বাঁশখালী শব্দটা শুনলেই আমার মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে। ঠিক যেমন প্রবাসে থেকে নিজের দেশের নাম দেখলে বা শুনলে প্রবাসীর হৃদয় আন্দোলিত হয় তেমনই।

আমার জন্ম চট্টগ্রাম শহরের চাকতাই এ। শৈশবের (স্পষ্ট-অস্পষ্ট যা কিছু মনে আছে) একদম শুরুটা ছিল পূর্ব বাকলিয়াতে। বেড়ে উঠা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, বিয়ে, সবকিছুই পূর্ব বাকলিয়ার হাট খোলা থেকেই। বছরে একবার দুবার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী যাওয়া হতো। কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসতাম শহুরে জীবনে।
বাবা-মা দুজনের বাড়িই বাঁশখালী হওয়াতে খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের মুখে গ্রামের অনেক গল্প শুনেছি। গ্রামে গেলে চাচাতো, ফুফাতো ভাইবোনদের সাথে পাহাড় চষে বেড়িয়েছি। নানুর বাড়ির কাছেই শঙ্খ নদী। নদীর সাথে সখ্যতাও তাই খুব ছোটবেলা থেকে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য খুব কাছ থেকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। গ্রামের মানুষদের সরলতা, অতিথীপরায়ন, আন্তরিক ব্যবহার এসব দেখে অবাক হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। আর একারণেই বাঁশখালী ভালো লাগার অন্য নাম।
কিন্তু এত ভালো লাগা স্বত্ত্বেও মুখ ফুটে প্রকাশের সুযোগ পেতাম না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো, ‘বাড়ি কোথায়?’ আমি চুপ করে থাকতাম, নাহয় মিনমিন করে বলতাম ‘বাঁশখালী’। তখনই শুরু হয়ে যেত ঠাট্টা, তামাশা, বিদ্রুপ। ‘ও বাঁশখাইল্যা!’ বেশি যেটা শুনতে হতো সেটা হলো বাঁশখালীর মানুষকে নিয়ে। যে মানুষগুলোকে আমার সহজ সরল মনে হতো তাদের নিয়ে কটুক্তি সহ্য করা ভীষণ কষ্টের ছিল।
তখন থেকেই মনে মনে প্রার্থনা করতাম, ‘বাঁশখালী নিয়ে যেন একদিন গর্ব করতে পারি।’ হ্যাঁ, আমার একান্ত চাওয়া বাঁশখালী নিয়ে সবার চিন্তাধারা বদলে যাক। চার অক্ষরের এই নামটা উচ্চারণের সময় যেন গর্বে সকলের বুক চওড়া হয়। অন্য এলাকার, অন্য গ্রামের, তথা সারা দেশের মানুষ বাঁশখালীকে শিক্ষায়, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, পর্যটন শিল্পে উন্নত একটা গ্রাম হিসেবে চিনবে।
এসব অবশ্য অনেক আগের কথা। এখন আমি নিজেকে বাঁশখালীর মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। কারণ আমি জানি, বহু কৃতি সন্তানের জন্ম হয়েছে বাঁশখালীতে। দেশে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন তাঁরা। তাঁদের গল্প শোনাই অন্যদের।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাও সত্যিই গর্ব করার মতো। এই তো সেদিন বাঁশখালীর চাঁপাছড়ীর মেয়ে চৌধুরী উম্মে কুলসুম প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ব্যবস্থাপনা বিভাগ হতে সর্বোচ্চ সিজিপিএ অর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছেন।
সাধনপুর ইউনিয়নের রাতারকুল গ্রামের ছেলে রাফিউল ইসলাম ‘দ্যা নেটওয়ার্ক ফর ইন্টারন্যাশনাল ল স্টুডেন্টস- নিলস, বাংলাদেশ এর ন্যাশনাল বোর্ড এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। বর্তমান সময়ে তিনি সেরা বিতর্ককারীদের একজন। দেশে বিদেশে অনেক প্রতিযোগীতায় তিনি বিজয়ী হয়েছেন।
বৈলছড়ি ইউনিয়নের চেচুরিয়া গ্রামের বদরে আলম দিদার লন্ডনের সোসআইটি অব মিডল টেম্পল কর্তৃক ‘বার এট ল’ ডিগ্রী লাভ করেন। তার এ অর্জনে বাঁশখালীর সাথে সাথে বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল হয়েছে।
এমন আরও অনেক গৌরবময় গল্প আছে বাঁশখালীর। তবুও এই উপজেলা এখনও উন্নতির শিখরে গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। সেটা হয়তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে কিছু কারণও আছে যেগুলো বাঁশখালীর উন্নয়নের অন্তরায়। প্রথমত, এখনও বাঁশখালীর স্বাক্ষরতার হার মাত্র ৩৬.৩০ শতাংশ। বাঁশখালীকে সবার কাছে অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত হতে হবে।
আশার কথা হচ্ছে, সাহিত্য ও শিল্পচর্চায় এখন কিছু সামাজিক সাহিত্যিক সংগঠন অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ‘বাঁশখালী সাহিত্য পরিষদ’ এমনই একটি সংগঠন। এছাড়া সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, চট্টগ্রামস্থ বাঁশখালীবাসীর প্রাণের সংগঠন বাঁশখালী সমিতি, বাঁশখালী সমাজ উন্নয়ন ফোরাম, শান্তি সংগঠন বানীগ্রাম এমন আরও অনেক সংগঠন।
এরপর আসে, বাঁশখালীর দর্শনীয় স্থানগুলো। বখশী হামিদ মসজিদ (১৫৫৮), ছনুয়া কমিউনিটি সেন্টার (১৯৬৫), নিম কালীবাড়ী (১৭১০), শিখ মন্দির (বাণীগ্রাম), মনু মিয়াজি বাড়ি জামে মসজিদ, জমিদার মনু মিয়াজি বাড়ির পুরোনো ভবন, জমিদার মনু মিয়াজি বাড়ির মসজিদের মিনার, মালকা বানুর দীঘি এবং মসজিদ; এখানে চট্টগ্রামের লোক-কাহিনি মনু মিয়া-মালকা বানুর নায়িকা-চরিত্র মালকা বানু চৌধুরীর জন্মস্থান, বাঁশখালী ইকোপার্ক, চাঁদপুর-বেলগাঁও চা বাগান, বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত, খানখানাবাদ সমুদ্র সৈকত, জলদী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলকদর খাল, পশ্চিম উপকূলের লবণ মাঠ, জাতেবী জামে মসজিদ, নবী মসজিদ (অষ্টাদশ শতক), সরল্যার মসজিদ, সরল্যার দীঘি, মহিষের টেক সবুজ বেস্টনী, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত, বৈলছড়ি খান বাহাদুর বাড়ী ইত্যাদি। প্রচারের অভাব ও দূর্বল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে স্থানগুলো অবহেলিত হয়ে রয়েছে। এগুলোর যথাযথ সংস্কার, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও সু-প্রচার বাঁশখালীকে পর্যটন সমৃদ্ধ উপজেলার মর্যাদায় আসীন করবে। এজন্য সরকারের সুনজর ও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
একটা সমাজের শক্তি এর জনগণ। উন্নত জনপদ গঠনের জন্য প্রয়োজন জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্ঠা। ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা, দূর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা ইত্যাদি গুণাবলী নিজেদের মধ্যে ধারণ করার মাধ্যমে বাঁশখালীর সুনাম সারা দেশে এবং বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে পারে বাঁশখালীবাসীরাই।
এই সবগুলো বিষয়ের ওপর যদি দৃষ্টি দেয়া হয়, জনগণ ও জনপ্রতিনিধি যদি সচেষ্ট হন তাহলে সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন আমি আর আমার মতো অনেকেই গর্ব করে বলব, ‘আমার বাড়ি বাঁশখালী।’ সামনের জন তখন স্বশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে দেখবে। আমি তখন একজন গর্বিত বাঁশখালীয়ান।
লেখক: কবি ও গল্পকার