বাঁশখালীর সমাধানযোগ্য অন্তরায়সমূহ
আবু ওবাইদা আরাফাত
প্রকৃতির সবটুকু লাবণ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাঁশখালীর আনাচে-কানাচে। দীর্ঘ সময়ের পরও যে সময়ে ‘উন্নত বাঁশখালী’ দেখার কথা সে সময়ে ‘উন্নয়নশীল বাঁশখালী’ দেখেই আমাদের তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে হচ্ছে। তবে এর মধ্যে কিছু কিছু নিদর্শন ‘অনুন্নত বাঁশখালী’ হিসেবে সাব্যস্ত করতেই যথেষ্ট। এসব কলঙ্কের তিলক চোখের সামনে এলে আমাদের মুখ গোমড়া হয়ে আসে। সমস্ত সম্ভাবনা বিরাজিত থাকার পরেও কেবল ‘যোগ্য নেতৃত্বের’ অভাবে আমাদের পিছিয়ে থাকার দায়টা নিজেদের কপালের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমরা নির্ভার থাকি।
বড় সম্ভাবনার কথা হচ্ছে আমাদের সমস্যা ও অন্তরায়সমূহ সমাধানযোগ্য। কিছু সমস্যা ঠুনকো কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে অবহেলার ফলে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে ‘দুর্ভোগ’।
অথচ কেবল সদিচ্ছা, দায়িত্বশীলতা ও বাঁশখালীর প্রতি আন্তরিকতাই পারে সমস্যাগুলোকে সমাধানে পরিণত করতে। উন্নত বাঁশখালী গড়ার মানসিকতা জাগ্রত হলে অদূর ভবিষ্যতে দুর্ভোগ নিয়ে অভিযোগ করার মতো মানুষ পাওয়া যাবে না। বর্তমানে সমস্যার ভলিউম এতোবেশি যে অভিযোগের উচ্চকন্ঠ লেগেই থাকে। মানুষের অভিযোগ-হাহাকারের উত্তাপ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার সুযোগে বিশাল জনগোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। মানুষের সকল প্রাপ্তি-বেদনা, আন্দোলন-বিক্ষোভ তাই মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। অনলাইনে এসব হাহাকার ভেসে উঠার ফলে কিছু ক্ষেত্রে সমাধান হয় বটে তবে মোটাদাগে বাঁশখালীর বাইরের এলাকা তথা বহির্বিশ্বে আমাদের ইমেজ সংকটের মুখে পতিত হয়। অবশ্য এই ইমেজ নিয়ে একজন সাধারণ বাঁশখালীয়ানের মাঝে যে সংবেদনশীলতা ও অনুভূতি কাজ করে তা কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কাজ করেনা বললেই চলে।
সারা দেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। এই স্রোতে বাঁশখালী স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো অনেক আগেই৷ আমাদের গর্ব করার মতো অর্জনের ঝুলিতে আছে উপকূলের বেড়িবাঁধ ও সাঙ্গু নদীর সেতু। এই দুই বড় অর্জনেই লেগে আছে বড় দুই অভিযোগ। বেড়িবাঁধে মানহীন ব্লক ও কাজের অসম্পূর্ণতা। সাঙ্গু সেতুর মতো কম দৈর্ঘ্যের সেতুতে টোল আদায়ের নজির সৃষ্টি। বছরের পর বছর রাজনৈতিক আধিপত্যের খেসারত হিসেবে টোল আদায় করতে হচ্ছে বাঁশখালীবাসীকে।
বাঁশখালী প্রধান সড়ক বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের ভূমিকা পালন করছে। যতটুকু ভার এই ছোট সড়কের উপর দেয়া হলো তার সাইড এফেক্ট যা হওয়ার তা নিয়মিত ঘটছেই। অবিলম্বে এই সড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করতে হবে। প্রশস্ততা বাড়তে হবে, এর বিকল্প নেই। এ কাজে যত বিলম্ব হবে লাশের সারি তত দীর্ঘতর হবে। কয়েক বছরের ব্যবধানে কক্সবাজারে কয়েকটি উপজেলার মানুষের যাতায়াতের প্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই সড়ক। অত্যধিক গাড়ি এবং সে তুলনায় সড়কের ব্যপ্তি কম হওয়ায় প্রায় সময় যানজট লেগেই থাকে৷ উপজেলা সদর, গুনাগরী খাসমহল ও চাঁনপুর বাজারে ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা করা আহামরি বড় কাজ নয়। ইদানিং আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে সিএনজি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা। এদের মধ্যে সিংহভাগের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র; বেশিরভাগ চালক অপরিণত বয়সের। বাঁশখালী সড়কে ভাড়া নৈরাজ্যের চিত্র এতোটাই নাজুক যে যেন অভিভাবকহীন। নিয়ম-তোয়াক্কার বালাই নেই। যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকদের মধ্যকার ঝগড়া-সংঘাত-অসন্তোষ লেগেই থাকে। এসব অভিযোগের জন্য কেন জনগণকে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে হবে? জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সরেজমিনে তদারক করলেই মিটে যাবে অনেক সমস্যা।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী প্রধান সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হাটবাজারগুলো। বেচা-কেনার উদ্দেশ্যে সড়কের উপর মানুষের ঝটলা লেগেই থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাঁশখালীর প্রায় ৬০টি ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজার বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেসবের অবস্থান ছিলো গ্রামীণ রাস্তার পাশে। এসব গ্রামীণ হাটবাজারের অনেকগুলো সরকারি খাস জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। ঐ জায়গাগুলো এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে; অনেকগুলো অসাধুদের খপ্পরে বেদখল হয়ে গেছে৷ দখলবাজ হতে জায়গাগুলো উদ্ধার করে গ্রামীণ হাটবাজারগুলো চালু করা গেলে প্রধান সড়কের উপর চাপ কমবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করি।
বাঁশখালীতে ‘পল্লী বিদ্যুৎ’ এক মহাযন্ত্রণার প্রতিশব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অফলাইনে অনলাইনে গলা ফাটিয়েও কাজ হয় না, তাদের ফোন করলেও রিসিভ হয় না। জবাবদিহিতার বালাই নেই বললেই চলে। তাদের সমস্যাগুলো জনগণকে ব্যাখ্যা করুক। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে বাঁশখালীবাসী একজোট হয়ে সরকারের আছে আবেদন জানাবে। এভাবে সমাধানযোগ্য সমস্যাগুলো যুগযুগ ধরে জিইয়ে আছে কেবল সংলাপের অভাবে, জনগণকে প্রতিপক্ষ ভাবার কারণে।
জলকদর সদ্যমৃত বাঁশখালীর পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণজুড়ে বহমান এক সম্ভাবনাময়ী খাল। একসময় এই খাল ছিল পণ্যপরিবহণের নির্ভরযোগ্য চ্যানেল। জলকদরকে বাদ দিয়ে বাঁশখালীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কল্পনা করা যাবে না। অবিলম্বে খালখেকো, দখলবাজদের খপ্পর হতে এই খালকে রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনীয় খননকাজ সম্পাদন করে ব্যবহার উপযোগী খালে পরিণত করতে প্রশাসনের তড়িৎ ব্যবস্থা দরকার। আশার কথা হচ্ছে- সম্প্রতি দখলবাজদের ভিত্তি দূর্বল হয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে জলকদর পুনরুদ্ধারে একটি বিশাল তরুণ সমাজ অনলাইনে সরব ভূমিকা রেখে আসছে৷ এই সচেতনতা সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বাঁশখালীর কৃতিসন্তান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন ভাই৷
বাঁশখালীকে পর্যটন উপজেলা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতির তোড়জোড় শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে। এই স্বীকৃতিও জনগণের ‘দাবি’র মতো ইস্যু নয়। বাঁশখালীর ভৌগলিক স্বকীয়তা ও অপার পর্যটন সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ ‘পর্যটন উপজেলা’ গড়ার সবটুকু শর্ত পূরণ করে সরকারি স্বীকৃতির গেজেট আদায় করা। বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচারে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটকের নজর কেড়েছে। অথচ সৈকতে কোন ধরণের নাগরিক সুবিধা নেই বললেই চলে, নেই স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ, নেই উপজেলা প্রশাসনের কোন উদ্যোগ। এমনকি সৈকতে যাতায়াতের পরিস্থিতিও নাজুক। সন্ধ্যা হলেই নিরাপত্তার কথা ভেবে শঙ্কায় বুক ভার করে ফিরে যেতে হয় দর্শনার্থীদের।
উপর্যুক্ত সমস্যা ও অন্তরায়সমূহ নিঃসন্দেহে সমাধানযোগ্য। কেবল সদিচ্ছা এবং নিজ নিজ দায়িত্ব ও পদের প্রতি সুবিচার করলে অদূর ভবিষ্যতে অভিযোগ করার মতো আর কোন বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ বাঁশখালীর প্রতীক্ষা আর দীর্ঘ না হোক।
লেখক: সম্পাদক, বাঁশখালী টাইমস
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাঁশখালী সমিতি চট্টগ্রাম