‘বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত’ পর্ব-০১ || ইনতিজামুল ইসলাম

[পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বাঁশখালী উপজেলা। ধারাবাহিক এ সিরিজে বাঁশখালীর সমুদ্র সৈকত নিয়ে লিখছি। চরিত্রগুলো কাল্পনিক, ঘটনা এবং বর্ণনাগুলো বাস্তব]

এক.

আমাদের টার্গেট সমুদ্র-সৈকত। বাঁশখালীর সমুদ্র সৈকত। এখনো জন-পরিচিত কোন নাম দেয়া হয় নি। “বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত” নামটাই যথার্থ মনে হয়। বাংলাদেশ-বার্মার সীমান্তবর্তী মদক অঞ্চলের পাহাড় থেকে উৎপন্ন সাঙ্গু নদী বান্দরবানের থানচি, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর ও সাতকানিয়া হয়ে বাশঁখালী থানার উত্তরাংশকে আনোয়ারা থানা থেকে পৃথক করে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গেছে। এই সাঙ্গুর দক্ষিণ কূল থেকে শুরু করে পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের এই সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলকে আমরা আমাদের প্রস্তাবনায় “বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত” বলে থাকি।

আবহাওয়া অনেক সুন্দর ছিল। ভোর ৭টায় বেরিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো পয়েন্ট আছে সৈকতের। রাস্তাও ভিন্ন ভিন্ন। সাঙ্গু নদীর বাশঁখালীস্থ তীর ঘেঁষে যে রাস্তাটি ঠিক সরলরেখার মত বঙ্গোপসাগরকে ছেদ করেছে, সেটাই আমাদের রুট। তিন থেকে চার কিলোমিটারের এই রাস্তায় হাটতে হবে প্রায় দেড় ঘন্টা। আমাদের ডানপাশে সাঙ্গু, তারপরে আনোয়ারা থানা। আর বামে জনবসতি। এই ভ্রমণকে নিছক ভ্রমণ বললে ভুল হবে। “চক্ষু মেলিয়া ঘরের পাশের ঘাসের ডগার উপর একটি শিশির বিন্দু দেখা” বলা যায়। অবাক কান্ড, মহেষখালী পয়েন্ট থেকে কক্সবাজারের মূল এলাকা(যেখানে মূলত পর্যটকেরা ভীড় জমায়) পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে সমুদ্র সৈকত, সেই একই লাইনে আমাদের এই সৈকতের অবস্থান হওয়ার পরও আমরা তা জানতামই না!

ভাইদের মধ্যে আমি একটু বাচাল টাইপের। আমি দু’জনের মাঝখানে হাটছিলাম। ডানে ছোট ভাই আর বামে সেঝ ভাই। বললাম-

‘কি মনে করেন? পর্যটন উপজেলা হওয়ার যোগ্যতা আছে বাঁশখালীর?’

সেঝভাই- তোর কি মনে হয়?

(ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে) আপনি বলেন।

ছোটভাই- তুই বল শুনি…

: সম্ভব। ইনফ্যাক্ট, খুব ভালভাবে সম্ভব। তবে তার আগে অনেক কাজ করতে হবে। উত্তর-দক্ষিণে বাঁশখালীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। আমাদের পশ্চিমে সমুদ্র একেবারে অগভীর। বাঁধ হয়ে গেলে পলিমাটি জমে অল্প সময়ের মধ্যেই এই বাঁধের পশ্চিমে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিস্তৃত এক সৈকতের উদয় হবে, যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম! তার উপর আছে ইকো পার্ক আর চা-বাগান! পুর্বপাশে আছে বিস্তৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সরকার চাইলে বড় প্রকল্প হাতে নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে ওই সংরক্ষিত এলাকায়। পশু-পাখিদের ঘোষিত অভয়ারণ্য জাতীয় কিছু। আমাদের ইকো-পার্কের ঝুলন্ত সেতুটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম হিসেবে সংসদের প্রস্তাবনায় বা পত্র-পত্রিকায় আলোচিত হয়নি বলেই এখনো পর্যন্ত রাঙামাটির সেতুটিকে দীর্ঘতম বলে ধরে নেয়া হয়। চা-বাগানের ক্ষেত্রেও একই কথা। আয়তনে একক ক্লোন টি-স্টেট হিসেবে আমাদেরটাই তো বৃহত্তম। জলকদরকেও প্রসেসিং করা যায়। এটা নিয়ে আমার একটা প্ল্যানও ছিল…

– ‘কি প্ল্যান?’
‘ছোট ভাইয়া, মনে আছে একবার বলেছিলেন যে ইকো পার্কের লেকে পানসি বা ছোট ছোট স্পীড বোটগুলো আবার চালু করা উচিৎ?’

‘হুম…’

‘জলকদরকে হালকা সম্প্রসারিত করে এখানেও আপনার ওই সার্ভিস চালু করা যায় না? অথবা পরিসরটা আরো বড় করে ইশ্বরবাবুর হাট থেকে, প্রেমাশিয়া থেকে, গন্ডামারা থেকে বা যে কোন একটা পয়েন্ট থেকে শুরু করে, জলকদর-সাঙ্গু-বঙ্গোপসাগরকে রুট হিসেবে নিয়ে জলকদরের পশ্চিমাঞ্চলটা চক্কর দিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরুর পয়েন্টে ফিরে আসা; কেমন হবে?’

‘প্ল্যান হিসেবে দারুণ। কিন্তু এখন কি সম্ভব বলে মনে করিস!?’, সেঝ ভাই বললেন।

ছোটভাই- ‘ঠিকই আছে। পর্যটন উপজেলা ঘোষিত হলে অবশ্যই সম্ভব। আমার কথা হল, সরকার যদি বাঁশখালীতে পর্যটনের নিমিত্তে ইনভেস্ট করে, কয়েকগুন বেশি করে ফিরে পাবে- চোখ বন্ধ করে বলা যায়। কর্ণফুলির ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত যে টানেল বাঁশখালীর মুখে এসে উঠবে, সেটা যদি বাস্তবে হয়, তাহলে বাঁশখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে আর কোন চিন্তা থাকবে না। কক্সবাজার রুটের রাস্তা বলেই এটা আলাদা গুরুত্ব পাবে…’

বললাম, ‘সম্ভাবনা অনেক আছে। এখন এগুলো নিয়ে প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেই হয়…’

সুর্য দিগন্ত থেকে একহাত মত উপরে উঠেছে। এলাকার এক ছোটভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আসা ক্যামেরা ছিল। ছোট ভাইয়া ফটোগ্রাফে ওস্তাদ। শুধু ফটোগ্রাফেই নয় আসলে, মাল্টি-ট্যালেন্টেড…
— — —

দুই.
‘মজার একটা কাহিনী শুনাই, কী বলেন’ -বললাম।

সাঙ্গুর তীর বেয়ে হাটছি আমরা বঙ্গোপসাগরের দিকে। সাঙ্গুর স্রোতে প্রতিফলিত সুয্যিমামার মনোরম দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে করতে ছোটভাইয়া বললেন,

‘কি কাহিনী?’

বললাম, ‘যেখানে যাচ্ছি সেখানকার কাহিনী। কল্পকাহিনী নয় ঠিক, ইতিহাস। চন্দইন্যা হাট, অংগারকেল, বালুখালি- নামগুলো শুনেছেন?’

সেঝভাই- অংগারখালী শুনেছি। একটা খালের নাম।

ছোট ভাই- কোথায় যেন পড়েছিলাম এটা একটা প্রাচীন শহর। এখন হারিয়ে গেছে। প্রত্নতাত্বিক কোন শহর হতে পারে।

বললাম- ঠিক বলেছেন, একটা খালের নাম। আবার এই নামে একটা প্রাচীন লোকালয়ও ছিল। যাইহোক, আরেকটা প্রশ্ন করি। দ্বীপ কীভাবে গঠিত হয় জানেন কেউ?

ছোটভাই- কোরাল আইল্যান্ড সম্পর্কে তো জানি। আরো থাকতে পারে। বিস্তারিত জানা নেই। হঠাৎ আবার এই প্রসঙ্গ কেন? কি যেন ইতিহাস বলবি বলছিলি?

আমি- বলছি বলছি। একটু গুছিয়ে নিচ্ছি। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম এই ব্যাপারটা নিয়ে। আচ্ছা, আমাদের খানখানাবাদের পশ্চিমে যে একটা দ্বীপের মত দেখা যায়, ওটা সম্পর্কে জানেন কিছু? হঠাৎ সমুদ্রের মাঝখানে ওভাবে জেগে ওঠার মানে কি?

ছোটভাই- ভাবিনাই ওভাবে। জানা উচিৎ। ইন্টারেস্টিং।

আমি- দ্বীপের ফরমেশন নিয়ে বলছিলাম না? আমাদের পশ্চিমের ওই দ্বীপটা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই এ ব্যাপারে হালকা পড়াশুনা করেছিলাম। বেশ কয়েকটা উপায়ে দ্বীপ জেগে উঠতে পারে সমুদ্রের বুকে। কন্টিনেন্টাল, টাইডাল, ব্যারিয়ার, ওশানিক, কোরাল এবং আর্টিফিশিয়াল- এই ছ’টি উপায়ে দ্বীপ গঠিত হয়। কন্টিনেন্টালের ধারনাটা হল- একদা পৃথিবী সংযুক্ত একটা ভূখণ্ড ছিল। অতঃপর ভুগর্ভের ক্রমাগত কম্পনের ফলে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এর মধ্যে আকারে ছোট কিছু ভূখণ্ডকে দ্বীপ বলা হয়। টাইডাল হল জোয়ার ভাটা কেন্দ্রীক, এবং ওশানিক হল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জেগে ওঠা দ্বীপ।

সেঝভাইঃ এক মিনিট এক মিনিট! সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে দ্বীপ গঠিত হবে কেমনে!

আমিঃ আসলে দ্বীপ গঠিত হয় না এক্ষেত্রে, বরং দ্বীপ আকারে দৃশ্যমান হয়। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে অনেক নিচু ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত উচু হয়ে থাকা যেসব ভূমি পানিতে বিলীন হয়ে যায় না, সেগুলোই মূলত ওশানিক আইল্যান্ড। যাই হোক, কোরাল আর আর্টিফিসিয়াল সম্পর্কে তো জানেনই। আমাদের মূল কনসার্ন ব্যারিয়ার আইল্যান্ড নিয়ে। সমুদ্রতীরবর্তী ভূখণ্ড বরাবর সামনে সমুদ্রের তলদেশে কোন কারণে অপেক্ষাকৃত উচু জায়গা গঠিত হলে, শত-সহস্র বছরের ক্রমাগত ঢেউ সেখানে পলিমাটি জমা করতে থাকে। অবস্থানে অপেক্ষাকৃত উচু হওয়ায় ওই জায়গায় এসে সামুদ্রিক বালি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং বাসা বাধতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে নতুন নতুন দ্বীপ। প্রবাল দ্বীপগুলোও ব্রড সেন্সে ব্যারিয়ারের ক্যাটাগরিতে পড়ে।

সেঝ ভাইঃ বেশ মজার তো! আচ্ছা এবার বল এটার সাথে আমাদের গন্তব্যের কি সম্পর্ক? বলেছিলি আমাদের সৈকত সম্পর্কে কোন কাহিনী বলবি।

আমিঃ শুরুতে তিনটা নাম বলেছিলাম না? “অংগারকেল, চন্দইন্যা হাট, বালুখালী?” এগুলো হল ঐতিহাসিক কিছু জায়গার নাম- বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কিছু লোকালয়। আব্দুল করিম স্যার তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, অংগারকেল জায়গাটি, স্থানীয়ভাবে যেটি আংগরখালী নামে পরিচিত, খানখানাবাদের পশ্চিমেরই কোন একটা জায়গা হবে, ভাঙ্গনের ফলে যেটা এখন সমুদ্রের নিমজ্জিত হয়ে আছে। এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা পর্তুগিজ ঔপনিবেসিকদের ডায়েরীতে এর সম্পর্কে জানা যায়। আমার কি মনে হয় জানেন, আব্দুল করিম স্যারের হাইপোথিসিসটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের খানখানাবাদের পশ্চিমে জেগে ওঠা ক্রমবর্ধমান দ্বীপটা ওই অংগারকেলের ধ্বংসাবশেষকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠছে।

ছোটভাইঃ দারুণ তো! কোথায় জেনেছিস এগুলো?

আমিঃ আব্দুল করিম স্যারের বইয়ে হালকা বর্ণনা দেয়া আছে। ওনি কিছু সোর্স উল্লেখ করেছেন- সেখান থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। তাছাড়া হালকা পড়াশুনা করেছি সমুদ্রবিজ্ঞান সম্পর্কে। আমাদের এ অঞ্চলে পর্তুগীজদের আগমন এবং বসতি সম্পর্কে জানেন নাকি কেউ? খুব জ্ঞান গবেষণা না হলেও এ ব্যাপারে মজার কিছু তথ্য জানা যায় ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে।

ছোটভাইঃ বল দেখি…

৮টা পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রাস্তার অর্ধেকটাও শেষ হয় নি এখনো। দেড় ঘন্টায় পৌছানোর প্ল্যান থাকলেও টের পেলাম যে পায়ে হেটে আড়াই-তিন ঘন্টার আগে কিছুতেই পৌছানো সম্ভব না। আমাদের এলাকায় শরৎকালের সকাল ৮টা মানে ঝাঁঝালো টাটকা রোদ। কথা বলতে বলতেই দ্রুত পদে হাটা শুরু করলাম…(চলবে)

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী, এম. এ. বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Banshkhali Tea Garden – বাঁশখালী চা বাগান

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *