BanshkhaliTimes

বাঁশখালীতে বিএনপির প্রার্থী জাফরুলসহ ৪, জামায়াতের প্রার্থী জহিরুল

মোরশেদ তালুকদার ও কল্যাণ বড়ুয়া মুক্তা: আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাছে শরিক দল জামায়াত তিনটি আসন চাইবে; যার একটি বাঁশখালী। সেখানে বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও দলটির। তাই শেষ পর্যন্ত সেখানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী কে হচ্ছেন সেটা এখনো অনিশ্চিত। তবে চট্টগ্রাম-১৬ বাঁশখালী আসনে শক্ত অবস্থান আছে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর। এ পর্যন্ত চারবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন। প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন তিনি। বিএনপি নির্বাচনে গেলে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় এ নেতার মনোনয়ন পাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত।
অবশ্য স্থানীয় বিএনপির একটি অংশের দাবি, জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়া কিছুটা কঠিন হতে পারে। কারণ দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সেক্ষেত্রে মনোনয়ন দৌড়ে থাকবেন ‘আলোচিত চেয়ারম্যান’ লেয়াকত আলী। তিনিও মনোনয়ন চাইবেন দলটির। এছাড়া সাবেক পৌর চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম হোছাইনী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইফতেখার হোসেন চৌধুরী মহসিনও দলটির মনোনয়ন চাইবেন।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের অপর শরিক এলডিপির দক্ষিণ জেলা সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কপিল উদ্দিন চৌধুরীও দল থেকে এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া জামায়াতের একক প্রার্থী আছেন উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম।
জাফরুল ইসলাম চৌধুরী : দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যদি নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেওয়া হয়, তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তাহলে অবশ্যই মনোনয়ন চাইব। নেত্রী আমাকে পরপর চারবার মনোনয়ন দিয়েছিলেন। চারবারই বাঁশখালীবাসী আমাকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সেই দুর্যোগপূর্ণ সময়েও বাঁশখালীবাসী আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। আশা করছি এবং বাঁশখালীবাসীও আশা করছে, আগামী নির্বাচনেও আমাকে মনোনয়ন দেবেন।
বিএনপির অন্য নেতাদের মনোনয়ন চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। অনেকেই দলীয় নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে মনোনয়ন চাইতে পারেন। দল যাকে মনোননয়ন দেবে তিনি-ই নির্বাচন করবেন।
জোটগতভাবে নির্বাচন করলে জামায়াত বাঁশখালীর আসনটি চাইতে পারে? এমন প্রশ্নে জাফরুল বলেন, আমরা ২০ দলীয় জোটের মধ্যে আছি। জোট নেতৃবৃন্দ বসে মনোনয়ন ঠিক করেন। জোটের পক্ষে আমাকে আগেও মনোনয়ন দিয়েছিল এবং জোটের নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে আমার সাথে ছিলেন। সুতরাং এবারও আশা করছি, দল এবং জোট সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দল সুসংগঠিত। দলের নেতাকর্মীরা উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন নির্বাচন করেছেন। তারা অত্যন্ত অভিজ্ঞ। কোন্দল প্রসঙ্গে বলেন, আমরা একটি বড় দল। বড় দলে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থাকতে পারে। এখানেও যে ভুল নেই, এটা বললে ঠিক হবে না। দুই-একজনের যে ভুল বোঝাবুঝি আছে, নির্বাচনের আগে সবকিছুর অবসান হবে। দল যখন মনোনয়ন দেবে, তফসিল ঘোষণা করা হবে, তখন ধানের শীষের জয়ের জন্য সকলে একতাবদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করবে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর। ৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনে সংগ্রাম আহ্বায়ক কমিটির বাঁশখালী শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। ৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে ত্রাণ নিয়ে ছুটে যান। ওই সময় তৃণমূলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার। তখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই বছর আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি নাকচ করে দেন। পরবর্তীতে ৯৬ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। ওই সময় ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ব্যনারে নির্বাচন করে জয়ী হন। ২০০১ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন। ৭ম সংসদ নির্বাচনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ৮ম সংসদ নির্বাচনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ছিলেন। বর্তমানে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি। বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা।
লেয়াকত আলী : বাঁশখালীতে এবার বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন ৯ নং গন্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী। তিনি আজাদীকে বলেন, বিএনপি নির্বাচন করলে অবশ্যই মনোনয়ন চাইব। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। কারণ দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতি করছি।
মনোনয়ন প্রত্যাশী এক নেতার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বাঁশখালীর মানুষ নতুন জামা পরে ঈদ করতে চায়। বিএনপির হাই কমান্ড এবং চট্টগ্রাম বিভাগের বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এলাকায় রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
লেয়াকতের অনুসারীদের দাবি, উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তিনি এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে তিনি দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য। এর আগে ২০০৩-২০০৮ মেয়াদে গন্ডামারা ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।
কামরুল ইসলাম হোছাইনী : মনোনয়ন চাইবেন বাঁশখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল ইসলাম হোছাইনী। তিনি আজাদীকে বলেন, ১৯৯৬ সালেও মনোনয়ন চেয়েছিলাম। যখন ছাত্ররাজনীতি থেকে এসে বিএনপিতে যোগদান করি, সেবারও চেয়েছিলাম। এবার অবশ্যই চাইব।
বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দল মনোনয়ন দেবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ বলে কথা না, জামায়াত, বিএনপি, জাতীয় পার্টি যারা আছে সবার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে। কারো সাথে খারাপ সম্পর্ক নেই। এর কারণ হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় আমি কাউকে হয়রানি করিনি। ফলে সবাই আমাকে খুব ভালো জানেন।
তিনি বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর বাঁশখালীতে বিএনপির খুব খারাপ অবস্থা ছিল। ওই সময় তৃণমূলে বিএনপিকে আমিই সংগঠিত করেছিলাম। তৃণমূলের প্রত্যেক কর্মীর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। ৯১ সালে উপজেলা বিএনপিতে প্রভাবশালী কোনো নেতা ছিলেন না। তখন প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ বণ্টন কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলাম।
অ্যাডভোকেট মো. ইফতেখার হোসেন চৌধুরী : দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. ইফতেখার হোসেন চৌধুরীও দলটির মনোনয়ন চাইবেন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের চেয়ারপার্সনকে মুক্তি না দিলে কোনো নির্বাচন হবে না। দল নির্বাচনে গেলে আমিও মনোনয়ন চাইব। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী তিনি।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ১/১১ পরবর্তী সময়ে ফখরুদ্দীন/মঈনউদ্দীন সরকার রাজনীতিবিদদের ওপর দমন-পীড়ন চালালে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরসহ উত্তর এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে ভূমিকা রেখেছিলাম।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্যে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৮০ সালে ফতেয়াবাদ আদর্শ ও বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জিএস নির্বাচিত হন। সেসময় সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর ২২ নভেম্বর দক্ষিণ জেলা জাতীয়তাবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি পুনর্গঠিত হলে সেই কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
জামায়াত : বাঁশখালী আসন তাদের কাছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিএনপির কাছে দাবি জানিয়েছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড। এক্ষেত্রে তাদের একক প্রার্থী জামায়াতের বাঁশখালী উপজেলা আমির ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জহিরুল ইসলাম একক প্রার্থী।
তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সাধারণ জনগণের মাঝে সমবণ্টন করছি। এতে সাধারণ জনগণ আমাদের প্রতি আন্তরিক। তাছাড়া এমনিতে আমাদের অর্ধলক্ষাধিক দলীয় ভোট রয়েছে। ওই জায়গা থেকে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
এলডিপি : বিএনপির শরিক দল এলডিপিও মনোনয়ন চাইবে। এক্ষেত্রে জেলা জজ আদালতের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী দলের মনোনয়ন প্রত্যাশায় প্রচার চালাচ্ছেন। তিনিই দলটির একক প্রার্থী বলে দাবি করেন। প্রসঙ্গত, বাঁশখালীতে এলডিপির কর্মীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে।
আল্লামা হাফেজ ফরিদ আহমদ আনসারী : গন্ডামারা ইউনিয়নের পূর্ব বড়ঘোনা গ্রামের বাসিন্দা, জামেয়া দারুল মা আরিফ আল ইসলামিয়ার মুহাদ্দিস ও জামেয়া কারিমিয়া হালিশহরের প্রিন্সিপাল মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ ফরিদ আহমদ আনসারী। দীর্ঘ ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। পীর সাহেব চরমোনাই তাকে বাঁশখালী পৌরসভা ভবন মাঠে জনতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি আলেম ওলামা সমর্থিত একমাত্র প্রার্থী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন তিনি।

আসন সম্পর্কিত : বাঁশখালীতে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বিজয়ী হন। তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন, তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সুলতানুল কবির চৌধুরী; ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। দশম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী।

সূত্র: দৈনিক আজাদী

Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *