ক্রিকেট পাগল বদি কাকা প্রতি চার বছরে একবার ফুটবল বিশারদ হয়ে যান। এটা মূলত ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুমে। এছাড়া বাকি সময় তিনি ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকেন। এলাকার ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয় মানু্ষ বদি কাকা নিমিষেই বলে দিতে পারেন ফুটবল এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপের যাবতীয় খুঁটিনাটি। শিক্ষক হিসাবেও তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। বর্তমানে অবসরজীবন। এলাকার সকলের সাথে মজার সম্পর্কই তার বেঁচে থাকার মূল উপকরন। জ্ঞানপিপাসু বদি কাকা সবসময় তথ্যসংবলিত ও যুক্তিসহ কথা বলাতে পছন্দ করেন। এলাকার সকলের কাছে উনার গ্রহণযোগ্যতা বেশ চমৎকার।
সবচেয়ে আজব বিষয় হলো ফুটবল বিশ্বকাপে অন্যদের একটি দল পছন্দ থাকলেও উনার পছন্দের দল দুটি। একটি অার্জেন্টিনা অন্যটি ব্রাজিল। তার ধারণা প্রতিবছরই দুটি দলে নান্দনিক কিছু খেলোয়াড় আসেন যারা ফুটবলে বিশ্বকে একের পর এক চমক উপহার দেন। যেহেতু নিজেদের দেশ এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না সেহেতু সে দুটি দলকেই সমর্থন করবে। আর দু’দল কখনো মুখোমুখি হলে উনি লটারি করে একটি দলকে বেছে নিবেন।
সে যা-ই হোক রোজার মাস আমাদের সাথে থাকবে বলে বহু কষ্ট করে রাজি করিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এনেছি বদি কাকাকে। কাকা বললেন শহরে উনার মন টিকে না। খোলামেলা জায়গা নেই, মুখগুলো সব অপরিচিত ইত্যাদি সমস্যাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
যদিও আসল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়। তা হলো ক’দিন পরেই বিশ্বকাপ। এ উপলক্ষ্যে এলাকায় বিশাল বিশাল পতাকা তৈরি হবে তার নেতৃত্বে, আর্জেন্টিনা ব্রাজিল দুভাগে বিভক্ত হয়ে খেলা হবে এলাকায় এতো সব আনন্দ রেখে কে চায় শহরে বদ্ধ খাঁচায় বন্ধি থাকতে।
কী আর করার কাকার যাতে বোর না লাগে সেকারণে ছোট ভাই আসাদকে বলে বাসার পাশে ওর কোচিং সেন্টারে কাকাকে একটা ক্লাসে নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। তাতে উনার সময়গুলো হয়তো ভালো কাটবে। বিষয়টা সত্যিই অবাক করার মতো। শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে উনি এতো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন বুঝতে পারি নি। শুধু তা নয় আমি যে বাসায় থাকি অর্থাৎ টাইটানিক বিল্ডিং এর আটচল্লিশটা ফ্লাইটের প্রায় সকল ছেলে মেয়েই কাকাকে চিনে। এর কারণ হলো আসাদের কোচিং সেন্টার অল্প সময়েই খুব নাম করেছে যে কারণে এলাকার স্কুলগামী প্রায় সব ছেলেমেয়েই আসাদের কোচিং এ পড়ে। আর কাকা বর্তমানে এই কোচিং এর অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিক্ষক।
****
ইফতার শেষে কোনো রকম নাকেমুখে এক কাপ চা শেষ করেই ছাদে চলে যায় বদি কাকা। তারপর আরাম করে বসে পরপর দুটো সিগারেট শেষ করে। সিগারেট খাওয়া নিয়ে আমার আপত্তি থাকলেও তেমন কিছু বলি না। কাকা যথারীতি তার কাজের জন্য ছাদে চলে গেছেন। হঠাৎ চোখ পরতেই দেখি কাকা সিগারেট প্যাকেট ও লাইটার দুটোই বাসায় রেখে গেছেন। সে কী সিগারেট ছাড়া ছাদে গিয়ে বেচারা বদি কাকা একা একা কী করছে ! ছাদে গিয়ে দেখি কাকা একা নয়। তাকে ঘিরে কিশোর যুবক ছেলেদের বেশ জটলা। দূর থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করছি কাকা আবার কোনো ঝামেলা করলো না তো! হৈচৈ হলেও ঝামেলা মনে হয় না। তিনি ছেলেমেয়েদের হাত নেড়ে কিছু একটা বুঝাচ্ছেন। আর বিষয়টা হলো ফুটবল বিশ্বকাপ। অর্থাৎ বিশাল টাইটেনিক বিল্ডিং এর ছাদের অর্ধেকটা ব্রাজিল অর্ধেকটা আর্জেন্টিনার পতাকা থাকবে। কোনো ঝগড়া করা যাবে না। মালিকের সাথে কথা বলে একটা প্রজেক্টর এর ব্যবস্থা করা হবে। তাতে বড় পর্দায় এক সাথে সবাই খেলা দেখতে পারবে। বেশ ভালোই লাগছে কাকার সময় ভালো যাচ্ছে ভেবে।
দুদিন পর কাকা ইফতারের টেবিলে বললেন বুঝলি তোদের এই বিল্ডিংটা এবার বিশাল বিশাল পতাকা দিয়ে মুড়ে দেয়া হবে। আমি অবাক হবার ভঙ্গিমায় বললাম বলেন কী! উনি বললেন হ্যাঁ লাখ টাকার উপরে বাজেট। বললাম, এতো টাকা কে দিচ্ছে?
উনি হেসে বললেন, আমরা হলাম আমোদে জাতি সুতরাং টাকা কোনো সমস্যাই না। সে যা হোক অনেক কাজ। পতাকা দুই দলের জার্সি আর এছাড়াও বাড়িওয়ালা মজুমদার সাহেব নিজেই প্রজেক্টর দিচ্ছেন খেলা দেখার জন্য।
খেলার সময় ঘনিয়ে আসছে। কাকা কোচিং এবং এই খেলাধুলার বড় দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িওয়ালা মজুমদার সাহেব আমাকে জীবনে এক গ্লাস পনিও খাওয়ান নি অথচ দু দিন ধরে নিয়মিত তার বাসায় ইফতারের দাওয়াত খাচ্ছেন বদি কাকা।
বেশ বড় ফান্ড জমছে। এক এলাহী কাণ্ড যেখানে বিল্ডিংর কেউ কাউকে ভালো করে চিনতেন না সেখানে সবাইকে নিয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি বদি কাকা। ইফতার মাফিলে মুনাজাত শেষে কাকা সবার উদ্দেশ্যে জানতে চাইলেন, আমরা পতাকা জার্সি এসব কী ঈদের আগেই কিনব না পরে? কেউ বলছেন নগদ কিনে ফেলতে হবে কেউ বলছেন পরে। যারা পরে বলছেন তাদের যুক্তি হলো ঈদের আগে দর্জিরা ব্যস্ত থাকবে যেহেতু অত্র এলাকার সবচেয়ে বড় পতাকা তৈরি হবে, সংবাদ শিরোনাম হবে সেহেতু ঈদের পরেই বানানো ভালো। নানা জনের নানা মত। বদি কাকা চুপচাপ বসে আছেন।
মজুমদার সাহেব বললেন আমাদের সম্মানিত অতিথি বদি সাহেব যেটা বলবেন সেটাই করব। সবাই সম্মতি দিলেন। কিন্তু কাকা কিছু বলছেন না। তার চোখ ভরা জল। হঠাৎ কান্না করে ফেললেন। সকলের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বললেন আমি খুব অন্যায় করছি আমাকে ক্ষমা করবেন। গত সন্ধ্যায় ইফতারের আগে এই ছাদে বসে ছিলাম হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের বস্তিতে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পরিবারের সাথে ইফতার করছে অথচ তাদের প্লেটে ভালো কোনো ইফতার নেই। শরীরে ভালো জামা কাপড় নেই আর আমি আপনাদের উৎসাহিত করছি বিল্ডিংকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পতাকা দিয়ে জামা বানাতে। অথচ এতোগুলো টাকা দিয়ে অনায়াসে ওদের ঈদের নতুন জামা হয়ে যেতো। আমি এই পাপ কাজ করতে পারব না। কেউ না খেয়ে না পড়ে থাকবে আর আমি ভিনদেশি পতাকা আর জার্সি বানিয়ে এতো টাকা খরচ করব তা হতে পারে না। টাকা আমি মজুমদার সাহেবকে বুঝিয়ে দিব আপনারা যার যার টাকা নিয়ে নিবেন। অামি গ্রামের মানু্ষ শহরের অনেক কিছুই বুঝি না। সবাই ক্ষমা করো দিবেন আমি কালই গ্রামে চলে যাব।
হঠাৎ পিন পতন নিরবতা। বদি কাকা চোখ মুছতে মুছতে বসে পড়লেন। মজুমদার সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, যে টাকা তুলেছি তা ফেরত না দিয়ে যদি আমরা বস্তির সব গরীব বাচ্চাদের জন্য ঈদের জামা কিনি আর ঈদ উপলক্ষে সেমাই চিনি দুধ বিতরণ করি কেমন হয়?
হঠাৎ যেন সকলের মাঝে প্রাণ ফিরে পেলো। সবাই বললো আমরা এই ছাদে বসে একসাথে খেলা দেখব তবে কোনো পতাকা হবে না জার্সি হবে না এই টাকায় হবে গরীবদের ঈদ।
মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শুরু হলো সকলেই আনন্দপূর্ণ ইফতার পার্টিতে সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বকাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বদি কাকা কোথাও যেতে পারবেন না।
লেখক: আরমানউজ্জামান
কথাসাহিত্যিক