা সংস্কার করেছিল।
প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টার অনুসন্ধান শেষ করে ফিরে আসার সময় টিমে সবার মধ্যে তখন এক প্রকার আনন্দ যেমন দেখলাম একপ্রকার ক্ষোভও ছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা (জীবিত কিংবা মৃত) জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। হয়ত দুর্ভাগ্য আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জীবিত অনেক মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সহযোদ্ধাদের খবর নেওয়া তো দূরে থাক বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আলোচনা সভাতেও তাদের স্মরণ করার প্রয়োজন মনে করেন না। অথচ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোত্তম সহযোগিতা করে নজির স্থাপন করে চলেছে।
বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সার্জেন্ট মহি আলমের স্মৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসুন, আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব।
আগামী ১৭ই নভেম্বর সকাল ১০টায় সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণ ও বিকাল ৫টায়- চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনিস্টিউটে আলাদাভাবে বৃহৎ পরিসরে শহীদ সার্জেন্ট মহি আলমের স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে – এ মহান কাজে জড়িতদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।।
লেখক: সুশীল দে টুটু, সাধনপুর।