সরকারের টানা দু’মেয়াদে দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিক একটি গতি পেয়েছে। অর্থনীতির এ গতি সচল রাখতে স্থিতিশীল সরকারব্যবস্থারও প্রয়োজন রয়েছে। শুধু অর্থনীতির গতিকে সচল রাখলে হবে না; অন্যান্য দিকগুলোতেও ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।দেশের বৃহৎ একটি জনসমষ্ঠিকে বেকার ( ২৬ লাখেরও বেশি) রেখে সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই বেকারের সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশ পুনর্গঠনে হাত দিলেন, তখনই তিনি জনসংখ্যার বিষয়টি আমলে নেন এবং বেকারসমস্যা নিরসনের জন্য কার্যকরী উদ্যোগ নেন। বর্তমান সরকারও বেকারসমস্যা নিরসনে শূন্যপদগুলো পূরণে আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়েছে।বাড়ছে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাও। যাঁরা নিয়োগপরীক্ষায় অংশ নেয় তাঁদের অধিকাংশ বেকার। রাষ্ট্রের উচিত হবে অধিককসংখ্যক জনসমষ্ঠির প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া। গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগপরীক্ষার মধ্যে বিসিএসপরীক্ষা অন্যতম। বিসিএসপরীক্ষাসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বিপিএসসি ( Bangladesh Public Service Commission) নিয়ে থাকেন। দক্ষব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া বিভাগীয় শহরে এনটিআরসিএ ( Non-Government Teacher’s Registration and Authority) শিক্ষকনিবন্ধন পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।এখানেও দেখতে পাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়োগপরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে আসছে।আরও কিছু কিছু নিয়োগ-পরীক্ষাও বিভাগীয় শহরে নেওয়া হয়।এসবই মূলত সৎ-উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করছে।
কিন্তু এখনও দেখাযায়, ব্যাংকনিয়োগ পরীক্ষা থেকে শুরু করে অধিকাংশ নিয়োগ-পরীক্ষা ঢাকাকেন্দ্রিক।ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষা নিতে পারলে কর্তৃপক্ষ নিজেকে বেশ নিরাপদ মনে করেন, ভুলেই যান পরীক্ষারর্থীদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির কথা। মূলত এখানেই হয়রানির যাত্রা শুরু।নিয়োগ-পরীক্ষা নামে ঢাকাগামী বহর বন্ধ করা না গেলে বেকারেরা আরও দুর্দশা ও হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। বাস-ট্রেনে সারারাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে ভালোমতো পরীক্ষা দেওয়া অনেকাংশে দুরূহ হয়ে পড়ে।তাছাড়া ঢাকা শহরের যানজটের কারণে ঢাকায় পৌঁছার পরেও অনেকাংশে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় না।বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে সকালে ঢাকায় পৌঁছে পরীক্ষার হল (hall) খুঁজতে নিমগ্ন হয়ে পড়েন পরীক্ষার্থীরা।কী খাওয়া-দাওয়া, কী ঘুম, কী প্রস্রাব-পায়খানা কিছুই হয়ে ওঠে না সময়মতো।পরীক্ষা শেষে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েন।
বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় পুরুষের সমানে সমান, ক্ষেত্রবিশেষ এগিয়েও রয়েছেন।কিন্তু দূরপ্রান্ত থেকে একাকী (মেয়ে) ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়াতে নিরাপত্তাহীনতার কারণে চরম ঝুঁকিতে থাকেন।নারীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে অভিভাবকেরা তাদের ( মেয়ে) একাকী ছেড়ে দিতে চান না।কাউকে না কাউকে সাথে পাঠাতেই হয়।তাছাড়া সবদিক বিচার করলে এতে দেশের অর্থসম্পদের ব্যাপক অপচয়ও হচ্ছে।রাষ্ট্রের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের চাকরির নামে ঢাকাযাত্রা থেমে দিয়ে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়া। ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চরম দুর্ভোগের অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত।এ দুর্ভোগ বন্ধ করতে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করাটাই হবে সহজ একটি সমাধান।
ঢাকা শহরে নিয়োগ-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়াতে লাভবান হচ্ছেন শুধু পরিবহন মালিকেরা। আর এটির খেসারত দেয় বেকার জনসমষ্ঠি।এ যেনো ‘মরার ওপর খরার ঘা’।গুটিকয়েকের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বৃহৎ অংশকে বেকায়দায় নিমজ্জিত করাটা কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদি বিভাগীয় পর্যায়ে পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয় বেকারজনসমষ্ঠি তাদের কাছাকাছি কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারবেন, আর আর্থিক সংকটেও পড়তে হবে না। থাকবে না কোনো ধরনের ঝুঁকিও। সার্বিকভাবে বলা যায় শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ও নিরাপত্তা-জনিত সবধরনের শঙ্কা থেকে রেহায় দিতে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়া উচিত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মোট জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জেলে কাটিয়েছেন শুধু জনগণের স্বার্থরক্ষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে। তাই তিনি ( বঙ্গবন্ধু) সবার অন্তরে স্থান পেয়েছেন। নাগরিকের সকল ধরনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টকোণ থেকে যদি ‘বেকারসমস্যা’ ও বেকারদের ‘মরার ওপর খরার ঘা’কে লক্ষ্য করি, তাহলে এভাবে চাকরির নামে ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষার্থীদেরকে অংশগ্রহণ করানোর কোনে মানে হয় না। সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু সূচনা করেছেন, তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে পথভ্রষ্ট কিছু ব্যক্তিদের কারণে হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে তারই যোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেত্বেত্ব দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে চলেছে। এ দুর্বার যাত্রাটিকে আরও বেগবান ও কার্যকরী করতে বেকারসমস্যা দ্রুত নিরসন করাও বেশ জরুরি।তাছাড়া বেকারনিরসনের জন্য যে নিয়োগ-পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা যেনো বিভাগীয় পর্যায়ে চালু করা হয়; সেটি আরো বেশি জরুরি। সর্বোপরি শারীরিক,আর্থিক, মানসিক নিরাপত্তাজনিত দুর্গতি থেকে মুক্তি এবং বেকারত্বের জীবনাবসানে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ হস্তক্ষেপ সাধারণের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা রাষ্ট্র সকলের অভিভাবক। অভিভাবক যদি ন্যায়নীতির বলয় থেকে ছিটকে পড়েন; জাতি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একজন বেকারের পক্ষে নিয়মিত ঢাকায় যাওয়া-আসা, নিজের খরচ, চিকিৎসা, পড়াশোনাসহ অারও অনেক কাজ একত্রে চালিয়ে যাওয়া কঠিন থেকেও কঠিনতর একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়। বিভাগীয় শহরে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা গেলে সব ধরনের শঙ্কা থেকে মুক্তি মিলবে বলে বিশ্বাস। আশাকরি, সরকার তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।
লেখক: মুহম্মদ রুহুল আমিন
প্রভাষক ও প্রাবন্ধিক