আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে উত্তর পশ্চিমে প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কোণে তাকালে দেখা যায় নাব্যতার অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকতে না পেরে অপেক্ষাকৃত গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করা অট্টালিকা সদৃশ সুবিশাল জাহাজের বহর। আমাদের সামনেই প্রথম পর্বের হাইপোথেটিকাল সেই দ্বীপটি। মনে হচ্ছে খুবই কাছে; যেন খুব সহজেই সাঁতরে যাওয়া যাবে। ডানে সাঙ্গুর মোহনা; মিয়ানমারের মদক অঞ্চলের পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে উৎপন্ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ নদীটি এখানে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গিয়েছে। নদীর ওপারে আনোয়ারা থানা। আমাদের বাঁয়ে প্রায় ৩২ কিলোমিটার ব্যাপি বাঁশখালীর পশ্চিম সীমানা, যেটি আবার বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশস্থ পূর্ব সীমানাও বটে।
“ইশ! দ্বীপটা যদি কিনে নিতে পারতাম!”
“নে না। সমস্যা কী!”, ছোটভাই।
“ট্যাকা দেন, নিয়ে নিচ্ছি।”
ফটোশুটিং এর সাথে সাথে অগোছালো আলাপ আলোচনা চলতে লাগল। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল, আমাদের যে রাস্তা [বেড়িবাঁধ] বেয়ে খানকানাবাদ সৈকতের দিকে, মানে দক্ষিণ পাশে যেতে হবে, তা বিপজ্জনকভাবে ভাঙা। সমুদ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট বাঁধের পার্শ্বটা নব্বই থেকে স্থানে স্থানে নিরানব্বই শতাংশ পর্যন্ত সমুদ্রে মিশে গেছে। যেটুকু বেঁচে আছে, তাতেই অতি সন্তর্পণে পা পা করে এগিয়ে যেতে হবে।
“বেড়ানোর এত সুন্দর জায়গা, কিন্তু এসে স্বাদটা আর পাওয়া হয় না!”, একটি দীর্ঘশ্বাসের সাথে সেঝ ভাই বললেন।
“ঠিক…”
এই এলাকায় নবাগত কারও এই দীর্ঘশ্বাসের মানে বোঝার কথা না। আমরা বুঝি। বর্ষাকালে [দুই মাস, মাঝে মাঝে যা এখন চার-পাঁচ মাসও ছাড়িয়ে যায়], পূর্ণিমা ও অমাবস্যার চার তিথিতে সমুদ্রে ওভারফ্লো হয় এবং কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়টিতে আমাদের ভঙ্গুর বেড়িবাঁধের ‘কল্যানে’ প্রতি বছরই এই এলাকায় গ্রামের পর গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকে; তাও আবার লোনা পানি! এখানকার অন্তত দশ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি ফি-বছর নবায়ন করতে হয়। অনেক পরিবার ভিন্ন উপায় খুঁজে নিয়েছে ইতোমধ্যে; প্রায় দশ থেকে বারো কিলোমিটার পূর্বে বাঁশখালি-সাতকানিয়ার সীমান্তবর্তী পাহাড়ে অপেক্ষাকৃত কমদামী জমি কিনে, সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেছেন তাঁরা। কিন্তু নতুন একটি স্থানে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকার মত সামর্থ তো সবার নেই; সত্যি বলতে অধিকাংশেরই নেই। স্থানীয় রাজনীতিক এবং প্রশাসকদের উদাসীনতা, নিমকহারামী আর বে-ঈমানির নিত্য খেসারত দিয়ে যায় সংগ্রামী এই মানুষগুলো।
লোনা পানির প্রভাবে উপকূলবর্তী মাইলের পর মাইল ফসলি জমি এখন বিরান হয়ে গেছে। পরিস্থিতির শিকার এই এলাকার হতদরিদ্র মানুষদের নিয়ে সেঝ ভাইয়ের খুব চমৎকার একটা আইডিয়া ছিল এক সময়; উপকারি ব্যবসা। মহিলাদের হালকা ট্রেনিং দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হবে। তারপর চুক্তির ভিত্তিতে স্থানীয় একটা পোশাক শিল্পের মত গড়ে তোলা হবে। [ফর এক্স্যাম্পল] এক মাস সময়, দশটা কাপড় সেলাই করে দিতে হবে, তার পাওনা তাকে মিটিয়ে দেয়া হবে। এর বাইরে সে তার মত করে কাজ করবে। এভাবে যদি একশ’ জনকে মেশিন কিনে দেয়া হয়, তাহলে মাসে কাপড় হয় এক হাজার পিস। এক হাজার জনকে দেয়া হলে মাসে দশ হাজার পিস কাপড়। আরো বেশী হলে…?
বিভিন্ন পোজে দাঁড়িয়ে-শুয়ে-বসে বেশ কিছু ছবি নিলাম আমরা। সময় নেই হাতে। আমাদের প্ল্যান হল খানখানাবাদ পয়েন্ট হয়ে বাড়ি ফেরা। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, প্রেমাশিয়া পয়েন্ট, সেটা ৩২ কিলোমিটার প্রস্তাবিত বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতের সর্ব-উত্তরের পয়েন্ট। পরবর্তী পয়েন্টের নাম ‘খানখানাবাদ’, এখান থেকে প্রায় আড়াই হতে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে। এটুকু রাস্তা একেবারে সমুদ্রের পাড় ঘেষে যেতে হবে; ভাঙা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়া বাঁধ বেয়ে পায়ে হেটে। দুর্গম। হাঁটা শুরু করলাম অতি সন্তর্পণে। বাঁধটা বহাল তবিয়তে থাকলে কতই না আনন্দদায়ক, রোমান্টিক হত এই যাত্রা! দীর্ঘশ্বাস…
“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন আপনারা? প্রেমাশিয়া আর খানখানাবাদকে আমরা আলাদা আলাদা পয়েন্ট বলি কেন?”, আলাপ শুরু করলাম।
ছোটভাই আমার ইঙ্গিত বুঝে নিলেন।
“ঠিক বলেছিস। খানখানাবাদ থেকে প্রেমাশিয়া পর্যন্ত বাঁধটা একেবারে সরলরেখার মত। [প্রথম পর্বে উল্লেখিত] বাঁধটা যদি স্থায়ীভাবে থাকত, আই মীন বারবার ভেঙে গিয়ে যদি ইন্টেরাপ্টেড না হত, এতদিনে এই দুই পয়েন্ট মিলে একেবারে একক বেলাভূমি আকারে দেখা দিত। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ, নাকি?”
সেঝভাই, “কদমরসুল পয়েন্টও তো একই সুত্রে যোগ করা যায়।”
ছোটভাই, “অবশ্যয়ই!”
“আচ্ছা আমাদের এখানে মহীসোপানের বিস্তৃতি কেমন জানেন?”
“একশ’ থেকে একশ’ বিশ মিটার তো হবেই”, ছোটভাই বললেন। সেঝ ভাই সায় দিলেন।
আমার মনে নেই। মহীসোপানের সীমানা পর্যন্ত গিয়েছিলাম একবার; তখন অবশ্য এ টার্মটার সাথে পরিচিত ছিলাম না। চৌদ্দ কি পনের বছর বয়সে। ভাটা ছিল। কোমর পানিতে সবার সাথে মজা করতে করতে খেলছিলাম। ভাটায় পানি আরো কমে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এক পর্যায়ে দেখলাম বেলাভূমি আর সমান নেই। একেবারে প্রায় নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। নায়াগ্রা প্রপাতে যেভাবে পানি পড়ে, একেবারে একই স্টাইলে বেলাভূমি থেকে নিচের দিকে পড়ছিল পানি। সমুদ্রের পাড় থেকে শুরু করে ভেতরের দিকে যেটুকু জায়গা অতি অল্প পরিমাণে, সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঢালু থাকে, সেটাই মহীসোপান। সার্বিকভাবে ধরলে এই মহীসোপানের গড় গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত হয়। কিন্তু আমাদের এখানকার গভীরতা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে দশ মিটার। আমাদের এটা কার্যত মহীসোপান না হলেও, মহীসোপানের মডেলে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় বৈ কি!
যাই হোক, একশ’ থেকে একশ’ বিশ মিটার মহীসোপান মানে বিশাল কিছু। একশ’ বিশ মিটার প্রশস্থ বেলাভূমি থাকলে একটি সৈকতের জন্যে আর কী লাগে! তার উপর আছে সযত্নে লাগানো সারি সারি ঝাউ গাছ। ইশ! বেড়িবাঁধের একটা স্থায়ী সুরাহা যদি হয়েই যেত! রাস্তাঘাটগুলো যদি যথোপযুক্ত হত! দীর্ঘশ্বাস…
খানখানাবাদ পয়েন্ট দেখা যাচ্ছে। সারি সারি ঝাউ গাছের বাগান। তীরে বেশ কিছু জেলেদের নৌকোয় মেরামতের কাজ চলছে। বাতাসের সাথে ঝাঊ পাতার ঘর্ষণে সৃষ্ট হু হু তান ভেসে আসছে অনবরত। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম তিন ভাই। হাঁটাচলা করার আর শক্তি নেই। গল্প গুজব করলাম অনেক বসে বসে। পানি-টানি খাইলাম, ছবি-টবি তুললাম, আর শেষমেশ, বেশ বড় তিনটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম আর কি…।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, এম. এ. বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।