আজ বাবা দিবস, বিশ্বের সব বাবাদের নমস্কার জানাই।
আমার বাবার অনেকগুলো কথা আজ মনে পড়ে…
প্রায়ই দেখতাম, বাবা মাকে বলছে, ও এখনো বাড়ীতে ফেরেনি? ও আর মানুষ হলোনা। আমার ছেলেমেয়েদের শৈশবে চকলেট কিনে দিতাম বলে রাগ করে মাকে বলতো, আমি ওকে সাধনপুরের ঐতিহ্যময় নেপাল বাবুর দোকানের খাঁটি ছানার মিষ্টি কিনে দিতাম, ও আমার নাতিদেরকে দিচ্ছে বাজে চকলেট।
মনে পরে একবার বাবা’র সাথে ঋষিধামে কুম্ভ মেলাতে গিয়ে ভীড়ের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা কোথায়? কিভাবে খুঁজে পাবো, কেমন করে বাড়ী ফিরবো ভাবতে ভাবতে দেখি হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে আসছে আমার বাবা। বকা খাওয়ার ভয়ে মাথা নীচু করে আছি। দেখি মাথায় পরম নির্ভরতার হাত দিয়ে বাবা বলছে, দুর পাগল, তোকে আমি খুঁজতে খু্ঁজতে শেষ। কাঁদছিস কেন? আমি কি তোকে ফেলে বাড়ীতে যাবো? এ কথা শুনে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম।
বাবা, তুমি কথা রাখোনি। আমাদের সবাইকে একা ফেলে তুমি চলে গিয়েছো। বাবার একটা স্কুটার ছিল। স্কুটারে চড়ে কত জায়গায় গিয়েছি বাবাসহ একসাথে। ফিরেও এসেছি।
শুধু যেবার তুমি আমার কাঁধে চড়ে শশ্নান কালী বাড়ীতে মহাশশ্মানে গেলে, তুমি আর ফিরে এলেনা।
পৃথিবীর সকল বাবা সুখী হোক, আর যারা করোনাভাইরাসে না ফেরার দেশে চলে গেছেন সে বাবাদের চিরসদগতি কামনা করি।
আমি তোমারই এক হতভাগা ছেলে তাপস।
পুনশ্চ :কেন বাবা দিবসঃ
——————————
পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান। পরিবারের প্রধান হিসেবে নানান দায়িত্বের বোঝা থাকে তার কাঁধে। বাবা হওয়ার মতো গুরু দায়িত্বের কারণে তাকেই সইতে হয় বাইরের সব রকম যন্ত্রনা। আবার ঘরের ব্যাপারাগুলোও তাকে ভুলে থাকলে চলে না। ছেলে-মেয়েদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টিও তার নজরে রাখতে হয়। পরিবারের প্রধান হিসেবে সকল ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। বাবা-মা নিজের সব প্রয়োজনকে অবহেলা করে আপনার প্রয়োজন পূরণ করেছেন, নিজের সব আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে আপনার আরামের চেষ্টা করে গেছেন। আপনার অসুস্থতায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়, অনুভব করা সম্ভব। তাই সব সময় বাবাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার সাথে বিশেষ ভাবে স্মরণ করে রাখার জন্যই আমরা এ দিনটিকে পালন করে থাকি।
বাবা দিবসের ইতিহাস:
১৯০৯ সালে ডড দেখলো মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য একটি দিন আছে কিন্তু বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের কোনো দিন নেই। তাই ডড ভাবলো মা দিবসের মতো বাবা দিবস থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তার এ ভাবনা যখন অন্যরা শোনে তখন হেসেই উড়িয়ে দিল। এমনকি তাকে নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা শুরু করে দিল। কিন্তু ডড এতে ভীষণ কষ্ট পেলেও দমলো না একদম, বরং তার মধ্যে জেদ আরো প্রবল হয়ে উঠলো। সে বাবা দিবস পালনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলো। প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে সে সফল হলো। পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে ওয়াশিংটনের স্পোকান নামে ছোট্ট শহরে (ডডের নিজ শহর) কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে পালিত হলো বাবা দিবস।
তারপর ১৯১৬ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ দিবসকে সমর্থন করেন। এক সময় এটা তাদের জাতীয় আইনসভাতেও স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশ বাবা দিবস পালন:
বাবা দিবসের পালনের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। তারপরও বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮৭টি দেশ দিবসটি পালন করে। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের ৫২টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। মা দিবসের মত বাবা দিবসও বিশ্বের সকল দেশে একই দিনে পালন হয় না। এমনকি বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালনের রীতিতেও কিছু পার্থক্য রয়েছে।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করে বেশ কিছু দেশ। এগুলো হচ্ছে; বাংলাদেশ, অ্যান্টিগুয়া, বাহামা, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, কলাম্বিয়া, কোস্টা রিকা, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রিস, গায়ানা, হংকং, ভারত, আয়ারল্যান্ড, জ্যামাইকা, জাপান, মালয়েশিয়া, মাল্টা, মরিশাস, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, ফিলিপাইন, পুয়ের্টো রিকো, সিঙ্গাপুর, স্লোভাকিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, সুইজারল্যান্ড, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা ও জিম্বাবুয়ে।
ইরনে বাবা দিবসঃ ১৪ মার্চ। লিভিয়া, ইটালি, হন্ডুরাস, পর্তুগাল ও স্পেন বাবা দিবসঃ মার্চ মাসের ১৯ তারিখ।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বাবা দিবসঃ প্রতিবছর মে মাসের ৮ তারিখ, লিথুনিয়ায় বাবা দিবসঃ জুন মাসের প্রথম রবিবার, ডেনমার্কে বাবা দিবসঃ ৫ জুন, অস্ট্রিয়া, ইকুয়েডর ও বেলজিয়াম বাবা দিবসঃ জুনের দ্বিতীয় রবিবার, এল সালভেদর ও গুয়েতেমালা বাবা দিবস পালন করে ১৭ জুন। নিকারাগুয়া, পোল্যান্ড ও উগান্ডা ২৩ জুন পালন করে বাবা দিবস।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উরুগুয়ে জুলাই মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালন করে বাবা দিবস। ডমিনিকান রিপাবলিক জুলাই মাসের শেষ রবিবার দিবসটি পালন করে।
আর্জেটিনা বাবা দিবস পালন করে ২৪ আগস্ট। ব্রাজিল বাবা দিবস পালন করে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আগস্টের ৮ তারিখে বাবা দিবস পালন করে তাইওয়ান ও চিন।
সেপ্টেম্বর মাসের পূর্ণিমায় বাবা দিবস পালন করে নেপাল। সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার বাবা দিবস পালন করে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড। লুক্সেমবার্গ বাবা দিবস পালন করে ৫ অক্টোবর এবং একই মাসের দ্বিতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করে এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেন। থাইল্যান্ড ৫ ডিসেম্বর বাবা দিবস পালন করে।
বিভিন্ন ভাষায় বাবা–
বাংলা ভাষায়ঃ বাবা বা আব্বা, জার্মান ভাষায়ঃ ফ্যাট্যা, ড্যানিশ ভাষায়ঃ ফার, আফ্রিকান ভাষায়ঃ ভাদের, চীনা ভাষায়ঃ বা, ক্রী(কানাডিয়ান) ভাষায়ঃ পাপা, ক্রোয়েশিয়ান ভাষায়ঃ ওটেক ,পর্তুগিজ, ভাষায়ঃ পাই,ডাচ ভাষায়ঃ পাপা, ইংরেজি ভাষায়ঃ ফাদার, ড্যাড, ড্যাডি, পপ, পপা বা পাপা,ফিলিপিনো ভাষাঃ তাতেই, ইতেই, তেয় আর আমা, হিব্রু ভাষায়ঃ আব্বাহ্, হিন্দিভাষারঃ পিতাজী, ইন্দোনেশিয়ান, ভাষায়ঃ বাপা কিংবা আইয়্যাহ, জাপানিজ ভাষায়ঃ ওতোসান, পাপা, পুর্ব আফ্রিকান ভাসায়ঃ বাবা
হাঙ্গেরিয়ান ভাষায়ঃ পাপা
লেখক: তাপস কুমার নন্দী, সার্কুলেশন ম্যানেজার, দৈনিক পূর্বকোণ