BanshkhaliTimes

বাঁশখালীতে ৭ লাখ মানুষের জন্য সরকারী ডাক্তার ৫ জন!

BanshkhaliTimes

মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের, বাঁশখালী টাইমস: চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীর ৭ লক্ষ মানুষের ৫০ শয্যার একমাত্র সরকারী হাসপাতালটিতে বর্তমানে নার্স বাড়লেও চিকিৎসক না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে সেবার মান। দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ জনগনকে। প্রতিদিন শত শত রোগী বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসলেও চাহিদা অনুযায়ী সেবা না পেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের দিকে ঝুঁকে পড়েছে রোগীরা। এছাড়াও তীব্র পানি সংকট, চিকিৎসক সংকট, ময়লা-আর্বজনার স্তুপ, দালালদের দৌরাত্ম্য আর বে-সরকারী অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের প্রভাবে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষ চিকিৎসা নিতে এসে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

BanshkhaliTimes

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিমাসে হাসপাতালে আন্তঃ বিভাগে ৮ শ থেকে ১ হাজার, বহি:র্বিভাগে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার এবং জরুরী বিভাগে ২ থেকে আড়াই হাজার রোগী চিকিৎসা নিলেও রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রোগী ও আত্মীয়দের। কেবল জরুরী বিভাগেই সচল রয়েছে। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে রেডিওলজি চিকিৎসক না থাকায় বাইরে থেকে রোগীরা আলট্রাসনো করায়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি নিদিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম ও উল্লেখ করে দেন চিকিৎসকরা। এ সুযোগে বহিরাগত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল প্রতিনিধিদের আনাগোনা বেড়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হাসপাতালের খাবার নিয়েও অভিযোগ রোগীদের। এ হাসপাতালে রোগীদের খাবার বিতরণের সময় খাবারের পরিমান যেমন কম, তেমনি খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন স্বজনদের। ডালের পাত্রে দেখা যায় শুধুই পানি। হাসপাতালে ভর্তি মহিলা ওয়ার্ডের রোগী হোসনেয়ারা বেগমের মা নুর নাহার বেগম ও পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা ডায়রিয়া রোগী শীলকূপ এলাকার হাসিনা বেগম জানান, ভাতে অনেক সময় গন্ধ থাকে, তবে মাছ এবং মাংস মোটামুটি ভাল। তরকারীর ওপর কাঁচা তেল ভাসে, বাধ্য হয়ে এ সব খাবার খেতে হয়। তবে অন্যান্য বছরের তুলানায় খাবারের মান ভাল হয়েছে। সকালে একটি ডিম, একটি কলা, ২পিস পাউরুটি দেওয়া হয়। অথচ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের খাবারের জন্য দৈনিক সরকারীভাবে মাথাপিছু বরাদ্দ ১২৫ টাকা,এর মধ্যে ১ নং পন্য, ২ নং পণ্য ডায়াবেটিক ও স্পেশাল পন্য রয়েছে। ওই টাকার মধ্যেই রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ১ নং পণ্য তালিকায় রোগীর প্রতিদিনের খাবার হিসেবে পাউরুটি ১৩৩ গ্রাম(৪পিস),একটি ডিম,কলা দুটি, চাল ৪০০ গ্রাম,আলু ৫৯ গ্রাম, তরকারী ২০০ গ্রাম, ডাল ২৫ গ্রাম উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে সপ্তাহে দুই দিন উল্লেখিত যে কোন মাংস রোগীদের সরবরাহের কথা থাকলেও সেটা তুলনামূলক ভাবে দেওয়া হয়। তবে খাবারের মান মোটামুটি ভাল। হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আর এমও ) ডাঃ হীরক কুমার পাল বলেন, রান্নার পরিবেশনের মান ভালোই তো দেখি। অনিয়ম পাওয়া গেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী ৫০ শ্যাযার এই একমাত্র হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহ প্রথম শ্রেণীর পদ রয়েছে ৩৫ টি। তার মধ্যে বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ৫ জন। তার মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, শিশু ইএনটি, জুনিয়র কনসালটেন্ট রেডিওলজি ও প্যাথলজি এবং প্যাথলজিষ্টও অ্যান্সেথেটিস্ট চিকিৎসকসহ ১০ টি পদ খালি রয়েছে। প্রেষনে কর্মরত আছেন ৩ জন। জুনিয়ার কনসালটেন্ট রেডিওলজি ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে বদলী হওয়ার পর থেকেই পদটি শূন্য। এ ছাড়া শূন্য রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট, চক্ষু কনসালটেন্ট, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে ১ জন, নার্সিং সুপারভাইজার ১ জন, রেড়িওলজিস্ট এবং ল্যাব টেকনোলজিস্ট পদে ৩ জন থাকার কথা থাকলে ও আছে শুধু ১ জন, অন্য ২ জন প্রেষনে রয়েছে, ডেন্টাল পদে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ১ জন, ফার্মাসিস্ট পদে ৩ জন থাকার কথা থাকলে বর্তমানে আছে একজন, বাকী ২ পদ শূন্য রয়েছে। মালি, নাইটগার্ড,বসুইপার সংকট তো আছেই। এর মধ্যে ওয়ার্ড বয় আয়া ২ জন, কুক- মসালচী ২ জন এবং সুইপার পদে ২টি পদ শূন্য। ভেষজ কর্মচারী পদের মধ্যে ২টি পদ শূন্য রয়েছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে সাপোর্টিং স্টাপ রয়েছে ৩ জন। সরেজমিনে বৃহস্পতিবার ও শনিবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে বাঁশখালী হাসপাতাল পরির্দশন কালে দেখা যায়, জাতীয় পতাকা টাঙ্গানোর খুঁটি আছে , কিন্তু পতাকা নাই! বহিঃবিভাগে রোগীদের দীর্ঘ লাইন, ২নং কক্ষে ডাঃ মনিরা ইয়াছমিন ও সিনিয়র স্টাফ নার্স পারুল নাথ, ৮ নং কক্ষে এসইসিএমও শিক্ষানবীশ খাতিজাতুল খোবরা, ৬ নং কক্ষে এসএসএন মোঃ মাসুদ, ৫ নং কক্ষে এসইসিএমও শিক্ষানবীস রেনু আক্তার সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এভাবে ডাক্তারের পরিবর্তে স্টাপ নার্স এবং শিক্ষানবিস ডি এম এফ দ্বারা চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ কক্ষে রোগীদের পাশাপাশি ঔষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধি গণকে দেখা গেছে। গাইনী সার্জন না থাকায় সিজার করা হচ্ছেনা, মোটামুটি টুকটাক মাঝেমধ্যে ডেলিভারী করা হয়। অন্যদিকে সরকার বিগত বছরে নতুন এক্স-রে মেশিন দিলেও টেকনেশিয়ানের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। ইতিপূর্বে এক্স-রে মেশিন পরিচালনার করার জন্য দোহাজারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে এক জন টেকনেশিয়ান এনে সপ্তাহে একদিন করে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে এক্স-রের সেবা ১দিন দেওয়া হলেও বেশির ভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের বাইরে বিভিন্ন ল্যাব এ ২০০ থেকে ৬০০ শত টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। বেশির ভাগ ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হয় রোগীদের। এতে বাইরের ল্যাব গুলোই রোগীদের ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। এ দিকে বিগত কয়েক বছরের বেশি সময় ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে ১টি অ্যাম্বুলেন্স, ও ৩ টি টিউবওয়েল। ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও স্বজনদের বাইরে থেকে পানি কিনতে হয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা মহিলা ওয়ার্ডে মোটামুটি তবে পুরুষ ওয়ার্ডে খুবই নাজুক। একইভাবে মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডে নার্স এবং বয়ের পরিবর্তে আয়া এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীদেরকে দিয়ে ইনজেকসেন ও স্যালাইন পুশের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। অনেকেই সীট না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছে। অন্যদিকে লোডংশেডিংয়ের কারণে রোগীরা অতিষ্ট। ১টি জেনারেটর থাকলেও জ্বালানি তৈল বরাদ্দ না থাকার অজুহাত দেখিয়ে লোডশেডিংয়ের সময় দেখা যায় জেনারেটর বন্ধ। বহিঃবিভাগের টিকেট কাউন্টারে কর্মরত আউট সোর্সিং ৪ জন কর্মচারী ১৮ মাস যাবৎ বেতন বন্ধ, তাদের বেতন মাসিক কত এখনও পযর্ন্ত তারা জানেনা। তারা নয়িম উদ্দীন ঠিকাদারের আওতাধীন বলে জানা যায়। অন্যদিকে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে গেলে জরুরী বিভাগে মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করা হয়, জরুরী বিভাগে থাকা আইপিএসটাও নষ্ট। বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে শুধু ২য় তলায় মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ডে সৌর বিদ্যুৎ সচল থাকলে ও পুরো হাসপাতাল এলাকা যেন অন্ধকারে পরিণত হয়। সরকারী ভাবে প্রতি বৎসরের এ্যামবুলেন্স ও জেনারেটর জ্বালানী তৈল বাবদ ৩ লাখ টাকার অধিক বরাদ্দ আসে। তার পরেও সন্ধ্যা নামার সাথে হাসপাতাল এলাকায় অন্ধকারে পরিণত হয়। যার ফলে বখাটে যুবকের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সাব সেন্টার গুলোরও একই অবস্থা, চিকিৎসক না থাকায় কোন ধরনের সেবা পাচ্ছে না তারা। হাসপাতালে বহিঃ বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী সায়েমা, শামিমা জান্নাত,হালিমা বেগম,জান্নাতুল ফেরদৌস, দেলোয়ার হোসেন জানান, প্রাথমিক ও জরুরী চিকিৎসা” সেবা ছাড়া জটিল কিছুুর জন্য বেশির ভাগ রোগীকে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হয়। অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসক না থাকায় এবং সন্তান সম্ভবা নারীদের জন্য গাইনী কনসালটেন্স ও সার্জারী কনসালটেন্স এই হাসপাতালে প্রযোজ্য নয়। জরুরী বিভাগে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়া গেলেও চিকিৎসক না থাকায় নির্ধারিত সময়ে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায় না। একটি এ্যামবুলেন্স সচল থাকলেও ২-৩ মাস যাবৎ ড্রাইভারের অসুস্থতার কারণে সেটিও বন্ধ রয়েছে। চেম্বারে প্র্যাকটিস করা চিকিৎসকরা হাসপাতালের চেয়ে তাদের নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখতে বেশি উৎসাহী। চেম্বারে রোগী টানতে এক শ্রেণীর দালাল চক্রকে কমিশন দিয়ে চিকিৎসকরা চেম্বারে অতিরিক্ত রোগী সরবরাহ করেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা জঙ্গল চাম্বল হাইদারি মুড়া এলাকার তসলিমা বেগম জানান, তিনি তার মাকে ৪৫০ টাকা দিয়ে বুকের এক্স-রে করিয়েছেন।ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালি এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা তাজুল ইসলাম ও শামিম জানান, আমরা গরীব অসহায় রোগী’রা বাইরে থেকে চড়া দামে এক্স-রে করতে না পেরে ধুকে ধুকে মরতেছি।’
মূলত চিকিৎসক’রা দালালদের কমিশনের মাধ্যমে রোগী আনেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের পাশাপাশি ল্যাবের পক্ষে ১০/১২ দালাল সর্বক্ষণিক হাসপাতালের ভিতরে চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে ঘুরতে দেখা যায়। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও ) ডাঃ হীরক কুমার পাল বলেন,বচিকিৎসকসহ জনবল সংকট থাকায় রোগীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। জনবল সংকট দূর হলেই এসব সমস্যা আর থাকবে না। বহিঃবিভাগে অফিস চলাকালীন সময়ে ঔষুধ কোম্পনীর এমআরদের না ডুকার জন্য বলা দেওয়া হয়েছে। নতুন নার্স তারা চিনতে পারে নাই বিধায় হয়তো সেই সুযোগে এমআর ডুকেছে। বিষয়টি আমি অবগত হওয়ার পর তাদেরকে হাসপাতাল এলাকায় সরকারী অফিস চলাকালীন সময়ে না ডুকার জন্য মৌখিক ভাবে বারণ করে সর্তক করে দিয়েছি। এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও কর্মকর্তা ডাঃ কামরুল আজাদ বলেন, ‘চিকিৎসকসহ জনবল সংকট থাকায় রোগীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। জনবল সংকট দূর হলেই এসব সমস্যা আর থাকবে না। তবে জরুরী ভিত্তিতে পানি সমস্যা সমাধানে এমপি মহোদয়ের প্রচেষ্টায় একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করার সকল প্রকার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই নতুন নলকূপ স্থাপন হবে। এই হাসপাতালের জন্য কম পক্ষে আরো ১ টি এম্বুলেন্স দরকার। একটি দিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব। দালালদের শীঘ্রই অভিযান পরিচালানার জন্য উপজেলা আইন শৃঙ্খলা মিটিংয়ে বলা হয়েছে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া চিকিৎসকসহ জনবল সংকটের বিষয়টি উর্ধ্বতন মহলে জনানো হয়েছে।’

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *