বিজয়ের কাঙ্খিত সুফল আর কত দূর?
মোহাম্মাদ আলী হোছাইন: ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস কিন্ত আমরা কি বিজয়ের কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছি? ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি রাজাকারের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। একটি একটি বছর করে পার হয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ টি বছর। প্রশ্ন জাগে মনে কবে পাব বিজয়ের কাঙ্খিত সুফল?
বাঙালির ইতিহাসে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এক বিস্ময়কর ঘটনা। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বাঙালিরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। হাজার বছরের ইতিহাসে আনন্দঘন এই বিজয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সারাদেশে। কিন্তু এই আনন্দ-উল্লাস ছিল ক্ষণস্থায়ী। এই আনন্দ আর উল্লাসের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে গভীর বেদনা আর শোক। যেসব নিরস্ত্র মানুষ খুন হয়েছে এই যুদ্ধে, যারা মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে- তাদের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বাধীনতা এলেও হাজার পরিবারে ফিরে আসেনি তাদের সোনার ছেলেরা। এরচেয়েও বড় বেদনা অপেক্ষা করছিল বাঙালিদের জন্য। বিজয়ের একদিন পরেই খবর এল, দেশবাসী জানতে পারল, ডিসেম্বরের শুরু থেকে বিজয়ের আগ পর্যন্ত এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে দেশে।
কারফিউ চলাকালীন ঘরে ঘরে গিয়ে পাকিস্তানি ও তাদের বাঙালি দোসররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তুলে নিয়ে গেছে। হত্যা করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সারাদেশে একই সময় একই ঘটনা ঘটল। তার শ্রেষ্ঠতম সাক্ষী রায়েরবাজারের জলাভূমি আর চট্টগ্রামের ফয়স লেকের বনাঞ্চল। কিছু কিছু বাঙালি, যারা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায়নি, একাত্তরে তারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে পরিচিত ছিল। তারা ছিল পাকিস্তামের দোসর। ধর্মের দোহাই দিয়ে, ইসলামের নামে তারা পাকিস্তানের দালালি করেছে। জবাই করেছে নিষ্পাপ শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের। পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারল তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, বাঙালির বিজয়কে ঠেকানো যাবে না, তখন তারা নতুন এক নীলনকশা তৈরি করল। যাদের মেধা ও মনন দিয়ে দেশ চলবে, তাদের একে একে শেষ করে দিতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে এই মেধাবী মানুষগুলোকে? এদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হল রাজাকার আলবদর-আলশামসদের হাতে। শুধু খোঁজা নয়, হত্যারও ভার দেওয়া হল। আলবদরের শিকার হয়েছিলেন কারা? তারা কেউ শিল্পী, কেউ কবি, কেউ নাট্যকার, কেউ অধ্যাপক, কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ রাজনীতিক, কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী– এমনি তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট। সমাজের গর্ব, দেশের গৌরব।
তাদের মধ্যে আছেন– মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, সেলিনা পারভীন, সৈয়দ নাজমুল হক, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জিসি দেব, মুহম্মদ আখতার, এম এ মান্নার(লাড়ু ভাই), আবদুল আলীম চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, গিয়াসউদ্দীন আহমদ, গোলাম রহমান, আবুল খায়ের, ফজলে রাব্বী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্যারিমোহন আদিত্য, ফয়জুর রব, নূতনচন্দ্র সিংহ, শহীদ সাবের, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কামিনীকুমার ঘোষ, ফয়জুল মহী, আনম গোলাম মোস্তফা, মহসিন আলী, শফিকুল আনোয়ার, রাশিদুল হাসানসহ আরও অনেকেই।
সেই যে তাদের নিয়ে যাওয়া হল, তারা একেবারে হারিয়ে গেলেন। কেউ আর ফিরে এলেন না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেল। এমন খবরও এল, এমন জায়গাও পাওয়া গেল, যেখানে তাদের খুন করে লাশ পুতে রাখা হয়েছে। এই হত্যা সবচেয়ে বেশি হয়েছে ১৪ ডিসেম্বরে।
সেই জন্যই এ দিনটিকে আমরা স্মরণ করে আসছি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে। তাই প্রতিবছর বিজয় দিবস আসার ২ দিন আগে আমরা এই মহান দিনটিকে পালন করি। স্মরণ করি। বেদনায় আর শোকে ছেয়ে যায় আমাদের মন। সেই স্বাধনিতাদ্রোহী রাজাকার-আলবদর-আলশামসরা অনেকে এখনও বেচেবর্তে আছে। তারা যে খুনি, তারা যে এই দেশটাকে পঙ্গু করার জন্য নেমেছিল একাত্তরে, তা আমরা যেন ভুলে গেছি। ফলে আরও বড় দুর্যোগ নেমে এল দেশে। স্বাধীনতার পরেও গোপনে এরা হত্যা করতে লাগল বাঙালিদের। যার অন্যতম শিকার জহির রায়হান। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে। গা ঢাকা দেওয়া শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতায় খুশি হতে পারেনি। তারাই যে এই অপকর্ম করেছে তাতে ভুল কী? এতেও ক্ষান্ত হয়নি তারা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এসব নিগৃহীত রাজাকার-আলবদরেরা নেমে পড়ল চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, ছিনতাই ইত্যাদিতে। দেশে বিশৃংখলার সৃষ্টি করল এরা। সমস্ত অপকর্ম করে তারা দোষ চাপিয়ে দিতে থাকল সাধারণ মানুষের উপর। দোষ চাপিয়ে দিতে থাকল মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। ডাকাতি করার জন্য, খুন করার জন্য, রাহাজানি করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র পাবে কোথায়? মুক্তিযোদ্ধারা তো অস্ত্র জমা দিয়েছিল সরকারের কাছে। কিন্তু রাজাকার-আলবদর-আলশামস– যারা প্রাণের ভয়ে আত্মগোপন করেছিল, তারা তো অস্ত্র জমা দেয়নি। সমাজ তাদের গ্রহণ করবে না বলে তারা এসব অপকর্মে নেমে পড়েছিল। অরাজকতা সৃষ্টি করল দেশে।
গত ছয়চল্লিশ বছর ধরে এসব রাজাকার ও আলবদরদের বিনাশ করা যায়নি বলে এখনও তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে, বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। অনেকেই সমাজের উঁচু স্থানে বসে স্বপ্ন দেখছে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার। বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে দেশপ্রেমিকদের। ধর্মের কথা বলে নিরীহ এবং সরল প্রকৃতির মানুষ আর ছাত্রদের দলে ভিড়িয়ে এখন তারা গ্রামে গ্রামে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মেতে উঠেছে হত্যালীলায়। যা দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জন্য লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময় থাকতে এদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে, প্রতিরোধ না করলে বিপন্ন হবে দেশের স্বাধীনতা, পাওয়া হবেনা বিজয়ের কাঙ্খিত সুফল।
আরও পড়ুন :