বিষন্নতা ও আত্মহত্যা থেকে দূরে থাকার উপায়
আফিফা মরিয়ম জয়া
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা আত্মহত্যা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকের অনেক মন্তব্য দেখতে পাচ্ছি। মনোবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে আমি যেটুকু জানি তা খুব সহজ করে যাতে আপনাদের বোধগম্য হয় তেমন কিছু তথ্য এখানে উপস্থাপন করছি।
আমরা জানি, আত্মহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Suicide. ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে Suicide শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে নিজে হত্যা করা।
আত্মহত্যার প্রধান কারণ হলো মানসিক অস্থিতিশীলতা। ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক সমস্যার সম্পর্ক থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ বা প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোন না কোন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। সুতরাং তরুণ বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক ভাবে অনেক । আবার বয়স বাড়ার পরও ৫০ বা ৬০ বছর হওয়ার পরও মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সাইকো-সোমাটিক ডিজিস বা ক্যানসারের রোগী অনেক সময় আত্মহত্যা করে বসেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ ‘গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরি রিপোর্ট-২০১৮’–তে আত্মহত্যা বিষয়ক এ তথ্য উঠে এসেছে যে উন্নত দেশের তুলনায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে আত্মহত্যার হার ৭৯ গুণ বেশি। সমস্যা চিহ্নিত করতে দেরি হওয়া, চিকিৎসা ও সহযোগিতার ঘাটতির কারণে এমনটা ঘটে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। বছর শেষে এ সংখ্যা পৌঁছে আট লাখে।
আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিষণ্নতার কারণে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়া মানসিক বিকৃতির মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যান্য অবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সিজোফ্রেনিয়া (১৪%), ব্যক্তিত্বের রোগ (৮%), মোটা হওয়া জনিত ব্যাধি, এবং ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন যখন severe হয়ে যায়, কাউন্সিলিং এর সাথে সাথে ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয় তখন তাকে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা Major Depressive Disorder বলে। সোজা বাংলায় ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বলতে অ-সুখ বোঝায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, Antidepressant Drug আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। তবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়া এবং তার নির্দেশনা বলী মেনে চলা উচিত।
হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ সবই আমাদের ব্রেনের কেমিক্যালসের কারণে হয়ে থাকে। আর ডিপ্রেশন আমাদের ব্রেনের এই কেমিক্যাল ইমব্যালেন্স এর কারণে হয়।
ডিপ্রেশন/বিষণ্ণতার লক্ষণ:
* কখনো খুশি কখনো উদাসী। সকালে ভালো বিকেলে খারাপ। আজ বেশ আনন্দে আছে কাল মানসিক যন্ত্রণায় গুমরে মরছে।
* জীবনটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। কখনো ভাবে এই জীবন জীবন নয়। কখনো ভাবে এইতো বেশ আছি, ভালো আছি।
*জীবনের প্রতি ঘৃণা বা উদাসীনতা। মনে হয় এই জীবনটা অর্থহীন।
* বিরূপ সমালোচনা করলে ক্ষুব্ধ হয় বা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
* পরাজয় বা ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না।
* অন্ধকারকে ভয়, কোনো জন্তু, পোকা, পানি, আগুনের ভয় বা অজানা আতঙ্ক। বারবার হাত-পা ধোয়া, গোসল করা, খিটখিটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। আবার অহেতুক চিন্তা ও উত্তেজনা, অল্পতেই ঘাবড়ে যাওয়া, ভেঙে পড়া।
* কাজ করার ইচ্ছা হয় না। উৎসাহের অভাবে অল্প বয়সেই ক্লান্তি অনুভব করা। কাজ করার ক্ষমতা আছে কিন্তু ইচ্ছার অভাবে কিছুই করতে চায় না। অলসতা যেন গ্রাস করে ফেলছে। এমনকি খেলাধুলা বা পড়াশোনার ক্ষেত্রেও উৎসাহের অভাব হলে বুঝতে হবে ডিপ্রেশন হয়ে আছে।
* গোসল করা, কাপড় ধোয়া, খাবার ইচ্ছে ত্যাগ। গোসল করতে চায় না, খেতেও ইচ্ছুক নয় আবার ময়লা পোশাকেই যেন থাকতে চায়, এমতাবস্থায় বুঝতে হবে ডিপ্রেশনে ভুগছে।
* কখনো কম ঘুমায়, কখনো সব সময় শুয়ে থাকতে ভালোবাসে।
* হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকলে ডিপ্রেশন আসে। বয়ঃসন্ধিকালে এই ধরনের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়।
* ইমোশনাল হওয়া ভালো কিন্তু অতি ইমোশনাল হওয়া ভালো নয়। এ হলো ডিপ্রেশনের লক্ষণ।
* ইমোশনাল ব্যক্তি বারবার চেষ্টা করে অন্যকে আকর্ষিত করতে। যখন পারে না বা নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যখন ব্যর্থ হয়, তখন ডিপ্রেশন আক্রান্ত হয়ে যায়।
ডিপ্রেশনের জন্য আমরাই দায়ী। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেমন মা-বাবা দায়ী, তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই দায়ী, বয়স্কদের ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ দায়ী। সব কথার শেষ কথা হলো, ডিপ্রেশন যেহেতু মানসিক রোগ, সেহেতু ওই রোগের আক্রমণকে অনুভব করে, নিজেই নিজের শিক্ষক হতে পারলে বহুলাংশে উপকৃত হওয়া যায়। এ ছাড়া ডিপ্রেশন কেন হচ্ছে যদি বোঝা যায়, তাহলে যেমন মেডিটেশন তেমনি ভালো ডাক্তারের সুপরামর্শ তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে সাহায্য করে।
ডিপ্রেসন থেকে বাঁচার জন্য যা করা যেতে পারে—
* লক্ষ্য রাখা দরকার সব সময় যেন নৈতিকতার মাধ্যমে আনন্দে থাকা যায়।
* সুখ-দুঃখ টাকার এপিঠ আর ওপিঠ। দুটোকে মেনে নিতে হয়।
* চিন্তার পরিবর্তন দরকার। বিষাক্ত চিন্তা, ব্যর্থ চিন্তা, নেতিবাচক চিন্তা, অহেতুক চিন্তা, ভয়ের চিন্তা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা নিতে হবে। তার জন্য ম্যানেজমেন্টের কথা হলো, কথা বলো, শান্ত থাক, ইতিবাচক হও, অন্যকে নয় নিজেকে বদলাও।
* আমাদের মধ্যে যেমন অনেক গুণ আছে তেমনি আবার ত্রুটিও আছে। ত্রুটিগুলোকে স্মরণ করা ও কাজে লাগানো দরকার।
* নিজের কাউন্সেলিং নিজে করা দরকার। বিশেষ করে রাতে শোয়ার আগে, সারা দিনের অ্যাকাউন্ট চেক করা এবং পরের দিন পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তার প্রতি লক্ষ্য রেখে নতুনভাবে শুরু করা।
* মনের প্রভু তো আমি। মন আমার দাস। তাই মনকে দমন নয় বরং সুমনে পরিবর্তন করা দরকার।
* কেউ আমাকে বিরক্ত করলে কেন বিরক্ত হব? আমি পারমিশন দিচ্ছি কেন? কারণ মন দুর্বল তাই। মনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা দরকার।
* আমি যা আমি তাই। মেনে নিতে হয়। লক্ষ্য মহৎ হলে সফলতা আসবেই। ধৈর্য ও সহনশীলতার কবচ সঙ্গে থাকলে জয় হবেই হবে। এক্সপেক্ট ও রিজেন্ট এই অঙ্ক জানা থাকলে ডিপ্রেশন আসবে না।
* তরুণ-তরুণীরা মাথাকে যত ব্যবহার করবে ততই ভালো থাকবে।
* যত সিম্পল হওয়া যাবে ততই ডিপ্রেশন মুক্ত থাকা যাবে। অসম্ভব কথাটা আমাদের অভিধানে থাকতে নেই।
* নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সঙ্গে নিয়ে চললে ডিপ্রেশনকে প্রতিহত করা যাবে।
* ভুলে যাও, ক্ষমা করো এই দুটো শব্দ ডিপ্রেশন মুক্ত জীবনের চাবিকাঠি।
* ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকা দরকার। এ জন্য ভুলকে ঠিক করতে ভুল নয়।
* হীনতাকে সহযোগী করা উচিত নয়।
* তর্কে তর্ক বাড়ায় সেই জন্য প্রয়োজনে হার স্বীকার করা ভালো। এই হার হার নয়, এই হার তৃপ্তি আনে।
* রোগ আসবে কিন্তু রোগী হওয়া ঠিক নয়। রোগ দেহের হয়, চিকিৎসা করা দরকার কিন্তু মন যেন রোগাক্রান্ত না হয়ে যায়।
* ক্রোধকে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা দুর্বলতার লক্ষণ। দুর্বল নয়, সবল হওয়া দরকার। ক্রোধ আসলে বিরাম নেওয়া দরকার। তিন-চারবার গভীর শ্বাস নিলে ক্রোধ কমে যাবে।
* শুভ ভাবনার এনার্জি বিকিরণ করা দরকার।
* নিজের পছন্দ মতো সবকিছু সব সময় হবে আশা করা বৃথা। সেই জন্য পছন্দ মতো যদি না হয়, তাহলে ইগোকে দূরে ঠেলে সবকিছুকে মেনে নেওয়া দরকার।
* শ্রদ্ধা এক ধরনের ইতিবাচক এনার্জি। সবার জন্য সমান হওয়া দরকার সে ছোট হোক আর বড়।
* মা-বাবারা কীভাবে সন্তানকে ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত রাখবেন তার জন্য নিজে নিজেই চেষ্টা করা দরকার এবং প্যারেন্টিং সম্পর্কে জানা দরকার । সেই চেষ্টা করতে কার্পণ্য করা উচিত হবে না।
* বহির্জগৎ, টিভি, ইন্টারনেট, সেল ফোন ডিপ্রেশন সৃষ্টি করে সেই জন্য নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসবের ব্যবহার করা উচিত। অন্যথায়,এর বিরূপ প্রভাব দৈনন্দিন জীবনযাপনে পড়বে।
আমাদের আশেপাশে কেউ বিষণ্ণতায় ভুগলে তার প্রতি সহমর্মি হতে হবে, তার পাশে থেকে তাকে এই অন্ধকার থেকে বের করে আনতে হবে। ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার সাথে একা যুদ্ধ করা কঠিন। তাই সকলের উচিত একে অপরের কথা শোনা এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করা।
মনে রাখবেন- দোয়ার সাথে দাওয়ারও প্রয়োজন। সুতরাং ওষুধ, কাউন্সেলিং, যোগাসন, মেডিটেশন করা দরকার। এতে করে আবার সুস্থ জীবন ফিরে পাওয়া যাবে।
লেখক:
ইন্টার্নশিপ, শিশু বিকাশ কেন্দ্র
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হসপিটাল মেডিকেল কলেজ,
স্নাতকোত্তর, স্পিচ এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজি
যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়