পোর্ট অব প্রেমাশিয়া: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

♦ সিফাত মাহমুদ চৌধুরী
> মার্চেন্ট মেরিন অফিসার
নদী বয়ে যায়, তরঙ্গ জানেনা সমুদ্র কোথায় তবে নদী না জানলেও আমরা জানি আমাদের প্রিয় নদী সাঙ্গুর
কথা। কর্ণফুলীর পর এটাই চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। অতি উচ্চ পর্বত শীর্ষ থেকে সাঙ্গু নদী নেমে এসে মুল স্রোতটি ১৭৩ কিমি পথ অতিক্রম করে পশ্চিম বাঁশখালীর প্রেমাশিয়া কদম রসুল ও খানখানাবাদের কাছ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে।
এই জেলার জীবন জীবিকার সাথে সাঙ্গু নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাঙ্গার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বর্ষাকালে প্রমত্তা ও তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ স্রোতস্বিনীর রুপ নেয়। নদীটি ৪৮-৪৯ কি.মি নাব্য হিসাবে বিবেচ্য। নদীর অববাহিকা বৃষ্টিবহুল ক্রান্তিয় বলয়ের অর্ন্তভূক্ত হওয়ায় মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিপুল পরিমাণে জল প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে দুই নদী কর্ণফুলী ও সাঙ্গুর আর্শীবাদপুষ্ট চট্টগ্রাম আলোকিত হয়েছে। আমাদের ভুগোল ইতিহাস সভ্যতা সংস্কৃতি যোগাযোগ, অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদনে এই দুই নদী কর্ণফুলী ও সাঙ্গুর অবদান অনস্বীকার্য।
এই সম্ভাবনাময় নদী সাঙ্গুর মোহনায় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে একটি সেকেন্ডারী সি পোর্ট, পোর্ট অব প্রেমাশিয়া। এই নিয়ে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগি হিসেবে একটি সেকেন্ডারি সি পোর্ট অত্যন্ত জরুরী। সি এন্ড ল্যান্ড কানেকশানের জন্য এই রকম পোর্ট এর প্রয়োজনীয়তা অনেক দীর্ঘ সময়ের। শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরজন্য নয় সামাজিক কর্মকান্ডেও এই পোর্ট ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সি পোর্ট যেখানে আর্ন্তজাতিক মানের জাহাজ পণ্য ও যাত্রী নিয়ে নিরাপদে পোতাশ্রয়ে ভিড়তে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকিং সুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সহজতর হবে । সাঙ্গু মোহনা তারই একটি উৎকৃষ্ট উপমা। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭-৮ কিমি দক্ষিণে অবস্থান এর কারণে দুইটি পোর্ট একই ব্যবস্থাপনার পরিচালিত হওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয় বিএইচএফ কমিউনিকেশন রেডিও র্যাঞ্জ এর মধ্যে অবস্থিত বিধায় চট্টগ্রাম পোর্ট কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সহজে এবং তাৎক্ষনিক যোগাযোগ ও মনটরিং সম্ভব। সড়ক পথে আরো অধিকতর নিকটবর্তী এই সাঙ্গু মোহনা। প্রস্তাবিত ৪ লাইন বিশিষ্ট চট্টগ্রাম কক্সবাজার মেরীন ড্রাইভ রোড এই সাঙ্গু মোহনার উপর দিয়ে সংযুক্ত হবে ফলে সড়ক পথে পণ্য পরিবহনেও নতুন কোন রোড এই প্রয়োজনীয়তা থাকছে না। শুধু তাই নয় সাঙ্গু মোহনা থেকে একটি সাঙ্গু শাখা নদী পটিয়ার মধ্য দিয়ে শিকলবাহার মুখে কর্নফুলিতে মিলিত হয়েছে। যার মাধ্যমে পোর্ট টু পোর্ট ইন্টারনাল / আউটার রুটে কার্গো ট্রান্সপার সম্ভব। ( ইনল্যান্ড শীপের মাধ্যমে)
গভীরতার ব্যাপারে অনেকে প্রশ্ন তুললেও এই নদীর মোহনা ভিতরের ৪-৫ কিমি ভিতরের নাব্যত জোয়ারের সময় ৬-৭ মিটার। সম ড্রাফটের জাহাজ চলাচলের উপযোগী বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা রয়েছে। এই চ্যানেলটির অগ্রীম সার্ভের মাধ্যমে তার সম্ভাব্যতার মুখ্যদ্বার উম্মোচিত হবে।
ব্রাক ওয়াটার- সাঙ্গু মোহনায় রয়েছে এক সুন্দর ন্যাচারাল ব্রাক ওয়াটার সিস্টেম। যা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ইঙ্গিত করছে এখানেই লুকিয়ে আছে এক সম্ভাবনাময় নতুন পোর্ট যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় সাশ্রয়ী বলে বিবেচিত হবে।
নেভিগেবল চ্যানেল- প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই চ্যানেলটি শতবৎসর ধরে তার আপন গতি ও পথ অক্ষুন্ন রেখে চলছে। সাগর ও মোহনা দুটির মাধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ন্যাচারাল স্থায়ী বালির চর। যা ব্রাক ওয়াটার বা চ্যানেল মার্কিং ও স্রোতের প্রবাহ কন্ট্রোল এর জন্য খুবই উপযোগী। গত ৫০-৬০ বছরের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় নাবিক ও মাঝি মাল্লাদের কাছে জানা এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
এই সাঙ্গু পোর্ট বাস্তবায়িত হলে উপকূলের বাঁশখালী, পেকুয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটন কেন্দ্র, উপকূলের লবণ, মৎস সম্পদ আহরণের গতি আসবে ফলে সৃষ্টি হবে কলকারখানা ও অর্থনৈতিক জোন।
জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিতেও এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে নৌবাহিনী হেড কোয়ার্টার পতেঙ্গায় অবস্থিত। এই নৌ বেইজ এর পাশে রয়েছে বিমান বাহিনীর জাতীয় গুরুত্বপুর্ণ স্থাপনা। দূর্ভাগ্যজনক ও অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে বিস্কোরক জাতীয় পেট্রোলিয়াম পন্য খালাসের জেটি, স্টোরেজ, পরিশোধনাগার একই অবস্থানের কয়েক মিটার দুরত্বে। ফলে ঝুঁকিপুর্ণ হয়ে উঠছে পুরো এলাকাটি। যে কোন বহিঃশত্রুর আক্রমণে সহজে বিপর্যস্ত হবে ২টি জাতীয় গুরুত্বপুর্ণ স্থাপনা নৌ ও বিমান বাহিনী ঘাটি। তাই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে এখানে অবস্থিত পেট্রোলিয়াম জেটি, শোধনাগার, ডিপো ইত্যাদি স্থানান্তর করা যেতে পারে প্রস্তাবিত সাঙ্গু মোহনায়।
কিছুটা লাঘব হবে চট্টগ্রাম বন্দর যানজটের ভার। এই সময়ে অভ্যন্তরীন জলযান সমূহ হিমশিম অবস্থায় দিনাদিপাত করছে। স্থান সংকুলানের অভাবে যেখানে সেখানে নোঙ্গর করছে দেশীয় জলযান ও অসংখ্য ফিশিং ভেসেল ইত্যাদি । প্রকৃতির যে কোন বৈরিতায় / ঘুর্ণিঝড়ে বির্পযস্থ হতে পারে সবগুলো জলযান এবং নিকটবর্তী স্থাপনা। সব কিছু বিবেচনার সাঙ্গু মোহনাকে সেকেন্ডারী পোর্ট হিসাবে বেছে নেয়ার এখনই উৎকৃষ্ট সময়। উন্নয়নের স্বার্থে প্রজ্ঞাপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এই অঞ্চলের সম্ভাবনার নতুন ঝিলিক সৃষ্টি করবে। বাড়বে অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি ও বৈদেশিক অর্থ উপার্জনের নতুন স্রোত।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে শিপিং বানিজ্যে পাল্লা দিতে এই পোর্ট আমাদের বহুদূর এগিয়ে নিতে পারে। পাশাপাশি আমদানী রপ্তানি বানিজ্য, শিল্প ও জ্বালানী ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস বিশেষজ্ঞ মহলের।