আরকানুল ইসলাম, বাঁশখালী টাইমস: বাঁশখালীতে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের কারণে শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল ওয়াহেদের বাড়ি বাঁশখালীর শীলকূপ ইউনিয়নে। কিছুদিন আগে তিনি বাঁশখালীর সড়ক ধরে চলাচলের সময় হঠাৎ চলন্ত একটি বাসের হাইড্রোলিক হর্নের চাপ সহ্য করতে না পেরে এই দূষণসন্ত্রাসের শিকার হন। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ঘটনার ১২ ঘন্টা পর তিনি তার শ্রবণশক্তি লোপের বিষয় ধরতে পারেন।
এই নিষিদ্ধ হর্নে শ্রবণশক্তি লোপ পেয়ে দীর্ঘ একমাস চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন শিক্ষার্থী আবদুল ওয়াহেদ। সেখান থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর যানবাহনে ‘হাইড্রোলিক হর্ন’ ব্যবহার বন্ধের দাবি জানিয়ে আজ ২৬ আগস্ট লিখিত অভিযোগ জানান। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন গণ্ডামারা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মানবাধিকার কর্মী আলী হায়দার চৌধুরী আসিফ।
এ বিষয়ে আইনি মতামত জানতে চাইলে বাঁশখালী সমিতি চট্টগ্রামের সহ সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এএইচএম জিয়া উদ্দিন বাঁশখালী টাইমসকে বলেন- ‘শব্দসন্ত্রাস নিরসনের লক্ষ্যে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে হাইকোর্টের রীট আছে। ভুক্তভোগী চাইলে আইনের দ্বারস্থ হতে পারবে ও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে। উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিক সমিতিকে এ বিষয়ে কড়া নির্দেশনা জানাতে পারে। তবু অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।’
এ প্রসঙ্গে চবি শিক্ষার্থী ওয়াহেদ বাঁশখালী টাইমসকে বলেন- ‘আমার বাম কানের শ্রবণশক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। আমি চাই না আমার মত কেউ যেন এমন শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হোক। এ ঘটনার পরেও আমি পর্যবেক্ষণ করলাম বাঁশখালী রুটের প্রায় সব বাস সার্ভিস হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে দেদারসে।’
হাইকোর্টের নির্দেশনার ৩ বছর পার হলেও যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ হয়নি। এখনো উচ্চ শব্দের হর্ন বাজিয়ে ছুটছে যানবাহন। হর্ন বাজানোর ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে না এলাকাভিত্তিক নির্দেশিকা। এর বিরুদ্ধে শুধু মামলা দিয়েই দায় সারছে ট্রাফিক পুলিশ। তা-ও সেটা শহরাঞ্চলে। গ্রাম বা মফস্বলের যানবাহনগুলো এই নির্দেশিকার ধারই ধারছে না।
হাইকোর্টের রায়ে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি ও বিক্রি বন্ধের নির্দেশ থাকলেও তা বন্ধ হয়নি। বরং বিভিন্ন এলাকার গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলোতে হরদম এ ধরনের নিষিদ্ধ হর্ন বিক্রি হচ্ছে।
হাইড্রোলিক হর্ন হচ্ছে উচ্চ মাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী বিশেষ হর্ন। আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, মানুষের জন্য শ্রবণযোগ্য শব্দের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডেসিবেল। কিন্তু হাইড্রোলিক হর্ন শব্দ ছড়ায় ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত। এর স্থিতি ৯ সেকেন্ডের বেশি হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। দেশের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুসারে রাজধানীর মিশ্র (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) এলাকায় দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬০ ডেসিবেল। এর চেয়ে উচ্চ মাত্রার শব্দে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদ্রোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বিরক্তি সৃষ্টি ও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটতে পারে।
স্বাস্থ্য ও শ্রবণের জন্য ক্ষতিকর বলে উচ্চ আদালতে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট রাজধানীতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন আদালত। তখন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয় পুলিশকে। পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে গাড়ির মালিক ও চালকদের কাছের থানায় হর্ন জমা দিতে এবং এই হর্ন ব্যবহার করা গাড়ি জব্দ করতেও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
উচ্চ মাত্রার হর্নে পথচারী ও শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলছেন, উন্নত
দেশগুলো থেকে আমদানি করা গাড়িতে এই হর্ন থাকে না। ভারত থেকে আসা গাড়িতে থাকে। বেশির ভাগ সময় দেশে আসার পর নতুন করে হর্ন লাগানো হয়। এটি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএকে কঠোর হতে হবে। শাস্তির পরিমাণও বাড়াতে হবে।
হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে রিট করেছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হর্ন ব্যবহার করায় পুলিশ খুবই নমনীয় শাস্তি দিচ্ছে। এক শ থেকে দুই শ টাকা জরিমানা নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হলে অবস্থার আরও উন্নতি হবে।
২০১৭ সালের রায়ে হাইকোর্ট হর্ন বন্ধের ব্যাপারে অগ্রগতির প্রতিবেদন দুই সপ্তাহের মধ্যে জমা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল। মনজিল মোরসেদ বলেছেন, প্রতিবেদন দিলেও সেটি কেবল হর্ন ব্যবহার করায় কতগুলো মামলা হয়েছে, সেটিকেই প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এ সমস্যার সমাধানে আইন আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন।