BanshkhaliTimes

বাঁশখালীর পর্যটন: সমৃদ্ধির সোনালী দিগন্ত

BanshkhaliTimes

তাফহীমুল ইসলাম, বাঁশখালী- পূর্বে সারিবদ্ধ উঁচু নিচু পাহাড়, পশ্চিমে বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। মাঝখানে অভিন্ন জাতিসত্তার লাখ লাখ মানুষের বসবাস। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এই জনপদটির নাম বাঁশখালী। যেটি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এখানে রয়েছে চা-বাগান, সমুদ্র সৈকত, ইকোপার্ক, তারেক পার্ক, জলকদর খালসহ নান্দনিক বহু পর্যটন স্পট। অল্প সময় নিয়ে একইসাথে পাহাড়, সাগরের মিতালি গড়তে এই উপজেলার জুড়ি নেই।

৩৯২ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট বাঁশখালী উপজেলার প্রবেশদ্বার পুকুরিয়া। এই ইউনিয়নের প্রধান সড়ক থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে বেঁলগাও চা বাগানের অবস্থান। ১৯১২ সালে ইংরেজদের হাত ধরে এই বাগানের গোড়াপত্তন ঘটে বলে কথিত আছে। ৩ হাজার ৪৭২.৫৩ একর আয়তন বিশিষ্ট দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই একমাত্র চা বাগানে বর্তমানে সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় চাপাতা উৎপাদন চলছে। দেশের চা উৎপাদনে গত বছর সেরা পাঁচে থাকা এই চা বাগানে চলতি বছর ৩ লাখ ৪০ হাজার কেজি চাপাতা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাতার কাটিং, কোয়ালিটি ও পুষ্টিগুণের কারণে এখানকার পাতার কদর রয়েছে দেশজুড়ে। সরেজমিনে দেখা যায়, উঁচু-নিচু ও ঢালু পাহাড়ে নারী-পুরুষ চা শ্রমিকরা চা বাগান পরিচর্যা করছেন। কেউ কেউ ব্যস্ত রয়েছেন গাছের বীজতলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে। দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার পাশাপাশি এই চা বাগানটি পর্যটন স্পট হিসেবেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সফর, ব্যাংকের বার্ষিক ট্যুরসহ বিভিন্ন আয়োজনে পছন্দের স্থান হিসেবে এই স্পট থাকছে শীর্ষ তালিকায়। যার ফলশ্রুতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকদের পদচারণায় প্রতিদিনই মুখরিত থাকছে নান্দনিক এই পর্যটন স্পট।

বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিমাংশজুড়ে রয়েছে টানা ৩৫ কিলোমিটারের বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। যা প্রধান সড়ক থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে। এই সৈকতের ৬/৭ টি পয়েন্ট রয়েছে। তন্মধ্যে বাহারছড়া, খানখানাবাদ, কদম রসুল, কাথরিয়া পয়েন্ট সবচেয়ে নান্দনিক। এই সৈকতের ঝাঁউ গাছের শাঁ শাঁ আওয়াজ যেন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অগভীরতা এই সমুদ্রের বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য। যার কারণে সৈকত থেকে পানিতে আধা কিলোমিটার নির্ভয়ে হাঁটা যাবে। সৈকতে ভাটা পড়লে মাটি ফেটে বের হয়ে আসে লাল কাঁকড়া। যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে জাগিয়ে দেয় নানা কৌতুহল। সরকারি স্বীকৃতি না থাকলেও ইতিমধ্যে এই পর্যটন স্পটের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে এখানে। বিশেষ করে শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিনে এই সৈকতে পর্যটকের ঢল নামে। শীতকালীন সময়ে আগমন ঘটে নানা জাতের অতিথি পাখির। কেউ কেউ এটিকে ‘মিনি কক্সবাজার’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। রাত যাপন, হোটেল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আরেকটু উন্নয়ন করা গেলে কক্সবাজারের মতো এখানেও মানুষ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসবে বলে অনেকের ধারণা। পাশাপাশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাও জরুরী। এদিকে সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় এই সমুদ্র সৈকতের ঝাঁউ বাগান হুমকির সম্মুখীন। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে রয়েছে ঝাঁউ বাগান নিধন ও সৈকতের বালু উত্তোলনের অভিযোগ। এপ্রসঙ্গে খানখানাবাদ ইউপির বাসিন্দা, সাবেক ছাত্রনেতা গাজী জাহেদ আকবর জেবু বলেন, ‘উপকূল বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান এমপি মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সৈকত থেকে বালু উত্তোলন ও ঝাঁউ গাছ নিধন কিছুটা কমলেও সরকার দলীয় পরিচয়ে কিছু অনুপ্রবেশকারী সৈকত থেকে বালু উত্তোলনের সাথে এখনো জড়িত। বেড়িবাঁধের কাজে বাইরে থেকে বালু এনে জিও ব্যাগ করার কথা থাকলেও খানখানাবাদ, কদম রসুল এলাকায় সৈকত থেকে বালু তুলতে দেখা গেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, উপকূলবর্তী উন্নয়ন কাজে জড়িত ঠিকাদাররাও এর জন্য দায়ী৷ আরেকটি পক্ষ ঝাঁউ গাছ নিধনে জড়িত। ঝাঁউ গাছ নিধন নিয়ে বিভিন্ন সময় বন বিভাগের তৎপরতা দেখা গেলেও মামলা, গ্রেফতারের নজির নেই। বনবিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাভোগী রাজনীতিবিদরা এসবের দায় এড়াতে পারে না।’

দেশ বিদেশে সর্বাধিক পরিচিত বাঁশখালীর আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র বাঁশখালী ইকোপার্ক। এটি চট্টগ্রাম শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণে শীলকূপ এলাকা থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ১২০০ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট এই পার্কে রয়েছে দেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু। পূর্বের পাহাড়ী অংশে রয়েছে নানা জাতের বন্যপ্রাণী। তাছাড়া বোট রাইডিং, পিকনিক সেট, দ্বিতল রেস্ট হাউস, রিফ্রেশমেন্ট কর্ণার, সুউচ্চ অবলোকন টাওয়ার, ফেনোরোমিক ভিউ টাওয়ার, মিনি চিড়িয়াখানা, সাসপেনশন ব্রীজ, মিনি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কি নেই এখানে! প্রতিষ্ঠার পরপরই এই পার্কটি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল। স্কুল, কলেজের শিক্ষা সফরের জন্য এই পার্ক বেশ পছন্দনীয় স্পটে পরিণত হয়েছিল। এমনকি নায়ক, নায়িকাদের শুটিং স্পট হিসেবেও এই পার্ক পেয়েছিল অনন্য খ্যাতি। মাঝখানে কিছুটা অবহেলার শিকার হওয়ায় এই নান্দনিক পর্যটন স্পটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও ইকোপার্কের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের অধীনে পরিচালিত বাঁশখালী ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। জানা যায়- বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা, ইকো ট্যুরিজম ও চিত্ত বিনোদনের লক্ষ্যে এই বনাঞ্চলকে পার্কে রূপ দেয়া হয়। ১৯৯৭ সালের উদ্ভিদ জরিপ মতে এখানে ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। তন্মধ্যে ১৮ প্রজাতির দীর্ঘ বৃক্ষ, ১২ প্রজাতির মাঝারি বৃক্ষ, ১৬ প্রজাতির বেতসহ অর্কিড, ইপিফাইট ও ঘাস জাতীয় গাছ।

বাঁশখালীকে পর্যটন উপজেলা ঘোষণার দাবি যখন দিন দিন জোরালো হচ্ছে, তখনই এই দাবিকে আরো প্রাসঙ্গিক করতে দক্ষিণ বাঁশখালীর নাপোড়াতে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘অর্গানিক ইকো ভিলেজ’। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই পর্যটন স্পটের আরেক নাম ‘তারেক পার্ক’। এই পার্কটি মাত্র কয়েক বছর আগে চালু হয়েছে। এরই মধ্যে পর্যটকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই পার্কে বিলুপ্ত হতে যাওয়া বন্যপ্রাণী, দেশীয় বৃক্ষ সংরক্ষণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের মিউজিয়াম গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে। এই নান্দনিক পর্যটন স্পট ছাড়াও বাঁশখালীতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহি জলকদর খাল। যেই খাল একসময় এই এলাকার মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। ইলশা গ্রামে রয়েছে ৪৫০ বছরের পুরাতন বখশী হামিদ জামে মসজিদ। যেই মসজিদ দেখতে শুক্রবার ও ছুটির দিনে মানুষ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। সরল ইউনিয়নে আছে ঐতিহাসিক মলকা বানুর দীঘি ও মসজিদ। এসব ছাড়া রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। এখানকার লবণের মাঠ ও পানের বরজও পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সবকিছু মিলিয়ে বলতে গেলে দেশের পর্যটনে মডেল উপজেলা বাঁশখালী। সরকারি স্বীকৃতি পেলে পর্যটনে এই জনপদ হতে পারে দেশসেরা উপজেলা। মিরসরাই থেকে আনোয়ারা, বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যে মেরিন ড্রাইভের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে সহসা বদলে যাবে পর্যটনের এই মডেল উপজেলা। বাঁশখালী পর্যটন উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু ওবাইদা আরাফাত বলেন- ‘বাঁশখালী উপজেলায় পর্যটন খাতকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে উপজেলা প্রশাসন, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। প্রাকৃতিক রসদে ভরপুর এই নান্দনিক উপজেলায় যেসকল দর্শনীয় স্থানের উপস্থিতি তা দেশের আর অন্য কোথাও নেই। বলিষ্ট নেতৃত্ব ও পর্যটন স্পটগুলোর সাথে সংযোগ সড়কের উন্নতি তথা যোগাযোগ সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটন উপজেলা হিসেবে খুব দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে বাঁশখালীর।’

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *