[ গত পর্বের পর…
তিন.
“ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে”, বললাম, “কররানী সুলতানদের পতনের পর চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায়। পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে মূলত এই সময়টাতে। আব্দুল করিম স্যার তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম নোঙ্গর করে ১৫১৮ সালে। শেরশাহের বাংলা দখলের পর তাদের আধিপত্য বেশ বিঘ্নিত হলেও পরবর্তীতে আরকান রাজার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তারা বেশ জাঁকজমকের সাথেই চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন এবং লুটতরাজ করে।
সায় দিয়ে সেঝ ভাই বললেন, “এই অঞ্চলে পর্তুগীজদের দস্যুপনার একটা গল্প পড়েছিলাম। নদীপথ ধরে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ধনসম্পদ লুট করত, এমনকি সুন্দরী নারীদেরও নাকি ধরে নিয়ে যেত। এসব অন্যায় অবিচারের ফলেই তারা মুঘল সম্রাটের ক্রোধের শিকার হয় এবং বিতাড়িত হয়।
“ফাদার সেবাস্তিয়ান ম্যানরিকের নাম শুনেছেন?”, জিজ্ঞেস করলাম।
ছোটভাই- “পর্তুগীজ ধর্মযাজক? নাম তো তাই বলে।”
“এক্স্যাক্টলি। ভদ্রলোক খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। ওনার আলোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলে নেই। ১৪৫৩ সালে ওসমানী তুর্কীদের দ্বারা কনস্টানটিনোপল বিজিত হওয়ার পর প্রাচ্য জগতের সাথে য়ুরোপের ব্যবসায়িক সম্পর্ক একেবারেই ভেঙ্গে যায়। বেঁচে থাকার জন্যেই তারা ব্যবসার নতুন দিগন্ত খুঁজতে বাধ্য হয়। কনস্টানটিনোপলের পতন শীঘ্রই য়ুরোপের জন্যে এক ধরনের আশীর্বাদ রূপে প্রতিভাত হয়। ইয়ুরোপীয় নাবিকেরা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েন। ভৌগোলিক আবিষ্কারের (Geographical discovery) হাত ধরে ইয়ুরোপে শুরু হয় ঔপনিবেশিক যুগ (Colonial era)। নতুন কোন জায়গায় উপনিবেশ গড়ার জন্যে তাদের বিশেষ কিছু টেকনিক ছিল। ব্যবসা বা ধর্মপ্রচারের মত নিরীহ ও আকর্ষণীয় কাজের মাধ্যমে তারা প্রথমে বসতি স্থাপন করত। ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী হলে তারা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা, আলভারেজ ক্যাব্রাল প্রমুখেরা ভারতে এসে ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা করেছিলেন একই উপায়ে। ইতিহাস বলে যে, কালিকট অঞ্চলে পর্তুগীজেরা প্রথমে থাকার ও ব্যবসা করার অনুমতি নেয়। পরে তারা নিজেরাই স্থানীয় লোকদেরকে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় এবং দাঙ্গা সৃষ্টি করে। সেই দাঙ্গাকে উসিলা করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বিশাল নৌ-বহর নিয়ে হাজির হয় এবং শেকড় গেড়ে বসে।”
“অন্যদিকে ইয়ুরোপে”, বলে চললাম, “মার্টিন লুথার তৎকালীন চার্চের মারাত্মক কিছু অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করে ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। তার সংস্কার আন্দোলনে সারা য়ুরোপ জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। ক্যাথলিক চার্চের বিকল্প হিসেবে প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্পেন, পর্তুগাল এবং ফ্রান্সে ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্য বজায় থাকলেও অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ক্যাথলিক নেতৃবৃন্দ তাদের সংখ্যাধিক্য বজায় রাখার জন্যে সারা বিশ্বব্যাপী নতুন কলোনিগুলোতে তাদের ধর্ম প্রচারে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। ব্যাবসায়িক বা সামরিক বাহিনীর সাথে তাই সর্বদা কিছু ধর্মীয় যাজক থাকতেন। এমনই একজন যাজক ছিলেন ফাদার সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক।”
থামলাম। আর পারছিলাম না। একে ঝাঁঝালো রোদ, তার উপর প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। পানি নিয়ে আসা উচিৎ ছিল, বেশ বুঝতে পারছিলাম। আশে পাশে গাছ-গাছালিও নেই যে ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেব। আরো ঘন্টা-আধেক হাঁটতে হবে গন্তব্যের পৌছুতে।
চার.
সেঝভাই- “তারপর?”
বললাম, “ওনার লেখা “ট্রাভেলস অফ ফ্রে সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক ১৬২৯-১৬৪৩” বইটা চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগীজদের কর্মকান্ডের সবচে’ শক্তিশালী দলীল। ১৬২৯ সালে তিনি হুগলি থেকে চট্টগ্রাম আসেন। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে দেয়াঙ অঞ্চলে তাদের বানিজ্য কুঠি এবং একটি গীর্জা ছিল। এখানেই ছিল তাদের কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্রস্থল। আরাকান রাজ্যসভায় একদা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হলে রাজা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেন। পর্তুগীজদের নির্দোষ প্রমাণ করে তাদের পক্ষে ওকালতি করার জন্যেই তিঁনি প্রথম আরাকান ভ্রমণ করেন। সমুদ্রপথ বিপদসঙ্কুল হওয়ায় তিনি যতদুর সম্ভব, ওনার বর্ণনামতে রামু পর্যন্ত, নদীপথে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই নদীটাই ছিল আমাদের জলকদর খাল। জলকদরের নামকরণের ইতিহাস জানেন?”
সেঝভাই বললেন, “মোঘল ফৌজদার জুলকদর খানের নামানুসারে হয়েছে নিশ্চয়ই। ১৭৩০’র দশকে মোঘল পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি খালটি সংস্কার করেছিলেন। শুনেছি আগেকার যুগে নাকি এই খাল, যেটাকে তোর যাজক মশায় নদী আখ্যা দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখত।”
“যাই হোক, আরাকান রাজসভায় গিয়ে তিনি সফলতার সঙ্গে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করেন। সাথে ‘পর্তুগীজ পাদ্রীদের ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তকরণের অনুমতি’ সংক্রান্ত একটা ফরমান পাশ করিয়ে নিয়ে আসেন। আংগরখালীতে (প্রথম পর্বে এই স্থানের বিস্তারিত পরিচয় দেয়া আছে) পর্তুগীজদের বসতি ছিল আগে থেকেই। প্রায় শতাধিক বছর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত পর্তুগীজ জেলেদের অনেকেই এ এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। আবার পর্তুগীজ জলদস্যুরাও বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে লোকজন ধরে এনে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত। ফাদার ম্যানরিক যখন ফরমান নিয়ে আসেন, সে সময়ে অংগারখালীতে বসবাসরত খ্রীষ্টানরা ছিল গরীব। এরা স্থানীয় অখ্রীষ্টান (জেলে সম্প্রদায়ের হিন্দু বা মুসলিম) মেয়ে বিয়ে করে তাদের সঙ্গে বসবাস করত। স্থানীয় প্রধানদের অধীনে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করত তারা। গীর্জা থাকলেও অবস্থার শিকার হয়ে তারা গীর্জা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের স্ত্রীরা খ্রীষ্টান না হওয়ায় পরিবারের অসম্মতিতে তারা গীর্জায় বসবাস করতে পারত না। কালচারাল এসিমিলেশনের হাত ধরে ধীরে ধীরে এনিহিলেশন (Annihilation through cultural assimilation)। কতকটা স্পেনের মরিস্কোদের মত, তাই না?” থামলাম।
ছোটভাই সোৎসাহে প্রতিবাদ করলেন, “বলিস কী! কোথায় মরিস্কো আর কোথায় এরা! মরিস্কোদের তো বিতাড়িত করা হয়েছে। নাম-পরিচয় পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, অচ্ছুৎ করা হয়েছে। আর এরা তো নিছক পরিস্থিতির শিকার। খাবার কিছু নেই দেখে একজনের ঘরে ঢুকে পড়েছে, ধীরে ধীরে এই ঘরের সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এখানে তো তাদেরকে কেউ কোন কিছুতে বাধ্য করে নি! Were they forced?”
“Culture forced them, not the people, I guess”- সেঝভাই জবাব দিলেন।
আমি কাহিনীতে ফিরে গেলাম। বললাম-
“ফাদার আরাকান থেকে ফরমান নিয়ে এসে আংগরখালীর খ্রীষ্টানদের একত্রিত করার কাজে হাত দেন। তিনি তাদের গীর্জায় বসবাসের প্রস্তাব দিলে জবাবে তারা অক্ষমতা প্রকাশ করে। তারা তাদের সমস্যার কথা জানায়; তাদের স্ত্রী-রা মেনে নিবে না, স্ত্রী-দের ছেড়ে দিলে জীবিকা নির্বাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ইত্যাদি। ফাদার তাদের আশ্বাস দেন যে, গীর্জায় পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার মত ঘর তৈরির ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে দিবেন, এবং ন্যুনতম এক মাস তাদের খাওয়া পরার দায়িত্ব নিবেন। তিনি সুস্পষ্ট নির্দেশন প্রদান করেন যে, হয় তাদের স্ত্রী-রা খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে গীর্জায় এসে তাদের সাথে থাকবে, নতুবা তারা তাদের স্ত্রী-দের ত্যাগ করবে। সবাই ফাদারের কথা মেনে নেয়। ফাদার ম্যানরিক অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব কিছু সরবরাহ করেন। আংগরখালী চার্চ পুনরায় সরগরম হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন খ্রীষ্টানদের পুনরায় খ্রীষ্টান পরিচয়ে একত্রিত করা হয়, আর স্থানীয়দের নতুনভাবে দীক্ষিত করা হয় খ্রীষ্ট ধর্মে।”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম অবশেষে! উফ, গরম একেবারেই অসহ্য! এক দোকান থেকে পানিতে চুবিয়ে রাখা (ফ্রিজের বিকল্প হিসেবে) তিনটা কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে আসলেন ছোটভাইয়া। নয়নাভিরাম দৃশ্য সামনে। ইট বাঁধাই করা সংকীর্ন রাস্তাটা হঠাৎ করেই যেন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে! ভাঙ্গনের কুফল। পর্যাপ্ত পানি এবং কিছু খাবার জিনিসপত্র নিয়ে, সমুদ্রের তীর ঘেষে দোকানপাট থেকে একটু দক্ষিণে গিয়েই বসে পড়ালাম। আমাদের সামনে, মানে পশ্চিমে এখন বঙ্গোপসাগর, আর সোজা উত্তরে বঙ্গোপসাগরের সাথে সাঙ্গুর মোহনা। আমার চোখে ভাসতে থাকে বাঁশখালীর পশ্চিমে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা বাঁধ, সরলরেখার মত, অথবা ধনুকের মত বাঁকানো! সম্মুখে নয়নাভিরাম বেলাভূমি, অসীম সমুদ্দুর…[চলবে]।
[চলবে]।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, এম. এ. বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।